ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র’ একটি পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৭ মার্চ ২০১৫

‘বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র’ একটি পর্যালোচনা

কাজী আরেফ আহমেদ এর ‘বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র’ এবং মনিরুল ইসলামের ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ এই দুটি বইয়ে বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। বাঙ্গালীর মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পদযাত্রার কথা উল্লেখ রয়েছে গত পর্বে। এ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা শেখ মুজিবকে ‘ছয় দফা’ দাবি পেশ করতে সাহস যুগিয়েছিল। তেমনি আমরা ‘নিউক্লিয়াসের’ নেতারা ও বিপ্লবী পরিষদের সদস্যরা ছাত্রলীগের মধ্যে সরাসরিভাবে স্বাধীনতা ও জনযুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলতে সুযোগ ও সাহস পেয়েছিলাম।” (পৃষ্ঠা, ৩৪) পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখে। এ বিষয়ে কাজী আরেফ একেবারে শেষে ‘১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে সিরাজুল আলম খান’ শিরোনামে কয়েক লাইন মাত্র লিখেছেন। পুস্তকটির সম্পাদক লিখেছেন কাজী আরেফের মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ার কথা। ‘সুন্দর বাঁধাই করা খাতা এবং টাইপ করা লেখাগুলো আর পেলাম না। তাঁর মৃত্যুর পর বাসা একাধিকবার লুটপাট ও তছনছ হয়। কাজেই আমার নিজ চোখে দেখা পাণ্ডুলিপিটি পাওয়ার আশাবাদ দিয়ে যা পেয়েছি তা-ই টাইপ করে সাজিয়েছি।’ (পৃষ্ঠা, ১৪) ধারণা করি ’৬২’র গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আন্দোলন বিষয়ে কাজী আরেফের কিছু না বলা হয়ত সে কারণে ঘটেছে। আরও একটি কারণ হয়ত এই যে, তখনও পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনের মূলধারায় ছাত্রলীগের চাইতে অগ্রবর্তী অবস্থানে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তবে ১৯৬৫’র ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসব পণ্ড করে দেয়া, ১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী ‘বাংলা প্রচলন সপ্তাহ’ পালন, ৬ দফা কর্মসূচী ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান- এসব অধ্যায়ে সেই সব তথ্যাবলী সংযোজন করেছেন কাজী আরেফ যা থেকে ধাপে ধাপে গড়ে তোলা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপটি পরিষ্কার ধরা পড়ে। ৬ দফা প্রসঙ্গে কাজী আরেফ লিখেন, “৬ দফা কর্মসূচী মূলত ’৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় রচিত হয়েছিল। ...যুদ্ধকালে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে বাঙালী অর্থনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে গিয়ে ‘লাহোর প্রস্তাব’র ভিত্তিতে ফেডারেল সরকার গঠন করাকেই গ্রহণযোগ্য সমাধান বলে মনে করেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, শামসুর রহমান, আহমেদ ফজলুর রহমান ও রুহুল কুদ্দুসের উদ্যোগী ভূমিকাসহ বেশ কিছুসংখ্যক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অবদান হিসেবে ৬ দফাকে ধরা যেতে পারে। কিন্তু ৬ দফা উত্থাপনের কাল, উপস্থাপনা, আন্দোলনে প্রচার ও সর্বোপরি ৬ দফাকে বাঙালীর প্রাণের দাবিতে পরিণত করার কলা-কৌশল সবকিছুর জন্য প্রশংসা পাওয়ার অধিকারী একমাত্র শেখ মুজিবই এবং ছাত্রলীগ ও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’র সদস্যদেরই। ... ৬ দফা ঘোষণার পরপরই শেখ মুজিব সিরাজ ভাই ও মনি ভাইকে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে ডেকে পাঠান। তাদের হাতে ৬ দফার দু’টি কপি দিয়ে পড়তে বলেন। সিরাজ ভাই পড়া শেষে মুজিবের সঙ্গে আর দেখা না করেই সরাসরি রাজ্জাক ভাই ও আমাকে ৬ দফার বিষয়টি দেখান ও পড়তে বললেন। সে মুহূর্তেই আমরা ‘নিউক্লিয়াস’ সিদ্ধান্ত নেই ৬ দফাকে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে হবে।” (পৃষ্ঠা, ৪২-৪৩) ৬ দফার তত্ত্বগত ভিত্তি রচনায় কাজী আরেফ প্রয়াত অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখলাকুর রহমানের কথাও বলতে পারতেন। তাঁর গবেষণাতেও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতি উঠে এসেছিল। আখলাকুর রহমানের কথা তুলে ধরা আরও বেশি প্রয়োজন কারণ স্বাধীনতার পর পর তাঁর গবেষণা-সঞ্জাত ‘বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’-এর ওপর ভিত্তি করেই বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক এবং সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে জাসদের উদ্ভব ঘটে ছিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ‘নিউক্লিয়াসের’ ভূমিকার কথা লিখেছেন কাজী আরেফ। ছাত্রদের ১১ দফায় ৬ দফা দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করার শর্ত হিসেবে ১০ নম্বর দফায় সিয়েটো ও সেন্টো চুক্তিসহ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবিটি যুক্ত করতে ছাত্রলীগ রাজি হয় সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে। উল্লেখ্য, মেনন গ্রুপ ৬ দফাকে সিআইএ’র পাকিস্তান ভাঙ্গার কর্মসূচী হিসেবে চিত্রিত করত। এ অধ্যায়ে কাজী আরেফ আরও জানাচ্ছেন, “’৬৮-’৬৯-এর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসম রবের বলিষ্ঠ ভূমিকা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।” (পৃষ্ঠা, ৪৬) ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ অধ্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য আছে। জেলগেটে ক্যামেরা ট্রায়ালে বলা হয় ‘শেখ মুজিব ভারতে গিয়ে ভারতের সঙ্গে চক্রান্ত করে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।’ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১১ সালে তৎকালীন সংসদের ডেপুটি স্পীকার কর্নেল শওকত আলী বলেন যে, আগরতলা মামলা ও ঐ মামলার সব ঘটনা সত্য ছিল। এ বিষয়ে তিনি একটি বইও রচনা করেছেন। প্রথমা থেকে প্রকাশিত বইটির নাম ‘সত্য মামলা আগরতলা’। দ্বিতীয় পর্ব “‘৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির পর তাঁর সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’ ঘনিষ্ঠ হয়।” চিত্তরঞ্জন সূতারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বোঝাপড়া বিষয়ে কাজী আরেফ লিখেন, “১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেওয়ানীতে ছিলেন। সেখানে নতুন ২০ সেলে আরেকজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ’৫৪ সালের গণপরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সূতারও ছিলেন। ... কারাগারে শেখ মুজিব ও চিত্তরঞ্জন সূতারের মধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ও স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তর করার কলাকৌশল নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়ে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথাও আলোচনা হয়। ...‘৬৯ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদনের মাধ্যমে শ্রী সূতার জেল থেকে বেরিয়ে মুজিবের দূত হিসেবে কলকাতায় অবস্থান নেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গে শ্রী সূতার ভারত সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সাহায্য, সহযোগিতা ও সহানুভূতি আদায় করতে সক্ষম হন। এই সময়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী চিকিৎসার জন্য ভারত যান। তখন তিনিও দূতিয়ালির কাজে সাহায্য করেন।” (পৃষ্ঠা, ৫০) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উত্তাপে ও পটভূমিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন কাজী আরেফ। লিখেছেন, ‘এই মামলায় শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং মামলার বিরুদ্ধে জনগণের সহিংস প্রতিরোধ ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সালে বিচারাধীন বন্দী অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী গুলি করে হত্যা করে।’ এই হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের বিবরণ দিয়েছেন কাজী আরেফ। জহুরুল হকের লাশ নিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল শিক্ষা ও তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন, ঢাকার নবাব খাজা হাসান আসকারী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি খাজা খয়েরউদ্দিনের বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। লক্ষাধিক মানুষের মিছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এসএ রহমানের বাসভবনে আগুন লাগায়। জনতা নীলক্ষেত ও বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে ও বায়তুল মোকাররমের দু’টি আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান লুট করে। অস্ত্রগুলো ইকবাল হলে জমা রাখা হয়। পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা আর সম্ভব হয় না। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী উত্তাল এই আন্দোলন কালে ‘নিউক্লিয়াস’ ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার কথা কাজী আরেফ জানান। “এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ’৬৮ ও ’৬৯-’৭০-এ অনুষ্ঠিত আন্দোলন ও এর খুঁটিনাটি, পর্যায়, কৌশল এককভাবে ‘নিউক্লিয়াসে’-এর পক্ষ থেকে সিরাজ ভাই ঠিক করতেন। ... আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর দক্ষতা ও নিপুণতা পরবর্তী সময়ে ’৭০-এর নির্বাচন, অবাঙালী প্রশাসন ভেঙ্গে পড়লে সমানন্তরাল প্রশাসনিক কর্মকৌশল তাঁর মেধা ও জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে সকলের কাছে জাতীয় পর্যায়ের এক অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অবাঙালী প্রশাসনের পরিবর্তে তাঁর ও দক্ষতা দিয়ে গড়ে তোলা হয় ছাত্র ব্রিগেড, যুব ব্রিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড, কৃষক ব্রিগেড, জয় বাংলা বাহিনী, নারী ব্রিগেড। ... আন্দোলনকে গণমুখী করার এ কৌশল অবলম্বনের একক কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসে’র ও সিরাজুল আলম খানের। অসহযোগ আন্দোলনকে পুরোপুরি সফল করার কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসের’।” ১৯৭২ সালে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান বলেন : [...] a