ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৩ লাখ কোটির বাজেট

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৩ মার্চ ২০১৫

৩ লাখ কোটির বাজেট

হামিদ-উজ-জামান মামুন /এম শাহজাহান ॥ আগামী অর্থবছরের (২০১৫-১৬) জন্য প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট আসছে। তবে এই আকার ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি থেকে ৩ লাখের মধ্যে থাকতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে; যা চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রয়েছে দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। তুলনামূলকভাবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ বাড়তে যাচ্ছে ৩৯ হাজার ৪৯৪ কোটি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকার মতো। এই আকারকে যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থ বলে মনে করছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। অন্যদিকে তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট হলে তা হবে উচ্চাভিলাষী এবং বাস্তবায়নযোগ্য হবে না বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট তৈরির আনুষ্ঠানিক মতামত নেয়া শুরু করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ উপলক্ষে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ১৪ মে পর্যন্ত সিরিজ বৈঠক করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আগামী অর্থবছরের বাজেট বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট বেশি হবে, এটি বলতে পারি। তবে কত বেশি হবে সেটি এখনও বলা যাচ্ছে না। কেননা, বাজেটের আকার এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক ধারায় দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমছে; চলতি বাজেটের যে বৈশিষ্ট্য আছে তার কারণেই এসব সুফল মিলছে। তাই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, যেটি পরীক্ষিত সত্য সেই ধারাই অব্যাহত থাকবে। আগামী বাজেটে খুব বেশি নতুন কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী অর্থবছরে যে বাজেটটি হতে যাচ্ছে তা যেমন হবে প্রবৃদ্ধিসহায়ক তেমনি তা মূল্যস্ফীতিকে সংযত রাখবে। জনগণ এতে তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গত কয়েকমাস ধরে চলা হরতাল, অবরোধ ও সহিংসতায় দেশীয় অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার একটা চেষ্টা থাকবে বাজেটে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) ধরা হতে পারে ৯০ হাজার কোটি টাকা এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দসহ প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে জানা গেছে; যা চলতি অর্থবছরে (২০১৪-১৫) স্বায়ত্তশাসিতসহ মোট ৮৬ হাজার কোটি টাকা ছিল। স্বায়ত্তশাসিত ছাড়া মূল এডিপি ছিল ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি এই এডিপি কমিয়ে এনে সংশোধিত এডিপি করা হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার। আগামী অর্থবছরে ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি থেকে ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের চীফ ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি অর্থবছরের আড়াই লাখ কোটি টাকার বাজেটেরই বাস্তবায়ন লক্ষ্য পূরণ করা যাচ্ছে না; সেখানে এত বড় বাজেট করা হলে তা উচ্চাভিলাষী হবে। তবে এ কথাও ঠিক যে, আগামী অর্থবছরে পে-কমিশন বাস্তবায়ন করা হলে সেজন্য টাকা লাগবে, রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা অব্যাহত রাখার চাপ থাকবে। তাছাড়া কর, এ্যাডভান্সড ইনকাম ট্যাক্সসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর কমাতে হতে পারে। তবে তেলের ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দিতে হয় আগামী বছর হয়ত এত লাগবে না। কারণ, তেলের দাম কমে গেছে। সবকিছু মিলে বলতে গেলে বলতে হয়, রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। রাজস্ব আদায়ের সমস্যা বিবেচনা করলে আড়াই লাখ কোটি টাকার বাজেটকে তিন লাখে উন্নীত করতে অর্থায়নই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য হতে পারে- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ পূরণে এগিয়ে যাওয়া, চলমান রাজস্ব বৃদ্ধি ও মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। সেই সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে জোরদার করা হবে রাজস্ব আহরণ। পাশাপাশি অব্যাহত থাকতে পারে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাজস্ব খাতের পরিসর বৃদ্ধির প্রচেষ্টা। আগামী অর্থবছরের বাজেট বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, যেভাবে গত ৫ বছর বাজেটের আকার বেড়েছে এবং সরকার বিনিয়োগ ব্যয় বাড়াতে চাচ্ছে সেক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরের বাজেট ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে তিন লাখ কোটি টাকার হলে এটি স্বাভাবিক হবে। কেননা, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৯ হাজার ৮০০কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, নানা সমস্যা থাকলেও গত অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে। কাজেই রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব তেমন পড়েনি। আগামী অর্থবছরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতি তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে চলছে। সে বিবেচনায় আগামী বাজেটের এই আকার