ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

পঁচিশে মার্চ : বুদ্ধিজীবী হত্যার ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৫ মার্চ ২০১৫

পঁচিশে মার্চ : বুদ্ধিজীবী হত্যার ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে

পঁচিশে মার্চের (১৯৭১) কালরাত্রির দুঃসহ স্মৃতি এখনও আমাদের অনেকের মন থেকে মোছেনি। যে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিকসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী তাদের কোলাবরেটর জামায়াতীদের সহায়তায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। একই বছর ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামায়াতের বিভিন্ন গ্রুপ আলবদর, আলশামস ইত্যাদির দ্বারা আরেক দফা বুদ্ধিজীবী হত্যা চলে। ফলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ দেব, মুনীর চৌধুরী, সিরাজউদ্দীন হোসেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ অসংখ্য শহীদের নাম আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্থায়ীভাবে আসন নিয়েছে। এই হত্যাকা-ের চুয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আজ আবার সেই ২৫ মার্চ। এই হত্যাকা-ের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, এই হত্যাকা- এখনও বন্ধ হয়নি। ঘাতক সেই জামায়াত এবং তাদের মৌলবাদী সন্ত্রাসী উপদলগুলো। একাত্তরে পাকিস্তানের হানাদারেরা রাজপথে গণহত্যা চালিয়েছে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমিতে ধরে এনেছে তাদের কোলাবরেটর জামায়াতের দ্বারা সৃষ্ট রাজাকার ও আলবদরের দল। তেমনি বর্তমান বাংলাদেশেও পাকিস্তানের জান্তা-রাজনীতির অনুসারী বিএনপি চালাচ্ছে রাজপথে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস এবং পেট্রোলবোমা ছুড়ে নিরীহ মানুষ হত্যা আর জামায়াত এই গণহত্যারও সহযোগী এবং তাদের নৃশংসতা বুদ্ধিজীবী হত্যায়। গত চুয়াল্লিশ বছরে জামায়াত এবং মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে যত বুুদ্ধিজীবী ও মুক্তমনা মানুষ নিহত হয়েছে (হুমায়ুন আজাদ, রাজীব ও অভিজিত রায় পর্যন্ত) তাঁদের নামের তালিকা তৈরি করলে তাঁদের সংখ্যা একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। আমাকে ঢাকায় গণজাগরণ মঞ্চের এক তরুণ নেতা বলেছেন, “বর্তমান হাসিনা সরকার হয়ত পারবেন না অথবা সময় পাবেন না; কিন্তু আমরা নিশ্চিত, ভবিষ্যতে কোন সাহসী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে একাত্তরের হত্যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে যেসব বুদ্ধিজীবী ও সেক্যুলার রাজনৈতিক নেতা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি এবং মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের এমনকি বিএনপি’র সন্ত্রাসে রাস্তায় পুড়ে মরা মুটে মজুরদেরও শহীদ আখ্যা দেবেন। তাদের জন্য নতুন শহীদ স্তম্ভ তৈরি হবে এবং আজ যারা তাদের হত্যা করছে, তাদের যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা হবে।” আমি গণজাগরণ মঞ্চের এই তরুণ নেতাকে বলেছি, এই নতুন যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমানের নামও যুক্ত করা সঙ্গত হবে। নইলে এই তালিকা অসম্পূর্ণ থাকবে। ঢাকার আরেক তরুণ ব্লগার বন্ধু (নামটি তার অনুরোধেই গোপন রাখলাম) আমাকে জানিয়েছেন, ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত বুদ্ধিজীবী ও মুক্তমনা ব্লগার মৌলবাদী দানবদের হাতে নিহত হয়েছেন তিনি তাদের একটি তালিকা তৈরি করছেন। তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করছেন, ’৭১ সালের মার্চ ও ডিসেম্বর মাসে নিহত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দু’একজন জামায়াতপন্থীও আছেন। তিনি এর কারণটা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাকে আমি বলেছি, কারণটা