ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থছাড় বেড়েছে

হরতাল-অবরোধের প্রভাব নেই বৈদেশিক সহায়তায়

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৩০ মার্চ ২০১৫

হরতাল-অবরোধের প্রভাব নেই বৈদেশিক সহায়তায়

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ চলমান হরতাল-অবরোধেও অর্থছাড় বাড়িয়েছে দাতারা (উন্নয়ন সহযোগী)। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) অর্থছাড় হয়েছে মোট ১৮৪ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ১৪৯ কোটি ৪৮ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার এবং অনুদান হচ্ছে ৩৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড় হয়েছিল ১৮২ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ১৫০ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার এবং অনুদান হচ্ছে ৩১ কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে অর্থছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১ কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে বিশ্বব্যাংক। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ হিসাব থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে (এক মাসে) উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থছাড় করেছে মোট ৯ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার এবং অনুদান হচ্ছে ৮৩ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী শফিকুল আজম জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা আইডার ঋণ ব্যবহারে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আমাদের অবস্থান অনেক উপরে। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব এখনও সরাসরি বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে পড়েনি বলেই সাত মাসে বৈদেশিক সহায়তা বেড়েছে। তিনি জানান, সরকারী সম্পদ ব্যবহারে সক্ষমতা বৃদ্ধি, সরকারী কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা, নতুন নতুন দাতা দেশ যুক্ত হওয়া এবং বাংলাদেশে সহায়তার প্রয়োজনীয়তা দাতাদের বোঝাতে পারার কারণেই বৈদেশিক সহায়তা বেড়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল সে আশঙ্কা কেটে গেছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের তৎপরতা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সফল নেগোশিয়েশনের ফলেই উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়েছে। আগামীতে বৈদেশিক সহায়তা আরও বাড়বে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, তুলনামূলকভাবে দাতাদের প্রতিশ্রুতি কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দাতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২৪৭ কোটি ৩৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২১৩ কোটি ৬৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার আর অনুদান হচ্ছে ৩৩ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল ২৮৪ কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার। মধ্যে ঋণের পরিমাণ ২৪৫ কোটি ৯৭ লাখ মার্কিন ডলার এবং অনুদান হচ্ছে ৩৮ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে কোন খারাপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার প্রমাণ হচ্ছে হরতাল অবরোধ সত্ত্বেও দাতাদের অর্থছাড় বেড়েছে। প্রতিশ্রুতি কিছুটা কম থাকলেও তা আগামী মাসগুলোতে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। রাজনৈতিক অস্থিরতায় দাতারা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে এ কথা বলার উপায় নেই। সহায়তা বরং বাড়ছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে আট মাসে দাতাদের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে মোট ৭৯ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আসল ৬৫ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার এবং সুদ ১৩ কোটি ৪৩ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরে একই সময়ে মোট ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আসল ৭৬ কোটি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার এবং সুদ ১৪ কোটি ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থছাড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বিশ্ব ব্যাংক। প্রধান অর্থছাড়কারী সংস্থাগুলো হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক গত আট মাসে ছাড় করেছে মোট ৫৭ কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার মার্কিন ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ছাড় করেছে ৫২ কোটি ৭৮ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ছাড় করেছে ১০ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ১৫ কোটি ৬১ লাখ মার্কিন ডলার, রাশিয়া ছাড় করেছে ৭ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার, ইউএনডিপি ৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার এবং ভারত ৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করেছে। এ বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্ব ব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গত তিন বছর ধরে প্রতিবছর বিশ্ব ব্যাংকের ডিসবাসমেন্ট তার আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। এক্ষেত্রে যেটি হয়েছে সেটি হচ্ছে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উপর মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। ডোনার এবং সরকার উভয় পর্যায়েই এটি করা হয়েছে। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রকল্পগুলোতে একাধিক দাতা যুক্ত ছিল। এক্ষেত্রে একটি দাতা বেশি অর্থছাড় করলে তো হবে না। সবার অর্থছাড় থাকতে হবে। এজন্য যেসব প্রকল্পের অর্থছাড়ে সমস্যা ছিল সেগুলো বিষয়ে প্রতি মাসে ডোনার ও সরকারী পর্যায়ে টেকনিক্যাল লোকজন প্রথমে বৈঠক করতেন। সেখানে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের করণীয় নির্ধারণ করা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাকে চিহ্নিত করা হতো। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের একটি এ্যাকশন প্ল্যান করা হতো। পরের মাসের মিটিংয়ে আবার এগুলোর ফলোআপ করা হতো। যদি দেখা যেত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন প্রতি তিন মাসে উচ্চ পর্যায়ের (সচিব) একটি বৈঠক করা হতো। সেখানে প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করা হতো। এভাবে সমস্যা সমাধান করা হতো। আগে বৈঠক ডাকলে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কেউ আসতেন না। ওই সময় সমস্যা চিহ্নিত হলোও ওই পর্যন্তই থাকত। সমাধান হতো না। কিন্তু এখন সমস্যা সমাধানে সবার আন্তরিকতা ও গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলেই বৈদেশিক অর্থছাড় বাড়ছে।
×