ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কর্মসূচী অব্যাহত রাখায় সিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা বেকায়দায়

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২২ মার্চ ২০১৫

কর্মসূচী অব্যাহত রাখায় সিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা বেকায়দায়

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও আসন্ন ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে অংশ নিতে আগ্রহী দলের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ভেতরে ভেতরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার না করায় তাঁরা প্রচার চালাতে পারছেন না। এ কারণে তাঁরা দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ। তবে মেয়র প্রার্থীরা দলের বড় বড় পদে থাকায় প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও কাউন্সিলর প্রার্থীরা দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি বেশি ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করায় কাউন্সিলর প্রার্থী হতে চায় বিএনপির এমন নেতাকর্মীরা দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, চলমান আন্দোলন কর্মসূচীর কারণে বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর নজরদারি থাকায় দলে সক্রিয় অধিকাংশ নেতাকর্মীই এখন আত্মগোপনে রয়েছে। এ কারণে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি উপেক্ষা করে নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারছেন না তারা। দ্বিতীয়ত, কেউ নির্বাচনী প্রচার চালাতে গেলেও আন্দোলনের নামে নাশকতায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় সাধারণ ভোটারদের কাছে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ কারণে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে চরম বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে তাদের। তাই কাউন্সিলর প্রার্থী হতে চায় বিএনপির এমন নেতাকর্মীরা দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচন করতে চান এবং বর্তমানে সংশ্লিষ্ট থানা বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, আমি আগেও এ এলাকা থেকে ২ বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। তাই এবারও নির্বাচন করতে চাই। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় হাইকমান্ড চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার করবে। কিন্তু তা না করায় আমরা যারা নির্বাচন করতে চাই আমাদের সমস্যার মুখে ফেলা হয়েছে। একদিকে কৌশলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। এ কারণে নির্বাচনী প্রচার চালাতে সমস্যা হচ্ছে। অপরদিকে দলের টানা আন্দোলন কর্মসূচীর কারণে সাধারণ মানুষের কাছেও বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রশ্নের জবাবে খুশি হতে না পেরে কেউ কেউ বিরক্তি বোধ করছে। ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা বিব্রতকর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে নির্বাচন করতে চান এবং সংশ্লিষ্ট থানা বিএনপির কমিটিতে আছেন এমন এক নেতা বলেন, আন্দোলন শুরুর পর থেকেই নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারি না। কখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক এসে ধরে নিয়ে যায় সারাক্ষণ এ ভয়ে থাকতে হয়। আর মাঝেমধ্যে চুপেচাপে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেও তারা বর্তমান আন্দোলন কর্মসূচী সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকা থেকে ২০০২ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত সাবেক একজন কাউন্সিলর এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কথা প্রসঙ্গে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টানা হরতাল-অবরোধ দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যে ভুল করেছে তার খেসারত দলটিকে অনেক দিন ধরে দিতে হবে। প্রথমেই খেসারত দিতে হবে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। তিনি বলেন, আগের নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার আগেই বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা এলাকায় প্রচারণা জোরদার করেছেন। এবার নিজেদের ডাকা নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচীর কারণে নিজেরাই ঘরে থাকতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে তারা কিভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে? ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা তৎপর হয়ে পড়ে। কিন্তু বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগ্রহ দেখালেও এখনও তৎপরতা জোরদার করতে পারছে না। দলের নেতাকর্মীসহ দেশের মানুষ ভেবে ছিল বিএনপি হয়ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার করবে। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বললেও টানা অবরোধের মধ্যেই শনিবার আবারও নতুন করে ৭২ ঘণ্টা হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আজ রবিবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে এ হরতাল চলবে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত। এ হরতাল আরও ৪৮ ঘণ্টা বাড়িয়ে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। কিন্তু বিএনপির অনেক নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও হরতালের বিষয়টিকে ভালভাবে নেয়নি। এর প্রভাব নির্বাচনের ওপর পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এদিকে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই সরকারী দল আওয়ামী লীগ মেয়র পদে প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলেছে। দলটি ঢাকা উত্তরে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক ও ঢাকা দক্ষিণে দলের মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে দলীয় সব মেয়র প্রার্থীদের একসঙ্গে বসিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাসির উদ্দিনকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনের অনেক আগেই প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু ২৮ এপ্রিল নির্বাচন হচ্ছে বিদায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রচারণায় খুব বেশিদিন সময় পাচ্ছে না। তাই দলের অনেক নেতাকর্মী বিএনপি হাইকমান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছে। জানা যায়, বিএনপি এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও ভেতরে ভেতরে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ঠিক করতে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নজরদারি কিছুটা শিথিল করে প্রচারণায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয় কি না তাও দেখতে চাচ্ছে দলীয় হাইকমান্ড। তবে ইতিমধ্যেই বিএনপি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বর্তমান মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মঞ্জুর আলমকে প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন নির্বাচন করবেন এ ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস এবং ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আবদুস সালামও মেয়র পদে নির্বাচন করতে চান। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ বিষয়টি নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত হবে। এর পর মিডিয়াসহ সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। উল্লেখ্য, ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ঢাকা মহানগর বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা মেয়র নির্বাচিত হন। যদিও সে নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন। কারণ আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। সেবার ৯০টি ওয়ার্ডের মধ্যে কমিশনার পদে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হন। সেবার দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই মেয়র ও কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী দিয়েছিল বিএনপি। ২০০৭ সালে সাদেক হোসেন খোকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নির্বাচন না হওয়ায় ২০১১ সাল পর্যন্ত খোকাই মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের নবেম্বর মাসে সরকার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে ২ ভাগে ভাগ করে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন করে। সেই সঙ্গে সাদেক হোসেন খোকাকে সিটি মেয়রের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ২ সিটি কর্পোরেশনে ২ জন প্রশাসক নিয়োগ করে। সেই থেকে ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে করা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সদর দফতর থেকে যায় পুরনো নগর ভবনে। আর ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে করা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সদর দফতর নিয়ে যাওয়া হয় বনানীতে। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ১৭ জুন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে বিএনপির প্রার্থী মঞ্জুর আলম বিজয়ী হন। মঞ্জুর আলমের রাজনীতিতে উত্থান মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে। মহিউদ্দিন চৌধুরী ২ বার মেয়র থাকাকালে মঞ্জুর আলম কমিশনার ছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের কারণে মঞ্জুর আলম মেয়র পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া সত্ত্বেও নিজ দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে তিনি বিএনপি থেকে মনোনয়ন নেন। নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে বিএনপিতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মঞ্জুর আলমকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর কারণে এবার চট্টগ্রামে মেয়র প্রার্থী মঞ্জুর আলমসহ বিএনপি দলীয় ক’জন কাউন্সিলর প্রার্থীও দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
×