অতি সহজ। প্রথমে পাকিস্তানী হানাদারেরা নিজেরাই বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়িত্বটা নিয়েছিল। বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকাটি তৈরি করে দিয়েছিল জামায়াত। পাকিস্তানী সৈন্যরা বুদ্ধিজীবীদের নাম-বিভ্রাটে দু’একজন জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে ফেলতেই জামায়াত নেতাদের টনক নড়ে। ফলে হানাদারদের অনুমতিক্রমে জামায়াতের ঘাতক বাহিনী রাজাকার, আলশামস, আলবদর ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীদের ধরে আনা ও তাদের হত্যায় দায়িত্ব নেয়। এ জন্যই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের বুদ্ধিজীবী হত্যার গোটা কা-টিই ঘটে জামায়াতী ঘাতকদের হাতে। তারাই বুদ্ধিজীবীদের ধরে বধ্যভূমিতে এনে হানাদারদের হাতে তুলে দেয় এবং নৃশংস হত্যাকা-ে অংশ নেয়। একাত্তরের মার্চ মাসের একটি ভুল জামায়াত এভাবে শুধরে নিয়েছিল। এই বছর ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদারেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসায় হানা দেয় এবং জামায়াতের দেয়া তালিকা অনুযায়ী শিক্ষকদের ধরে হত্যা করেছিল। হানাদারদের বর্বরতা এমন চরমে পৌঁছেছিল যে, তারা গভীর রাতে একজন অধ্যাপক বা বুদ্ধিজীবীকে ঘুম থেকে তুলে এনে তাকে দিয়ে তার কবর খোদাই করে এবং তারপরই তাকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে ওই কবরে লাশ ফেলে দেয়। এই সময় হানাদারেরা একটি ভুল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষককে হত্যা করার জন্য জামায়াত পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে নামের যে তালিকা দিয়েছিল তার মধ্যে একটা নাম ছিল ড. মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। একই সময়ে ড. মুনিরুজ্জামান নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক বিভাগের আরেক শিক্ষক ছিলেন, যিনি ছিলেন জামায়াতপন্থী। বাংলা বিভাগের ড. মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান ছিলেন প্রগতিশীল কবি ও সাহিত্যিক এবং জামায়াতের টার্গেট। কিন্তু হানাদারেরা ভুল করে তার বদলে জামায়াতপন্থী মুনিরুজ্জামানকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাকে হত্যা করে। জামায়াত নেতারা যখন ব্যাপারটা জানতে পারেন, তখন বহু বিলম্ব হয়ে গেছে। এরপর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। জামায়াতের এই ভূমিকা অদ্যাবধি বাংলাদেশে অব্যাহত রয়েছে। এখন বাংলাদেশে শাসক শক্তি পাকিস্তান নয়। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতের সঙ্গে নতুন গজিয়ে ওঠা হিযবুত তাহরীর থেকে জেএমবি পর্যন্ত সকল সন্ত্রাসী মৌলবাদী গ্রুপের পেছনেই পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মদদ রয়েছে। আফগান যুদ্ধের সময় বিরাটসংখ্যক তালেবান সদস্য ও সমর্থক পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল। তাদের সাহায্য নিয়ে জামায়াতীরা বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় জঙ্গী রিক্রুট ও ট্রেনিংদানের ঘাঁটি গড়ে তোলে। খালেদা জিয়ার সাবেক সরকার এই জঙ্গীদের দমন দূরের কথা, তাদের বেড়ে ওঠার কাজে প্রশ্রয় দিয়েছে। দু’বছর আগে মাদ্রাসা ছাত্রদের দিয়ে দেশে হেফাজতী অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা বিএনপির আরেকটি বড় কীর্তি। হালে বুদ্ধিজীবী, সেক্যুলারিস্ট রাজনৈতিক নেতা এবং মুক্তমনা তরুণ ব্লগারদের হত্যার ব্যাপারে জিগির তোলা হয়েছে এরা নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী ও ইসলামের অবমাননাকারী। এই মনুষ্যত্ববোধহীন সন্ত্রাসীদের লাস্ট নয়, লেটেস্ট শিকার অভিজিত রায় সম্পর্কে ঘাতকদের প্রচার, তার লেখায় ধর্মের অবমাননা ছিল। আমি মুক্তমনা এই তরুণের বহু লেখা পড়েছি। তিনি ধর্মান্ধতার