ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট জরে কাঁপছে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৯ মার্চ ২০১৫

ক্রিকেট জরে কাঁপছে দেশ

কাওসার রহমান ॥ এই পত্রিকা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এমসিজিতে শুরু হয়ে যাবে বাংলাদেশ-ভারত প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ক্রিকেট যুদ্ধ ঘিরেই দু’দেশের মধ্যে উদ্দীপনা তুঙ্গে। মেলবোর্ন থেকে ঢাকা হয়ে সেই উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়েছে সারাবাংলায়। দেশের সর্বত্রই ক্রিটেকমোদীদের মধ্যে সেই উৎসাহের আঁচ। মাশরফি, রুবেল, সাকিব, মাহমুদুল্লাহদের নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। কোয়ার্টার ফাইনাল সামনে রেখে গোটা দেশটাই এখন ক্রিকেট-জ্বরে কাঁপছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের উদ্যোক্তা ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে এবারের মতো এত উচ্ছ্বাস সেবারও দেখা যায়নি। এটি এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ডে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল সামনে রেখে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে জাতীয় পতাকা বিক্রি। রাস্তাঘাট-অফিস-বাজার সর্বত্র ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। যারা কাজের জন্য টিভির সামনে বসতে পারছেন না, তারা বাড়িতে ফোন করে বা বন্ধুদের কাছ থেকে খেলার প্রতি মুহূর্তের আপডেট নিচ্ছেন। নেট সার্চ করেও খেলার স্কোরটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। কোন খেলাকে কেন্দ্র করে এত আবেগ অতীতে দেশে কখনও দেখা যায়নি। এমনিতেই বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ-হরতালে জনজীবন বীতশ্রদ্ধ। গণতান্ত্রিক এ কর্মসূচীটি ইতোমধ্যে তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। বরং এখন হরতালের দিনে রাজধানীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের খেলার দিনে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে। দেশের খেলা যেদিন থাকছে, সেদিন রাজনীতি ভুলে মানুষ বসে পড়ছেন টিভির সামনে। ম্যাচের সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তাঘাটও হয়ে পড়ছে সুনসান। কোয়ার্টার ফাইনালে দেশের সাফল্য কামনা করে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে বিশেষ নামাজ-দোয়াপাঠ-মানত। বিশ্বকাপের খেলাগুলোই এখন মানুষের বিনোদনের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বারই প্রথম বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ প্রতিবেশী দেশ ভারত। ধারে-ভারে অনেকটাই এগিয়ে ভারতীয় টিম। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশীরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, ভারতকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠার। তাদের কথায়, ‘গ্রুপ লীগে ইংল্যান্ডের মতো দলকে আমরা হারিয়েছি। কোয়ার্টার ফাইনালের কোন দলই ছোট নয়। ফলে দল যদি নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারে, তা হলে না জেতার কোন কারণ নেই।’ কোয়ার্টার ফাইনাল সামনে রেখে গোটা দেশটাই এখন ক্রিকেট-জ্বরে কাঁপছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের উদ্যোক্তা ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে এবারের মতো এত উচ্ছ্বাস সেবারও দেখা যায়নি। নিজের দেশ বলে কথা। ভারত-পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক থেকে শুরু করে শচীন-সৌরভের ভক্তরাও এখন নিজ দেশের ক্রিকেট বন্দনায় ব্যস্ত। বুধবার প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার করুণ পরাজয়ের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে আলোচনায় আরও গতি পেয়েছে। দিনভর রাস্তা-ঘাটে, অফিস-আদালতে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আড্ডা আর আলোচনার একমাত্র বিষয় ছিল বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। এদিন নানান গুজবও ঢাকার বাতাসে উড়েছে। দুই প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব নষ্ট করার জন্যই কট্টর জাতীয়তাবাদীরা এসব গুজব ছড়িয়েছে। তবে এসব গুজন খুব একটা ডালপালা মেলেনি। এদেশের বেশির ভাগ মানুষই ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সমর্থক। এ দুটি দেশের খেলা হলে কোন কথা নেই। যেন ঝা-া নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ে। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে যেহেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা, তাই এখন ওরা আর কোন যুক্তি-তর্কের ধার ধারছেন না। সকলে এককাট্টা হয়ে নিজ দেশের সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছেন। দেশে ক্রিকেট নিয়ে মেয়েদের উদ্দীপনা দিন দিন বাড়ছে। তাদের বক্তব্য হলো, ‘অতীতে ক্রিকেট নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। এবার সবাই দেখছি ক্রিকেটে মেতে উঠেছে। তাই দেশের প্রতিটি খেলা দেখেছি। আশা করছি, সেমিফাইনালে যেতে পারব। হৃদয় বলছে, বাংলাদেশ পারবে।’ তবে বুধবারের ক্রিকেটীয় আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে ২০০৭ সালে ক্যারিবিয়ান বিশ্বকাপের স্মৃতি। সেই স্মৃতি তুলে ধরেই বাংলাদেশীদের উচ্ছ্বাস, ‘এমনটা নয় যে আমরা বিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে পারেনি। ২০০৭ সালে শক্তিশালী ভারত টিমকে আমরা হারিয়ে ছিলাম। এবার আমাদের টিম যা খেলছে, তাতে আমরা দারুণ আশাবাদী। টিমের সকলে যদি নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী খেলতে পারে, তাহলে সেমিফাইনালে না যাওয়ার কারণ নেই।’ এই উৎসাহীরা শুধু কোয়ার্টার ফাইনালই নয়, সেমিফাইনাল এমনকী ফাইনালে যাওয়ারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এ স্বপ্নের পেছনে কাজ করছে আট বছর আগের সেই স্মৃতি। ঠিক আট বছর আগে ২০০৭ সালের ১৭ মার্চের সন্ধ্যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচ। দারুণ আগ্রহ নিয়ে বাড়ির টিভিতে সবাই বাংলাদেশ ম্যাচটা দেখছে। টস জিতে যখন ভারত আগে ব্যাট করতে নামল, তখনও কেউ বুঝতে পারেনি কী বিপর্যয় অপেক্ষা করে আছে ভারতের ক্রিকেটের জন্য। বাংলাদেশের পর শ্রীলঙ্কার কাছেও ভারতের হার। ওই দুটি হার নিয়েই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়েছিল ভারত। তবে বৃহস্পতিবারের কোয়ার্টার ফাইনালের অবস্থায় আট বছর আগেকার ওই ম্যাচের ভারতীয় টিম নেই। ওটা ছিল সেবারের বিশ্বকাপে শচীন-সৌরভদের প্রথম ম্যাচ। আর কোয়ার্টার ফাইনালে বিশ্বকাপের সাত নম্বর ম্যাচ খেলতে নামছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিরা। তা-ও আবার পরপর ছয় ম্যাচ জিতে এসেছে। বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের টুর্নামেন্টে অপরাজেয় থেকে। এদের কাছে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ সামলে দেয়া কোন সমস্যাই নয়। কিন্তু বাংলাদেশও যে খারাপ টিম নয় সেটিও মানছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ বেশ ভাল। মাহমুদুল্লাহ পরপর দুই সেঞ্চুরি করে দুর্দান্ত ফর্মে আছে। তার উপর বাংলাদেশের বোলিংটাও খারাপ না। বিশেষ করে ইনিংসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ দ্রুত উইকেট ফেলে দিতে পারে। তাছাড়া টিমের মধ্যে দারুণ আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। ইংল্যান্ডের মতো টিমকে হারানো, ঘরের মাঠে অন্যতম ফেবারিট নিউজিল্যান্ডকে কোণঠাসা করে ফেলা, তিন শ’র কাছাকাছি রান তুলে দেয়া দারুণ ছন্দে আছে মাশরফির টিম। আর বাংলাদেশও এখন অনেক ওয়ান ডে খেলে খেলে যথেষ্ট অভিজ্ঞও। স্মার্ট ক্রিকেট খেলতে পারে তরুণ এই দলটি। তবে বৃহস্পতিবারের খেলার ফল যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ যে ভারতের মতো অভিজ্ঞ এবং দুই বিশ্বকাপ জেতা দলকে দারুণ চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে সেটাই বার বার আলোচিত হচ্ছে। তাই তো ভারতীয় ক্রিকেট গ্রেটরা বার বার বলছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে সতর্ক থাকতে। বিপক্ষ টিমকে হালকাভাবে না নিয়ে নিজেদের এক শ’ শতাংশটাই দিতে। বৃহস্পতিবারের কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়ে ধোনিরা যাকে একদম আত্মতুষ্টিতে না ভুগে। কারণ ২০০৭ বিশ্বকাপের ওই ম্যাচটায় কিন্তু ধোনিও খেলেছিল। সেই স্মৃতি যেন তারা ভুলে না যায়। কিন্তু যতই ভারতীয় ক্রিকেট গ্রেটরা নিজ দলকে আত্মতুষ্টিতে না ভোগার পরামর্শ দেন, তারা কিন্তু হলফ করে বলতে পারছেন না বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারত জিতবে। কারণ নকআউট ম্যাচে এক-আধ ঘণ্টাই ম্যাচের রং বদলে দিতে পারে। সেটা কোহলির কয়েকটা স্ট্রোক যেমন হতে পারে। তেমন হতে পারে রুবেলের একটা স্পেলও। তাই এসব ম্যাচে আগাম কেউ কিছু বলছেন না। তবে বাংলাদেশের সুবিধা হলো এই দলটা অনেক পরিপূর্ণ। বড় কিছু ম্যাচ জিতেছেও। আর বিশেষ করে এই টুর্নামেন্টে যেমন খেলছে, তাতে প্রমাণ হয়েছে যে, বাংলাদেশ কারও দয়ায় এখানে আসেনি।
×