ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিটি নির্বাচনে পেট্রোলবোমা মঞ্চ ও প্রতীক পেট্রোলবোমা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৬ মার্চ ২০১৫

সিটি নির্বাচনে পেট্রোলবোমা মঞ্চ ও প্রতীক পেট্রোলবোমা

তরুণ প্রজন্ম সব সময়ই চিন্তার দিক থেকে অগ্রণী থাকে। চক্ষু-কর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা প্রবীণ পাকারা যতই তাদের ফাঁকি দেবার চেষ্টা করুক না কেন, তাদের ফাঁকি দেয়া যায় না। মঙ্গলবার সকালে তখনও পত্রিকা দেখিনি। খুব ভোরে ওয়াশরুমে বসে টেলিফোন সেটটিতে ফেসবুকে ঢুকেই বিস্মিত হইÑ এক তরুণের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে। সে লিখেছে, বিষ (বিশ) দলের সিটি নির্বাচনের জন্য যে নাগরিক মঞ্চ হবে, তার নাম দেয়া হোক পেট্রোলবোমা মঞ্চ। আর সিটি নির্বাচনে তাদের প্রতীক দেয়া হোক পেট্রোলবোমা। তার পরে সে একটি দৈনিকে প্রকাশিত লিড নিউজের অংশবিশেষ তুলে দিয়েছে তার স্ট্যাটাসে। ওই নিউজে এমাজউদ্দীন আহমদ, মাফুজুল্লাহ, রুহুল আমীন গাজী এ রকম কয়েকজনের নাম দিয়ে বলা হয়েছে তাঁদের উদ্যোগে এই মঞ্চ তৈরি হবে। জামায়াত-বিএনপি এই নাগরিক মঞ্চের নামে ঢাকা সিটি নির্বাচন করবে। নিউজের বিস্তারিত কিছু অংশ তুলে দিয়ে ওই তরুণ মন্তব্য করেছে তার স্ট্যাটাসে, এই বিশেষ দৈনিকটি এখন এভাবেই জামায়াত-বিএনপিকে গাইড লাইন দিচ্ছে ও তাদের রক্ষা করার কাজ করে যাচ্ছে। তরুণের এই ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পড়ে মনে মনে ভাবি, সত্য আসলে কত কঠিন। কোন কিছু দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না। যারা সমাজের ওপরতলায় বসে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেন, তাঁরা তাই শেষ অবধি কখনও কখনও সফল হন। সত্য যা- তা মানুষ বুঝে ফেলে। আর যে তরুণ, যার মস্তিষ্ক সতেজ, তাকে ফাঁকি দেয়ার কোন পথ থাকে না। তাই যারা তথাকথিত মঞ্চ তৈরির বুদ্ধি দিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামিক সন্ত্রাসী গ্রুপ জামায়াত-বিএনপিকে রক্ষা করতে গেছে, তারা প্রথমেই ধরা পড়ে গেছে। তরুণ প্রজন্মই তাদের চালাকি ধরে ফেলেছে। তবে ওই যে চক্ষু-কর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা প্রবীণরা যে জানেন না তাঁরা ধরা পড়ে যাবেন, তা কিন্তু নয়। এ জেনেও তারা কেন এ কাজ করতে যায়, তার কিছু কারণ আছে। কারণ, তাঁরা আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত। তাঁরা এই মধ্যবিত্তের চরিত্র বোঝেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের চরিত্র নিয়ে এই কলামে অনেক বার লিখেছি। বিস্তারিত লেখার জন্যে এ কলামও নয়। তবে এ মধ্যবিত্তের একটি অংশের বিকাশ ঘটেছে কিভাবে তা কমরুদ্দীন আহমদের মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ বা আবু জাফর শামসুদ্দিনের বিভিন্ন লেখা পড়লে বোঝা যায়। এদের বড় একটি অংশের বিকাশ ঘটেছে লজিং থেকে পড়াশোনা করে। একাডেমিক সার্টিফিকেট হয়েছে, চাকরি হয়েছে, অর্থ হয়েছে। কালচার জন্মায়নি। কালচার সহজে হয় না। এর জন্য ধারাবাহিকতা লাগে। জ্ঞানভিত্তিক জীবন গড়ে তোলার পরিবেশ লাগে। এর পরে ঢালাওভাবে মধ্যবিত্ত তৈরি করেছেন এ দেশে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ও জিয়াউর রহমান। সরকারী টাকা দিয়ে লোককে ধনী হবার সুযোগ করে দিয়েছেন। যার ফলে দ্রুত একটি ধনী শ্রেণী গড়ে উঠেছে। তারা জ্ঞানভিত্তিক নয়, কালচারভিত্তিক তো নই। যার ফলে মধ্যবিত্তের বড় অংশের চরিত্রই সুবিধাবাদী ও নীতিহীনতায় ভরা। যেমন এ মুহূর্তে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয় বিএনপির