বিরোধী ছিলেন, ধর্মের নয়। ধর্মের বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের সত্যের মধ্যে যে বিরোধ তিনি সেখানে বিজ্ঞানের সত্যকে সমর্থন করেছেন। এই মুক্ত আলোচনা সমাজ-প্রগতির জন্য অপরিহার্য। ধর্ম নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ধর্মের অবমাননা নয়। ইসলামও ধর্ম নিয়ে এই আলোচনা সমালোচনা সমর্থন করে। ইসলামের মহানবীও (দঃ) ধর্মীয় বিধিবিধানের যুগোপযোগী করার কথা বলে গেছেন। বার বার বলেছেন, ধর্মে জবরদস্তি নেই, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোর না। তাহলে ধর্মের নামে সিরিয়া থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত যে মানুষ হত্যা ( বেশিরভাগ মুসলমান) চলছে, তা কি ইসলামসম্মত? সম্প্রতি মক্কায় অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব ওলামা সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছে, সন্ত্রাসে ইসলামের অনুমোদন নেই। তাই যদি হয় তাহলে ইসলাম ও মহানবীর (দঃ) নাম ভাঙ্গিয়ে যারা মুসলমান হয়ে মুসলমান হত্যা করছে, তারা কিভাবে নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে? এরা কি মুসলমান না শয়তানের এজেন্ট? সম্ভবত এজন্যেই কিছু কিছু লোক বলেন, জামায়াতের নাম হওয়া উচিত ছিল জামায়াতে ইবলিশ (শয়তান সংঘ)। হুমায়ুন আজাদ থেকে অভিজিত রায় পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী ও তরুণ ব্লগারদের হত্যার ব্যাপারে ঘাতক শিবির থেকে বলা হয়, এরা ধর্মদ্রোহী ছিল এবং এদের লেখায় ধর্ম ও রসুলের (দঃ) অবমাননাকর মন্তব্য রয়েছে। আমি আগেই বলেছি, ধর্মের সমালোচনা ধর্মের অবমাননা নয়। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওলানা আবুল আলা মওদুদীর ধর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন বইতে কোরান হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এবং ইসলামের প্রথম যুগের চার খলিফার (নবীর সাহাবা) কারও কারও সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এমন সব মন্তব্য করা হয়েছে যা রীতিমতো ধর্ম ও নবীর সাহাবাদের অবমাননা বলে গণ্য করা যায়। কই, সেজন্যে মওলানা মওদুদীকে তো কোন জঙ্গী উপদল মুরতাদ আখ্যা দেয়নি। কিংবা তাকে কুপিয়ে মারার চেষ্টা করেনি। ১৯৭১ সালে মার্চ ও ডিসেম্বর মাসে যে সব বাঙালী বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। তাদের মধ্যে যারা বামপন্থী ছিলেন যেমন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখ তারাও ধর্ম ও মহানবীকে (দঃ) নিয়ে কোন আলোচনা করেননি, অবমাননাকর মন্তব্য করা তো দূরের কথা। জামায়াতের ঘাতক বাহিনী তাদের নির্মমভাবে হত্য করল কেন? পাকিস্তান বিরোধিতা এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্যই কি তাদের হত্যা করা হয়নি? ইসলাম রক্ষার নামে এই হত্যাকা- কি ইসলামসম্মত? দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ পর্যন্ত যে সন্ত্রাস ও বর্বর হত্যাকা- চলছে তা যে ইসলাম রক্ষার জন্য নয় বরং ইসলাম ধ্বংসের জন্য এই সত্যটাই আজ দিনের পর দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং পরবর্তী ২০১৫ সাল পর্যন্ত অভিজিত ও অসংখ্য বুদ্ধিজীবী এবং ব্লগার হত্যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ঘাতক দল ও তাদের চরিত্রও একই । বর্তমানে বাংলাদেশে এই হত্যা ও বর্বরতার লক্ষ্যের সঙ্গে বিএনপি একটি রাজনৈতিক মাত্রা যোগ করেছে মাত্র। একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দণ্ড যারা চান পরবর্তীকালের ঘাতক ও নতুন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও চূড়ান্ত শাস্তি তাদের দাবি করতে হবে। দেশের ছোট বড় সকল গণতান্ত্রিক দলকে আজ হোক আর কাল হোক এই দাবি তোলার কথাটি বিবেচনা করতে হবে। লন্ডন, ২৪ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৫
×