ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থানাভিত্তিক সহিংসতার ছক ॥ র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গুলশানে বোমা হামলার আসামি ফাহিমের তথ্য

রাজধানীতে নাশকতার দায়িত্বে বিএনপির শতাধিক নেতা

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২২ মার্চ ২০১৫

রাজধানীতে নাশকতার দায়িত্বে বিএনপির শতাধিক নেতা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীতে থানাভিত্তিক নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা চলছে। প্রতিটি থানায় নাশকতা চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাও রয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে শতাধিক নেতা। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অধিকাংশই বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোর। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গুলশানে নৌমন্ত্রীর মিছিলে বোমা হামলা মামলার অন্যতম আসামি বিএনপিকর্মী রেজাউর রহমান ফাহিম গত বৃহস্পতিবার রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে চল্লিশটি বোমাসহ গ্রেফতারের পর র‌্যাবের গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই দিয়েছে। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে বিএনপি নেতার পরামর্শে আর টাকার লোভে বোমাবাজির মতো বেআইনী কাজে লিপ্ত হয় ফাহিম। বিএনপির বড় নেতা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ফাহিমকে বিপথগামী করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলিম নবী। যে ফাহিমের লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে মানুষকে আইনী সেবা দেয়ার কথা ছিল, সেই ফাহিমকেই এখন নষ্ট রাজনীতির শিকার হয়ে বোমাসহ গ্রেফতার হয়ে আইনী সেবা পেতে আইনজীবীদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, রেজাউর রহমান ফাহিমের (৩১) পিতার নাম ফজলুর রহমান (৭০)। তিন বোনের একমাত্র ভাই ফাহিম। এক বোন সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা। যিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচে কর্মরত। ফাহিম ১৯৮৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার আদমজী জুট মিলস সরকারী কোয়ার্টারে জন্মগ্রহণ করে। আদমজী হাই স্কুল থেকে ১৯৯৪ সালে পঞ্চম শ্রেণী ও একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করে। ২০০৩ সালে সরকারী বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএতে পড়াশোনা করে। ২০০৮ সালে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি (অনার্স) পাস করে। পিতামাতার সঙ্গে মিরপুর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৩৩৭ নম্বর ভাড়া বাসায় বসবাস করছিল। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে লক্ষ্যে ২০১২ সালে পটুয়াখালী জেলার বাসিন্দা এ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ-আল-মামুনের সঙ্গে আইন প্র্যাকটিস শুরু করে। আইন পেশার সূত্র ধরেই পরিচয় হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আব্দুল আলিম নবীর সঙ্গে। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। যদিও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনাকালে রাজনীতির সঙ্গে খানিকটা পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের সূত্র ধরে নবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। নবীর মদদে আর আর্থিক সহায়তায় ফাহিম রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নিজে ও ভাড়া করা লোকজন দিয়ে মাঝে মধ্যেই বোমাবাজি করছিল। বিএনপিতে ভাল পদ পাওয়ার লোভে পা দেয় ফাহিম। নবী ভবিষ্যতে ফাহিমকে বিএনপিতে ভাল পদ পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে বোমাবাজি করতে আগ্রহী করে তুলে। নবীর আশ্বাসে ফাহিম নিজে ও লোকজন ভাড়া করে গাড়ি ভাংচুর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা ও ককটেল নিক্ষেপ করে নাশকতা চালাতে থাকে। বোমাবাজ হিসেবে পেয়ে যায় মিজানকে (৪০)। গুলশানে নাশকতা চালাতে নবী গুলশান থানা যুবদল সভাপতি শাহীন ও সাধারণ সম্পাদক মামুন ও ফাহিমসহ ৮-৯ জন মিলে বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থিত এ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে বৈঠক করে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ধারাবাহিকভাবে নাশকতা চালানো অব্যাহত থাকবে। এমন সিদ্ধান্তের পরই গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গুলশান-২ নম্বরে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন পেশাজীবীদের মিছিলে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় অন্তত ১৩ জন আহত হয়। হামলার অপারেশনাল দায়িত্ব ছিল গুলশান থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মামুনের। মামুনের নির্দেশে ফাহিম, তার বন্ধু রানা, শরীফুদ্দিন ও জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন হামলা চালায়। হামলার পর ফাহিম গত ২১ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার এড়াতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আত্মগোপন করে। র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্র ফাহিমের বরাত দিয়ে জানায়, ঢাকার ৪৯টি থানায় শতাধিক নেতা রয়েছে নাশকতা চালানোর দায়িত্বে। গুলশান এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা উত্তরের যুগ্মআহ্বায়ক সোহাগ ও মামুন রয়েছে নাশকতা চালানোর দায়িত্বে। নাশকতা চালানোর বিষয়ে ও বোমা, যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা হামলা ও ককটেল হামলার বিষয়ে সাঙ্কেতিক ভাষায় মোবাইল ফোনে ও বৈঠকে আলাপ আলোচনা হয়ে থাকে। গাড়িতে আগুন দেয়া বুঝাতে লাইটিং শব্দটি ব্যবহার করা হয়। গত ৫ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিপ্লব নামের এক বোমাবাজ বহু গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা ও ককটেল হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে গুলশান থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মামুনের নির্দেশে। বিপ্লবের সঙ্গে ফাহিমের অন্তত ২০-২৫ বার নাশকতা সংক্রান্ত বিষয়াদি ছাড়াও টাকা পয়সার বিষয়ে কথোপকথন হয়েছে। নবীর নির্দেশেই গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানম-ি ল্যাবএইড হাসপাতাল এলাকায় চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ফাহিম এ সময় তানিম নামের এক বোমাবাজের নামও প্রকাশ করেছে। তানিম বিএনপির কর্মী। তানিমের কাজ হচ্ছে চার্জ দেয়া মাল (শক্তিশালী ককটেল) মজুদ রাখা। প্রতি গাড়িতে দিলে তিন হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হতো। গত ৫ জানুয়ারি দেশব্যাপী টানা অবরোধের ডাক দেয়ার দিন নবীর দলের সদস্যরা শিবিরের সঙ্গে যৌথভাবে বহু গাড়ি ভাংচুর করে। এমন নাশকতামূলক পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় মহাখালী এলাকায় কয়েকটি পেট্রোল পাম্পে আগুন লাগানোর দায়িত্ব নিয়েছে ছাত্রদল নেতা জুয়েল। ফাহিমের সঙ্গে গুলশান-১ এলাকার লিটন, কুড়িল বস্তির লিটন ও তিতুমীর কলেজের ছাত্র ফকির রিপন এবং ওই কলেজের ছাত্রদলের জিএস আনোয়ারের সঙ্গেও ককটেল ফাটানো এবং গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের বিষয়ে ছদ্মনামে কথোপকথন হতো। প্রসঙ্গত, গত ২৩ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা মেরে ৩১ যাত্রীকে দগ্ধ করার ঘটনায় শহীদুল্লাহ ও পারভেজ নামে দুই আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে হামলার সঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা নবীউল্লাহ নবী, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলসহ বেশ কয়েকজন জড়িত বলে জানায়। উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বনানী ছাত্রশিবিরের বোমা তৈরির একটি কারখানা থেকে ১৩০ শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা তৈরির জন্য মজুদ রাখা দুই লিটার পেট্রোল, ১০ কেজি পাথরের কুচি, এক কেজি গানপাউডার, জিহাদী বই ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের নামীয় তালিকাসহ বনানী থানা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানসহ (২৩) ৫ জন গ্রেফতার হয়। পর দিন লালবাগ থানাধীন ঢাকেশ্বরী এলাকার ৩১ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বোমা তৈরির সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিউমার্কেট থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বাপ্পীর হাতের কব্জি উড়ে যায়। আহত হয় তিনজন। পরবর্তীতে আহত অবস্থায় ছাত্রদল নেতার মৃত্যু হয়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগের ভাগলপুর লেনের ১৩৬ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে নিহত হয় এক ছাত্রদল কর্মী। আহত হয় হাজারীবাগ থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু হোসেন (২৫) ও তার ভাই জিসান (২০)। পুলিশ বাড়ি থেকে তাজা বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে। গত বৃহস্পতিবার আবারও চল্লিশটি বোমাসহ গ্রেফতার হয় ফাহিম নামের এক বিএনপিকর্মী। এ ব্যাপারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে জানান, ফাহিমসহ গ্রেফতারকৃত বোমাবাজদের তথ্য মোতাবেক নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযান চলছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে এবং গ্রেফতারকৃত বোমাবাজদের দেয়া তথ্য মোতাবেক নাশকতাকারী, তাদের অর্থ, মদদ, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে।
×