ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুতুল নাচ আর কত দিন?

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৩ মার্চ ২০১৫

পুতুল নাচ আর কত দিন?

বার বার এই অকল্পনীয় না দেখা কিন্তু কল্পনায় দেখা অভিজিত ও বন্যার ওপর ঘাতক-জঙ্গীদের হামলার দৃশ্য এবং ঐ চত্বরে সে সময়ে উপস্থিত আধুনিক তরুণ-তরুণী, সংবাদকর্মী ও ৫-৭ জন পুলিশের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা চোখে ভেসে ওঠে! সে সঙ্গে উপস্থিত মানুষের অদ্ভুত এক নির্মম নীরবতা, তারুণ্যের পক্ষে অশোভনীয় নিষ্ক্রিয়তায় চরম হতাশ হয়ে পড়ি। মনে পড়ে গণজাগরণ মঞ্চের বড় জমায়েতগুলোর শেষদিকে একদিন কথা বলতে বলতে ওদের কয়েকজন সক্রিয় সদস্যকে বলেছিলাম, ‘এই সেøাগান ভাল, কিন্তু শুধু সেøাগান দিয়ে, ফেসবুকে কড়া মন্তব্য লিখে সশস্ত্র জঙ্গী খুনীদের প্রতিহত করা যায় না’। ওরা তা স্বীকারও করেছিল। কিন্তু তারপর জঙ্গীদের টার্গেট ব্লগার, প্রগতিশীল কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিকদের আত্মরক্ষায় এবং তাদের জঙ্গী হামলা থেকে রক্ষায় তরুণ-তরুণীরা কী কী করবে, তার একটি কর্মকৌশল তৈরি করা খুব দরকার ছিল। জঙ্গীরা ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করেছে, যা ফেসবুকে প্রকাশও পেয়েছে। তাহলে, প্রগতিশীল ব্লগাররা জঙ্গী-খুনীদেরও তালিকা তৈরি করবে না? তালিকাটি দেশের এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এবং গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তর করবে না? ব্লগারদের মধ্যে একটা গ্রুপ এই টার্গেটদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য একটি কর্মকৌশল তৈরি করে সব সময় সচেতন থেকে নিজেকে ও একই সঙ্গে অন্যদেরও জঙ্গী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষায় করণীয় ঠিক করবে না? এই আত্মরক্ষার অনেক নিয়মই কিন্তু গোয়েন্দা-পুলিশ বাহিনী আমাদের জানাতে সক্ষম। স্মরণ করা যাক, গণজাগরণ মঞ্চের সূচনা পর্বে ব্লগার রাজীবকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নির্বোধ ইংরেজী মাধ্যমে পড়া কয়েক তরুণ হত্যা করেছিল কিভাবে? রাজীব জঙ্গীদের হিটলিস্টে ছিল। তার পেছনে জঙ্গীরা তাকে নিশ্চয় কয়েকদিন অনুসরণ করে তার বাসা, গণজাগরণে আসা, অবস্থান করার সময়, বাসায় ফেরার যান ও সময় ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করেছে। তারপর খুব সহজে তাকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পেয়ে যায় ও সন্ধ্যার পরপরই খুন করে। বুয়েটের ছাত্র দীপকে দুপুরের নির্জন সময়ে জঙ্গী খুনী বুয়েট ছাত্র ডেকে নিয়ে হত্যা করতে যে হামলা করে তার ফলে সে চার-পাঁচ মাস পরও বাঁচতে পারে না, হাসপাতালে মারা যায়। তরুণদের বুঝতে হবে, তাদের আশেপাশে কে কী ধরনের রাজনীতিতে আসক্ত এবং জঙ্গীবাদে আসক্ত, জামায়াত-শিবির অনুসারী কেউ ডাকলে সে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে যাবে অথবা জানাবেÑ যাচ্ছে, কিন্তু না গিয়ে বন্ধুদের কাছে নিরাপদ স্থানে চলে যাবে, অবশ্যই নিজেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় চাপাতির কোপের কাছে সঁপে দেবে না। অথচ দুঃখের বিষয় আমাদের তরুণরা এই ভুলগুলো বার বার করছে। সাম্প্রতিক ঘটনাটি অভিজিত ও বন্যার ওপর জঙ্গী হামলায় অভিজিতের মৃত্যু, বন্যার আঙ্গুল হারিয়ে মাথায় চাপাতির কোপ নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার এবং অপরদিকে ঐ স্থানে উপস্থিত প্রায় শ’খানেক তরুণ-তরুণী, ৭-৮ জন পুলিশের ঐ দৃশ্য নীরবে অবলোকন, তাদের নিষ্ক্রিয়তা জনমানুষকে তাজ্জব ও একই সঙ্গে বিস্মিত করেছে। অভিজিত যেখানে হামলার শিকার হয়েছে, সেই টিএসসি চত্বরে বইমেলায় আগতরা ছাড়াও ওখানে সব দিনের মতো সেদিনও কমপক্ষে ৫০-৬০ জন তরুণ-তরুণী, সংবাদকর্মী, রিক্সা, সিএনজি চালক এবং অন্তত ৭-৮ জন পুলিশ উপস্থিত ছিল, তাহলে? রাজীব বা দীপের নিঃসঙ্গ চলাফেরা যদি ঘাতককে চরম সুযোগ দিয়ে থাকে, তাহলে এই তারুণ্যের ভিড়ের মধ্যে অভিজিত-বন্যার ওপর আক্রমণ হয় কেন, কিভাবে? একেবারেই সহায়তাহীন, নীরব শত দর্শকের মধ্যে কেন একজন হত্যার হুমকিপ্রাপ্ত ব্লগার অভিজিত, স্ত্রী বন্যা আক্রান্ত হয়ে খুন হয়ে যেতে পারে? এ কোন্ স্বার্থপর তারুণ্য? তারুণ্য সব সময় অন্যায়কে প্রতিরোধ করবে, প্রত্যাঘাত করবে। আক্রান্তকে বাঁচাতে মুহূর্তের মধ্যে দশ-বিশ তরুণ যদি সে মুহূর্তে ঘাতকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাহলে কি হামলাকারী দু’জন পালিয়ে যেতে পারত? একই সঙ্গে পুলিশ অন্তত ছুটে এসে তাদের কলার ধরে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারত না? দরকার হলে পায়ে রাইফেলের গুলিও করতে পারত যখন দেখাই যাচ্ছিল যে, খুনীরা খুন করছে এক তরুণকে ও তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে তরুণী স্ত্রী! আরও আশ্চর্য হই এই ভেবে যে, অভিজিতকে বাঁচাতে শুধু তারই আপনজন, আহত স্ত্রী লোকজনকে ডাকাডাকি করেও কোন সাহায্য কারও কাছ থেকে পায়নি। এ সময় আমাদের নীরব তারুণ্যকে উপহাস করে, পুলিশকে নীরব ভর্ৎসনা করে যে তরুণ ফটোসাংবাদিক এগিয়ে এলো, একা, তার নাম আশ্চর্যজনকভাবে জীবন, জীবন। জীবন যেভাবে একদম একা অভিজিত ও বন্যাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল, আজ এই নিষ্ক্রিয় তারুণ্যের ভিড়ে তাকে মনে হচ্ছে এক মহামানব! সেদিন সে মুহূর্তে জীবন যদি অন্য সংবাদকর্মীদের মতোই এই নির্মম ঘটনার শিকার দু’জনকে ফেলে রেখে শুধু ফটোগ্রাফ তুলে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলে যেত, তাহলে আজ বন্যাও যে প্রাণে বেঁচে থাকত না সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই বিরল সাহসের ও কর্তব্যের জন্য জীবনকে পুরস্কৃত করেছে আমাদের ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। কিন্তু এই অসামান্য মানবিক সাহসের ও বীরত্বের কাছে পুরস্কার অনেক তুচ্ছ, ছোট। তবু আমরা যারা কর্তব্য পালন করিনি সেদিন তাদের জন্য সামান্য মুখ রক্ষা বৈকি! অভিজিৎ ঘটনার নেপথ্য কাহিনীটি অনেক গভীর পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে। তথ্য সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেইদিন বুয়েটের এক শিক্ষক যার নামের শেষাংশ মোহাম্মদী, অভিজিতকে দাওয়াত করেছিল। আশ্চর্য এই যে, পুরো ঘটনা জানার আগে এই ‘মোহাম্মদী’ নামটি সাধারণ কাগজে পড়ে আমি বিচলিতবোধ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে দু’টো কথা মনে হয়েছিলÑ প্রথমত ‘মোহাম্মদী’ নামটি বাঙালী মুসলমানের নয়। দ্বিতীয়ত নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার খুনীর নাম ছিল মোহাম্মদী বেগ। সে অভিজিতকে চিনত, ‘দাদা’ সম্বোধন করে। কী কারণে সেদিন চায়ের দাওয়াত দিল সেই বইমেলায়, যেখানে অভিজিতের পরিচিতজনদেরও দাওয়াত দেয়ার কথা অভিজিতকে সে জানিয়েছিল, যারা অভিজিত হত্যাকাণ্ডের পরে জানায় যে, তাদের এই বুয়েট শিক্ষক এমন কোন চায়ের দাওয়াতে ডাকেনি। এটি কি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য নয় যে, অভিজিত-বন্যা যারা ঐ চা পানের দাওয়াতে তাদের বন্ধুরা আসবে বলে জানত, যারা শেষ পর্যন্ত আসেনি এবং তাদের আসলে দাওয়াত দেয়া হয়নি! কারা তাহলে সেখানে এসেছিল? অবশ্যই খুনীদের একটি দল, যারা অভিজিত-বন্যার পাশে পাশেই সর্বক্ষণ ছিল এবং নিশ্চয় টিএসসির কথিত ঐ চায়ের দোকান পর্যন্ত এসে প্রকৃত খুনীদের ইঙ্গিতে বা মোবাইলে অভিজিত যে হাতের নাগালে এসে পড়েছে সে খবরটি জানিয়েছিল। খুনীরা থলিতে চাপাতি এনেছিল। চাপাতি এতটা ধারালো ছিল যে, বন্যা অভিজিতের মাথায় হাত দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করার সময় তার হাতে যে কোপটি পড়ে সে কোপেই তার সে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কী নৃশংস ছিল এই খুনীরা, এ ঘটনা তাই প্রমাণ করে না! শোনা যায়, টিএসসি সংলগ্ন উল্টোদিকের ফুটপাথের অধিকাংশ চা দোকানি জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জীবন নামের অল্প বয়সী এই ত্রাণকর্তাকে পুলিশ একটি সিএনজি ধরে দিয়েও সাহায্য করেনি। সাহায্য করেছে যখন অভিজিত প্রায় মৃত, বন্যা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, জীবন আর কয়েকজনকে ডেকে এক সিএনজির যাত্রীকে নেমে যেতে অনুরোধ করে ঐ সিএনজিতে অভিজিত ও বন্যাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায়! কিছুতেই আমি ঐ দিন, ঐ চত্বরে উপস্থিত তরুণ-তরুণীদের কখনই ক্ষমা করতে পারব না! ঐ খুন হতে থাকা দুটি তরুণ-তরুণীকে নীরব দর্শক হয়ে দেখা, এমনকি মোবাইলে ছবি নেয়ার মতো অমানবিক আচরণ করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বুয়েট যে কী পরিমাণ জামায়াত-মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত তার প্রমাণ তো জনগণ পেয়েছে বিগত ২০১৩/১৪ সালে যখন বিএনপি-জামায়াত জঙ্গী নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে বুয়েটের জামায়াতী শিক্ষকরা যুক্তিহীন কর্মবিরতি পরিচালনা করছিল। অশিক্ষিতের বর্বর নেতৃত্ব যে শিক্ষিতরা মানে, জনগণ জানে তারা আসলে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট নিলেও, তাদের মন-বিবেক দাসত্ব