ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘কলিং’ বা ‘দাওয়াতে’ আর যাবেন না সংবাদকর্মীরা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ মার্চ ২০১৫

‘কলিং’ বা ‘দাওয়াতে’ আর যাবেন না সংবাদকর্মীরা

বাংলানিউজ ॥ সাংবাদিকরা এর দুটি নাম দিয়েছেন ‘কলিং’ আর ‘দাওয়াত’। শিবিরের ডাক পেলে ‘দাওয়াত’ আর বিএনপি ডাকলে ‘কলিং’। কলিং বা দাওয়াত যে নামেই ডাকা হোক, আজকাল এতে বেশ সাড়া দিচ্ছেন সাংবাদিকরা। সুবিধা হচ্ছে- এইসব ডাক থেকেই মিডিয়াগুলো বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পেয়ে যাচ্ছে তাজা ফুটেজ, এ্যাকশন ছবি, আর ককটেল ফোটানো, আগুন জ্বালানোর তরতাজা খবর। যা আবার ব্রেকিং, সদ্য পাওয়া, এইমাত্র পাওয়া এমন নানা নাম দিয়ে প্রকাশ, প্রচার করছে। এই প্রচার করতে পারায় বাহবা আছে। যেই ফটোসাংবাদিক কিংবা ভিডিও ক্যামেরাম্যান সবচেয়ে তাজা ছবিটি বা ফুটেজটি পেলেন তাