ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মসজিদ স্থাপত্য শিল্প

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৭ মার্চ ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মসজিদ স্থাপত্য শিল্প

পৃথিবীতে প্রথম যে গৃহখানি নির্মিত হয়েছিল, তার উল্লেখ কুরআন মজীদে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায়, তা বরকতময় ও বিশ্ব জগতের বিশারী। তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। যেমন : মাকামে ইব্রাহীম এবং যে ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করে সে নিরাপদ। আর আল্লাহর জন্য ঐ গৃহে হজ্জ করা সেই মানুষের উপর কর্তব্য হয়ে যায়, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৯৬-৯৭)। এই আয়াতে কারীমায় মক্কার প্রাচীন নাম বাক্কার উল্লেখ রয়েছে এবং বিশ্বের প্রাচীনতম ইবাদতগাহ্ বায়তুল্লাহ্ বা কা’বা শরীফের কথা বলা হয়েছে। এই কা’বা শরীফেই মুসলমানদের কিবলা। কা’বার দিকে মুখ করেই সালাত আদায় করা হয়। এই কা’বা শরীফ নির্মাণের আদি ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও আদি মাতা হাওয়া (আঃ) জান্নাত হতে পৃথিবীতে অবতরণ করার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে তাঁদের পুনর্মিলন হয় আরাফাত ময়দানে। এখান হতে তাঁরা মক্কা শরীফ এসে আল্লাহর নিকট ফেরেশতাদের ইবাদতগাহ্ বায়তুল মামুরের মতো একটি ইবাদতগাহ্ স্থাপনের আশা ব্যক্ত করেন। অতঃপর ফেরেশতাদের সাহায্যে একটি গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় মক্কায়। আল্লাহ হযরত আদম (আঃ) কে সমস্ত জ্ঞানদান করেছিলেন যার মধ্যে স্থাপত্য শিল্পজ্ঞানও ছিল। তিনি ফেরেশতাদের দ্বারা স্থাপিত ভিত্তির উপর দেওয়াল স্থাপন করে যে গৃহ নির্মাণ করেন সেই পবিত্র গৃহই হচ্ছে কা’বা শরীফ। হাজার হাজার বৎসর ধরে নানা উত্থান-পতন অতিক্রম করে পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের পর সংস্কারের মধ্য দিয়া কা’বা গৃহ স্বমহিমায় দ-ায়মান রয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির প্রায় পাঁচ বৎসর পূর্বে এই কা’বা ঘর সংস্কারের অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই কা’বা শরীফ থাকার কারণেই মক্কা শরীফ পবিত্রতম নগরী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের যে সূচনা হয় তা মূলত মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থিত মসজিদে নববী স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আওয়াল মাসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় প্রবেশের পূর্বে তিনি মদীনা হতে তিন মাইল দূরে কুবা নামক স্থানে কয়েকদিন অবস্থান করেন। এই সময় তিনি কুবাতে একটি মসজিদ স্থাপন করেন। কুবাতে তিনি ১৪ দিন ছিলেন। অতঃপর তিনি মদীনায় প্রবেশ করেন। মদীনায় এসে তিনি বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আইয়ুব আনসারীর বাড়িতে অবস্থান করেন। এই সময়কালে তিনি একখ- জমি ক্রয় করে সেখানে একটি মসজিদ স্থাপন করেন এবং সেই মসজিদের পূর্বের দেওয়াল ঘেঁষে নির্মিত হয় তাঁর হুজরাখানা। এই মসজিদই মসজিদুন নববী। মসজিদে স্থাপত্যের মূল শোভা হচ্ছে আলো-হাওয়া প্রবেশের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মসজিদের মূলত তিনটি অংশ আছেÑ কিবলার দিকে মুখ করে সেখানটিতে ইমাম সাহেব দাঁড়ান সেখানটির সম্মুখভাগে গোলাকৃতি কিম্বা চৌকোনাকৃতি যে দেয়াল বেষ্টনী দিয়ে স্থান নির্মিত হয় তাকে বলা হয় মিহরাব। ইমামের পিছনে যে প্রধান অংশটি থাকে তাকে বলা হয় জুল্লাহ্। জুল্লাহ্র বাইরে যে উন্মুক্ত অংশ থাকে তাকে বলা হয় সাহ্ন বা চত্বর। খুত্বা দিবার জন্য ইমামের ডানপার্শ্বে স্থাপিত হয় সাধারণত তিন ধাপবিশিষ্ট মিম্বার। এছাড়াও আযান দিবার জন্য মসজিদসংলগ্ন করে স্থাপিত হয় মিনার বা মানারা। যাকে মিযানা বা মাযানাও বলা হয়। প্রিয় নবীর নির্দেশে মদীনার আশপাশ এলাকায়, এমনকি ইয়েমেনে কয়েকটি মসজিদ স্থাপিত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে ইসলামের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের সৌকর্য দিনকে দিন সম্প্রসারিত হতে থাকে। কিরান, গম্বুজ ইত্যাদি ইসলামী স্থাপত্যের বিশেষ উপাদানে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আক্সা মক্কার কা’বা ঘরের পরেই প্রাচীন ইবাদতগাহ্। হিজরতের পূর্বে প্রিয় নবী (সাঃ) এই মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করিতেন। হিজরতের প্রায় পৌনে দুই বৎসর পূর্বে মি’রাজ গমনকালে তাঁকে বুরাকে করে এই খানেই প্রথম নিয়ে আসা হয়। এই খানে তিনি সমস্ত নবী-রাসূলগণের জামাতে ইমামতি করেছিলেন। পূর্ব যামানার বহু নবীর স্মৃতি এর সাথে জড়িত আছে। হযরত দাউদ (আঃ) এবং হযরত সুলায়মান (আঃ) এই খানেই ইবাদতগাহ্ স্থাপন করেছিলেন। এই ইবাদতগাহ্রে একটি পাথরকে কেন্দ্র করে ৮ম শতাব্দীর শুরুতে উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক অষ্টকোনাকৃতির একটি সুন্তর ইমারত নির্মাণ করেছিলেন যার ওপর তিনি একটি গম্বুজ স্থাপন করেন। এই ইমারত কুব্বাতুস সাখরা বা শিলা গম্বুজ নামে পরিচিত। এই কুব্বা বা গম্বুজই ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম প্রধান শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। যা পরবর্তীতে মসজিদ স্থাপত্য শিল্পের প্রধান অঙ্গ হিসেবে সারা দুনিয়ার অধিকাংশ মসজিদ স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। কুব্বাতুস সাখ্রার পূর্বে কোন ইসলামী স্থাপত্য নিদর্শনে কুব্বা বা গম্বুজ ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর খিলাফত আমলে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সেনানগরী স্থাপিত হয় সুরিস্তান নামে পরিচিত স্থানে। যার নতুন নামকরণ করা হয় কুফা। এই নতুন নগরীর মধ্যস্থলে সিপাহ্ সালার সাহাবী হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) একটি মসজিদ স্থাপন করেন। এই মসজিদের চতুর্দিকে স্থাপিত হয়েছিল পরিখা। এই মসজিদেই সর্বপ্রথম মর্মর পাথরের স্তম্ভের উপর মূল সালাত কক্ষ বা জুল্লাহ্র ছাদ স্থাপন করা হয়েছিল। হযরত আলী (রাঃ) মদীনা হতে রাজধানী কুফায় স্থানান্তরিত করেছিলেন। তাঁর শাহাদতের পর হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) রাজধানী স্থানান্তরিত করেন দামেস্কে। দামেস্কে স্থাপিত হয় সুন্দর মসজিদ। এই মসজিদের জুল্লাহ ও সাহ্ন বিশেষ বিন্যাসে সংস্থাপিত করা হয়। সাহনের তিন দিকে রিওয়াক বা আবেষ্টনী কুঠরী স্থাপন করে মসজিদটিতে বাইরের কোলাহল যাতে প্রবেশ না করে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সাহ্নের আলোর জন্য বিশেষ ধরনের আলোঘর স্থাপন করা হয়। এর সম্পূর্ণ মেঝে মর্মর পাথর দ্বারা অলংকৃত করা হয়। এর দেওয়াল ও ছাদও অলংকৃত করা হয়। হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) কাসর আল খাযরা বা সবুজ প্রাসাদ নামক এক শাহী মহল নির্মাণ করেন। যা ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে মশহুর হয়। উমাইয়া আমলে হযরত উক বা বিন নাফি ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে ইফরিকিয়ার রাজধানী কায়রোযানে একটি সুরমা মসজিদ নির্মাণ করেন। তিউনিসিয়ার দক্ষিণে সামরিক ছাউনি হিসেবে কায়রোয়ান নগরী স্থাপিত হয়েছিল। আফ্রিকা ভূ-খ-ে মুসলমানদের দ্বারা স্থাপিত এই নগরী নানা স্থাপত্য দ্বারা শোভিত করা হয়। কায়রোয়ান মসজিদের স্তম্ভ, খিলান, মিহরাব, মিনার, দেয়াল গাত্রের অলংকরণ ও সাজসজ্জা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। উমাইয়া খিলাফত আমলে বিভিন্ন নগরীতে অসংখ্য সুরমা ইমারত গড়ে ওঠে। আব্বাসী আমলে ইসলামী স্থাপত্য শিল্প প্রভূত সৌকর্যম-িত হইয়া বিকশিত হয়। আব্বাসীয় খলীফা আবু ফা’ফর আল মনসুর বাগদাদ নগরীর পত্তন করেন এবং এখানে রাজধানী স্থাপন করে একে সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে গড়ে তোলেন। আব্বাসীয় খলীফাগণ স্বপ্নপুরী বাগদাদ নগরীতে সুরম্য দালান-কোঠা, দেওয়াল বেষ্টনী শাহী মহল প্রভৃতি নির্মাণ করেন। আবু জাফর আল মনসুর বাবুল যাহাব বা স্বর্ণদ্বার নামে একটি মনোরম গেট নির্মাণ করেন, নির্মিত হয় কাসরুল খুলদ বা অনন্তধাম, রুসাফাসহ অসংখ্য ইমারত। বাগদাদের অন্তর্গত শামসীয়াতে বারমেকীরা আকর্ষণীয় সৌধমালা স্থাপন করেছিল। আব্বাসীয় খলীফা মুতাওয়াক্কিলবিল্লাহ সামারাতে একটি সুবিশাল মসজিদ স্থাপন করেছিলেন। এই মসজিদের মিনার ইসলামী স্থাপত্যশিল্পে নয়া মাত্রা সংযোজন করে। বাগদাদের রুসাফা মহল দারুল সাজারা (বৃক্ষাধাম) অপূর্ব স্থাপত্য স্থাপনা হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। প্রায় একই সময় স্পেনের বুকে ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের চরম বিকাশ ঘটে প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য ইমারত, বাগিচা বিনোদন কেন্দ্র শিক্ষানিকেতন এবং বৃহৎ বৃহৎ মসজিদ। কর্ডোভার মসজিদ ইসলামী স্থাপত্য নিদর্শনের সমুজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। উসমানীয়া খিলাফত আমলে ইস্তাম্বুল এবং মুঘল আমলে ঢাকা মসজিদ নগরীতে পরিণত হয়। এমনিভাবে আমরা লক্ষ্য করি ইসলামী স্থাপত্যশিল্প বিশ্বের নানা দেশে নানা জনপদে আপন মহিমায় ভাস্বর হয়। প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যে সবর্ত্র এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কর্ডোভা, গ্রানাডা, সমরকন্দ, বুখারা, গজনী, বাগদাদ, কায়রো, ইস্তাম্বুল, সিরাজ, দিল্লী, আগ্রা, লাহোর, লক্ষেèৗ, কাবুল, কান্দাহার এমনকি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ইসলামী স্থাপত্যশিল্প তার সৌন্দর্য বিভা ছড়াতে সমর্থ হয়েছে। ইসলামী স্থাপত্য রীতিতে মসজিদ, মাদরাসা, খানকা, মাযার, দরগাহ, মুসাফিরখানা, দুর্গ, সুন্দর সুন্দর বাসভবন, সেতু, বাজার, নগর-বন্দর, বিপণিকেন্দ্র, স্মৃতিস্তম্ভ, সামরিক ছাউনিসহ অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন গড়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য জগতেও ইসলামী স্থাপত্য রীতির ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সাঃ) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
×