যুগ্ম সচিব সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হবার ঘটনা। সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হবার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া প্রয়োজন। কারণ, কোন রাষ্ট্রে এ ধরনের নিখোঁজ হবার ঘটনা কারোর জন্যই ভাল নয়। যেমন লাদেনকে হত্যা করলেও কিন্তু আমেরিকা প্রকাশ্যে করেছে। তাই যত খারাপ সিদ্ধান্ত হোক না কেন, সেটা প্রকাশ্যে হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্তের চরিত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আমরা সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ নিয়ে যত উদ্বেগ প্রকাশ করছি, যত মর্ম-বেদনা প্রকাশ করছি এর শতভাগের একভাগ উদ্বেগ ও মর্ম-বেদনা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পেট্রোলবোমায় নিহত বা আহতদের নিয়ে কিন্তু দেখা যায়নি। এর কারণ একটাই, পেট্রোলবোমায় যারা নিহত হচ্ছেন, আহত হচ্ছেন তারা অতি সাধারণ মানুষ। তারা খেটে-খাওয়া মানুষ, গার্মেন্টস কর্মী, ট্রাক ড্রাইভার, বাস ড্রাইভার ও হেলপার। তাই এদের মৃত্যু, এদের আকুতি আমাদের মিডিয়াকে, মধ্যবিত্তকে নাড়া দেয় না। সালাহউদ্দিনের স্ত্রীর মতোই বা তার থেকে বেশি কোন কোন ক্ষেত্রে যে অসহায় বাস বা ট্রাক ড্রাইভারের স্ত্রীর আর্তচিৎকার তা মধ্যবিত্তের মনে নাড়া দেয় না। এমনকি যে বিচারকদ্বয় সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ নিয়ে সরকারকে কারণ দর্শাতে বলেছেন, তাদের মনেও কিন্তু একটা দায়বোধের অভাব দেখা গেছে। তাঁরা কিন্তু সরকারকে বলেননি, যে লোকটির লাদেন স্টাইলের গায়েবি নির্দেশের ফলে ষাট দিনেরও বেশি সময় ধরে দেশে শত শত নিরীহ মানুষ মারা গেল, সরকার কেন আগেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি? কেন সরকার অনেক আগেই তাকে আটক করার চেষ্টা করেনি? এই যে শত শত নিরীহ, সাধারণ মানুষ নিহত হবার জন্যে ওই লোকটিও খালেদার পাশাপাশি দায় এড়াতে পারে না, তা বিচারক থেকে মধ্যবিত্তের কারোর মনকে স্পর্শ করে না। কারণ আমরা সকলেই তো একই শ্রেণীতে অবস্থান করছি। সাধারণ মানুষের দিকে তাকানোর হৃদয়ভিত্তিক কালচার আমাদের ভেতর জন্মায়নি। কেন জন্মায়নি সে অনেক বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। সে আলোচনাও এ কলামে সম্ভব নয়। শুধু একটি বাক্যে বলা যায়, সামরিক কালচার, সামরিক শাসনই মধ্যবিত্ত মনোজগত এভাবেই গড়ে দিয়েছে। কালচারবিহীন, লালসাপূর্ণ মনোজগত এমনই হবে। সেখানে কখনই হৃদয়বৃত্তি বড় হয়ে দেখা দেবে না। আর সেই মনোজগতই আমাদের মধ্যবিত্তকে পরিচালিত করছে। যেমন এই সমাজে, আমাদের মিডিয়াতে আমরা যে কোন মাটি থেকে উঠে আসা রাজনীতিককে খাটো করতে পারলে খুব আনন্দিত বোধ করি। নিজেকে একটা ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে জাহির করতে পেরে খুশি হই। কিন্তু যারা সামরিক সরকারের দালালি নয়, রাজনীতির ভেতর দিয়ে এসেছেন তাঁদের কোন কোন ক্ষেত্রে এখনও হৃদয়বৃত্তি আমাদের থেকে বড়। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, আমাদের মিডিয়াতে মন্ত্রী শাজাহান খান অনেক সমালোচিত ব্যক্তি। নানান কথা ও কাজের ভেতর দিয়ে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। কাজ করলে, ক্ষমতায় থাকলে এগুলো হয়। এ বড় কোন বিষয় নয়। যাহোক, সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হতে আমাদের তথাকথিত সর্বজ্ঞ চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে, তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম আপনি একজন মন্ত্রী হয়ে কেন