discussion Sheikh Mujib had with President Tito, while on a visit to Yugoslavia, on the role of bureaucracy is worth recalling. The conversation turned to the problems that a leader faced in his attempt to build a newly independent country on the basis of a different socioeconomic philosophy. Hwo did the officials steeped in the old traditions and ideology perform this task in Yugoslavia? Tito was emphatic that it was very essential that the bureaucrats fully shared the aspirations and ideas of the political leadership and were committed to them. Otherwise, it was not feasible to implement nwe policies. Accordingly, when Marshall Tito took over power in Yugoslavia, he got rid of the old guard, the experienced and senior officials of the old regime, and manned the entire government with the partisans, mostly young, who fought for independence. They were inexperienced but committed young party cadres. In his opinion, they did well because they had commitment and dedication; they were also closely guided and supervised by Tito and his senior colleagues. Maû in Yugoslavia expressed apprehensions that administrative efficiency and development activities would be retardedand countryÕs progress would be hampered. They proved to be false prophets. [...] Those of us who listened to this conversation had to recognise that the situation in Bangladesh was very different from that of Yugoslavia. We did not go through a socio-political revolution of the type that occurred in Yugoslavia. Our Mukti Bahini was not comparable to the party cadres or the partisans of Yugoslavia., who were led by a group of dedicated leaders to overthrwo the old socioeconomic order. [...] অধ্যাপক নুরুল ইসলামের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায় যে, তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল সম্পূর্ণভাবে ভুল। আজ পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে শুধু ছাত্র ব্রিগেড, যুব ব্রিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড, কৃষক ব্রিগেড, জয়বাংলা বাহিনী, নারী ব্রিগেডই ছিল না, তার সঙ্গে আরও ছিল পরীক্ষিত ও সুশৃঙ্খল মুক্তি বাহিনী। ছিল মুজিব বাহিনী- যা গঠিত হয়েছিল প্রায় এক দশক ধরে ছাত্র রাজনীতি করে আসা ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা। দুঃখজনক বিষয় এই যে, মুক্তিযুদ্ধের পর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনে এদের একেবারেই ব্যবহার করা হয়নি। “’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঘোষণা দিয়ে ‘আগরতলা মামলা’ প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্ত এবং রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র পক্ষ থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।” কাজী আরেফ জানাচ্ছেন, ‘এ মহাসভাতে সিরাজুল আলম খানের পরামর্শেই তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করেন।’ আগরতলা মামলা বিষয়ে কাজী আরেফের অভিমত হচ্ছে, ‘ঐ প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে বাঙালীর সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পাওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।’ (পৃষ্ঠা, ৫২-৫৪) ১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারির সিদ্ধান্ত এবং ছাত্রলীগ তথা জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের পরবর্তী কর্মতৎপরতা, প্রচার-প্রচারণা এবং সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অভিযানের সুফল অচিরেই পাওয়া যেতে শুরু করে। অনেক উদাহরণ দিয়েছেন কাজী আরেফ। যেমন, ইনভেলপের পরিবর্তে খাম, পোস্টঅফিসকে ডাকঘর, ক্লাস রুমকে শ্রেণী কক্ষ লেখা। দোকানের সাইনবোর্ডগুলোতে বাংলায় নানা বাংলা নাম যেমন, ধানসিঁড়ি, সোনারতরী, নয়নতারা, বনলতা লেখা। নিউমার্কেটে বইয়ের ও খাতাপত্রের দোকান। “‘নলেজ হোমে’ দু’আনা দামের এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া যেত, যার মলাটে ছোট্ট করে লাল অক্ষরে লেখা থাকত নেতাজীর সেই আগুন ঝরানো উক্তি, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব’।” (পৃষ্ঠা, ৩৫-৩৬) ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ ও নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল আরও আগে ১৯৬২ সালে। তার কথা কাজী আরেফ বলেছেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস’ পরিচ্ছদে। তিনি লিখেছেন, স্বাধীনতার চিন্তা-ভাবনা বিষয়ে তিনি প্রথমে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কিন্তু দু’জন একমত হতে পারেননি। পরে ‘সিরাজুল আলম খান ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা হলে (বর্তমান শহিদুল্লাহ হল) বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে একমত হই। (চলবে)
×