বাস্তবসম্মত, বাস্তবায়নযোগ্য ও স্বাভাবিক, বরং এর চেয়ে কম হওয়া উচিত হবে না। সূত্র জানায়, আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত নেয়া শুরু করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ১৪ মে পর্যন্ত দেড় মাসব্যাপী সিরিজ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে বাজেট প্রণয়নের নীতিগত দিক সম্পর্কে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে প্রাক-বাজেট আলোচনা সভা করবেন অর্থমন্ত্রী। এই বৈঠকের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, এনজিও নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী, অর্থনীতি নিয়ে কাজ করে এ রকম সংগঠন, সকল মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সাংবাদিক, জাতীয় সংসদের চারটি স্থায়ী কমিটিসহ অন্যান্য প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করা হবে। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১ এপ্রিল কৃষি বাজেট, কৃষকের বাজেটের প্রস্তাব নিয়ে চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজের সঙ্গে বৈঠক করবেন অর্থমন্ত্রী। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই), ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সঙ্গে বৈঠক হবে ৫ এপ্রিল রবিবার। এনইসি সম্মেলন কক্ষে সকাল এগারোটায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ৭ এপ্রিল মঙ্গলবার এনইসি সম্মেলন কক্ষে এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেলা সাড়ে তিনটায় প্রাক-বাজেট বৈঠক অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীদের সঙ্গে এনইসি সম্মেলন কক্ষে বৈঠক হবে ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার। আগামী ২৬ এপ্রিল রবিবার সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম প্রতিনিধিদের সঙ্গে এনইসি সম্মেলন কক্ষে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ২৯ এপ্রিল বুধবার। জাতীয় সংসদের চারটি স্থায়ী কমিটি অর্থ মন্ত্রণালয়,পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ১০মে রবিবার। সকাল ১১ টায় বৈঠকটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ১১ মে সোমবার। এই প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে ১২ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬ টায় পদ্মায়। এছাড়া ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও সাংবাদিকবৃন্দের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ১৪মে বৃহস্পতিবার। বেলা সাড়ে ৩ টায় এনইসি সম্মেলন কক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এসব সংগঠন ও পেশাজীবীর মতামত ও প্রস্তাবনা বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়ন করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাতভিত্তিক দেশের বিভিন্ন এ্যাসোসিয়েশন এবং চেম্বার প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশের ৩৭৬টি এ্যাসোসিয়েশন এবং ৭৪টি চেম্বারের মতামত গ্রহণ করবে এনবিআর। মতবিনিময়ের পাশাপাশি এনবিআর ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও মতামত ও প্রস্তাবনা গ্রহণ করছে। এদিকে, বাজেট সামনে রেখে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকেও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে। সব সংগঠনের প্রস্তাব পাওয়ার পর তা এনবিআর চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দেবেন সংগঠনটির সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। চলমান হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি হিসাব নিরূপণ করেছে বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো। বাজেটে এই বিষয়টি নজরে আনার চেষ্টা করছে এফবিসিসিআই। শুধু তাই নয়, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট, ট্যাক্স ও শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ভ্যাট আইন সংশোধন বিষয়ে এফবিসিসিআই তাদের মতামত তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ভ্যাট আইনে কিছু সংশোধনী আনছে সরকার। যদিও এই আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, অভিন্ন ভ্যাট রেট করা হচ্ছে। ভ্যাট আইনে কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। এ কারণে বাজেটের আকারও বড় হচ্ছে প্রতিবছর। এই ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটও বড় হবে। তিনি বলেন, চলমান হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাই তাদের দাবির বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হবে। তবে বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আয় বাড়াতেও মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। এডিপি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকর লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এক প্রশ্নের জবাবে জনকণ্ঠকে বলেন, খাতা-কলমে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আকার বাড়িয়ে লাভ নেই। এক্ষেত্রে টাকার অঙ্কে আকার বাড়ার চেয়ে প্রকল্প সমাপ্ত করার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব বড় প্রকল্প রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে এডিপির আকার না বাড়িয়েও করা যায়। এগুলো প্রকল্পের কাজ শুরু করতে কিংবা বাস্তবায়ন কাজ অব্যাহত রাখতে খুব বেশি অর্থায়ন সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে। সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া দরকার।
×