মনোবৃত্তি দ্বারাই পরিচালিত। যে কোন মানুষ, সে নিরক্ষর হতে পারে, দরিদ্র হতে পারে, নিরন্ন, নির্ধন হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ তার বিবেক দাসত্বমুক্ত থাকে, ততক্ষণ সে কারও, হোক পৃথিবীর অধীশ্বর, রাজা বা সম্রাট, তাদের দাস হয় না। বুয়েটে ‘জঙ্গী উৎপাদন তো হয়ই, হয় দাস, ক্রীতদাসের চাষও। সুতরাং বর্তমান মাদ্রাসা থেকে বুয়েট বা নর্থসাউথ বা অনেক উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান খুব দূরে নেই, এ তো বলা বাহুল্য। একই সঙ্গে গোঁড়া ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত তেঁতুল হুজুরদের থেকে বুয়েট বা জঙ্গী উৎপাদক উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকের অনেকে কি খুব দূরে আছেন? এসব জঙ্গী উৎপাদন হ্রাসে সরকারের আশু কর্তব্য হলোÑ যুদ্ধাপরাধী জঙ্গী মৌলবাদীদের পালের গোদাদের বিচার ও দণ্ড দ্রুত কার্যকর করা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রধান শত্রুদের বিনাশ করা। ঐ জঙ্গী-মৌলবাদীদের দল জামায়াত, জামায়াত কর্তৃক জন্মদান করা, জঙ্গী উৎপাদনকারী শতাধিক মৌলবাদী দলকে দ্রুত নিষিদ্ধ করা। সাম্প্রতিক ২০১৫ সালের সূচনায় বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গী নেত্রী খালেদাকে পেট্রোলবোমা দিয়ে নিরীহ শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু হত্যার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করে দণ্ড দান করা। বলা বাহুল্য, খালেদা বিগত তিন-চার দশক ধরে এক ধরনের বিচারহীনতার সুবিধা ভোগ করছে, যা সম্ভব করেছে দেশীয় অপরাজনীতিক, দুর্বৃত্ত-ডাকাত ধর্মব্যবসায়ী যারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভয় পেয়ে খালেদাকে ‘ইসলামের রক্ষক’ (!) জ্ঞান করে। যারা ’৭১-এ বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী এবং এদেশের অনেক বিদেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতরা ও দেশের দু’টি প্রধান মিডিয়া হাউসও খালেদাকে এই ইমপিউনিটি দিতে কাজ করেছে। এরাই খালেদাকে ‘আপোসহীন’ নেত্রী বানিয়েছে। যার ফলে আইন-আদালত মানাকেও সে ‘আপোসহীনতা’র অন্তর্ভুক্ত করেছে। যারা তাকে একদিন জর্জেট-শিফনের ঘোমটা ও মেকআপ দিয়ে সাজিয়েছিল, তারাই আবার আজ তাকে ঘোমটা ফেলে, তাঁতের শাড়ি, কাঁধে আঁচল লুটানো সজ্জায় সাজিয়ে কী এক্সপেরিমেন্ট, কী অর্জনের জন্য করতে চাইছে, এখনও তা স্পষ্ট নয়। তবে খালেদা পুতুলের মতোই, তারেক আইএসআই, নব্য আইএস, দেশীয় মীরজাফরÑ সবার সুতোর টানেই ধ্বংসের নাচ নাচছে! যতদিন তার এই পুতুলনাচ চলবে, ততদিন বাঙালীর সুখ-শান্তি দূরঅস্ত। সবশেষে একটি অভিবাদন, যখন অভিবাদন জানানোর লোক শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ভাগ্যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ অজয় স্যারের পুত্র অভিজিতের মৃত্যুমঞ্চে তুমি উঠে এলে এবং একটি অসাধারণ মানবিক দায়িত্ব পালন করে একাই তারুণ্যকে আরেকবার জিতিয়ে দিলে। লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
×