খালেদার অফিসমুখী মিছিল-ঠিছিল এসব করছেন? আমার এ প্রশ্ন শুনে তাঁর মুখটা অনেকখানি কাতর হয়ে যায়, তিনি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেন, পেট্রোলবোমায় যে ড্রাইভার, হেলপাররা মারা যাচ্ছে, এই মানুষগুলোই আমাকে নেতা বানিয়েছে, মন্ত্রী বানিয়েছে, তাদের মৃত্যু আমি কিভাবে সহ্য করব? তাঁর কাতর কণ্ঠ ও ছল ছল চোখ দেখে অত্যন্ত লজ্জিত হই। বুঝতে পারি, আসলে আমরা তো সালাহউদ্দিন সাহেবকেই চিনি, ড্রাইভার হেলপারদের চিনি না। বেশিক্ষণ আর ওই অনুষ্ঠানে থাকিনি। একটু পানিও মুখে দিতে পারিনি। বের হয়ে এসে পথে চিন্তা করি, আসলে এই ড্রাইভার, হেলপার এমনি সাধারণ মানুষের মৃত্যু আমাদের হৃদয় ছোঁয় না। আমরা মধ্যবিত্ত, আমরা আসলে সুবিধাবাদী একটি আলাদা জীব। ঠিক মানুষ নই। মানুষের মতো দেখতেই শুধু! মানুষের মতো দেখতে এক ধরনের জীব বলেই কিন্তু গত ৭৬ দিন মিডিয়ায় এরা কত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পেট্রোলবোমা মেরে হত্যাকে আন্দোলন বলে গেছেন। কতভাবে যে তারা এই সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, বোমা মেরে হত্যাকে জায়েজ করেছেন। আর তারাই এখন নাগরিক সেজে সিটি নির্বাচনে ‘পেট্রোলবোমা মঞ্চ’ বানিয়ে নির্বাচন করতে যাচ্ছে। সত্যি, বিচিত্র এ সমাজ? বিচিত্র এ রাষ্ট্র? তা না হলে এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সিটি নির্বাচনে আনার জন্য সরকারেরও বা এত তাগিদ কেন? সরকারের কোন কোন মন্ত্রী কেন আগ বাড়িয়ে তাদের নির্বাচনে আসার জন্যে নানান কথা বলছেন? তাদেরও মনে রাখা উচিত, এখন তারা যেটা করছেন তা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ, কোন বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনীতি করছেন না। যাহোক, এই ‘পেট্রোলবোমা মঞ্চ’ আর বিএনপি যে নামেই সিটি নির্বাচনে আসুক না কেন, সরকারকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। কারণ, ২৬ মার্চেও তারা অবরোধ তোলেনি। যার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট প্রমাণ করে দিল তারা স্বাধীনতাবিরোধী একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী শক্তি এখন নতুন মোড়কে এসেছে। তাই এ সিটি নির্বাচনে যে কোন নামে অংশ নেবে কিন্তু তারা বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর জন্য। গত ৭৬ দিনে তাদের সব সন্ত্রাসী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় সিটিতে ঢুকতে পারেনি। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ছদ্মবেশে সারাদেশ থেকে তারা সন্ত্রাসীদের ঢাকায় নিয়ে আসবে। নির্বাচনের দিনে নির্বাচন সঠিক হচ্ছে না বা যে কোন অজুহাতে তারা তখন রাজধানীজুড়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে একটা চরম নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে। যেমনটি তারা করেছিল হেফাজতের নামে। তাই এই নির্বাচনের শুরু থেকে নির্বাচনের আগের দিন অবধি নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করার জন্য, নিয়মিত কম্বিং অপারেশন ঢাকা এবং চট্টগ্রামে সরকারকে করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও করতে হবে। তা না হলে যেমন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না তেমনি সিটি নির্বাচন করতে গিয়ে রাজধানী ও চট্টগ্রাম সিটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী আক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। যার সম্ভাবনা শতভাগ। কারণ ইবলিশ যে রূপ ধরুক না কেন, সে যদি সেইন্টের রূপও ধরে তাহলেও তাকে বিশ্বাস করতে নেই। [email protected]
×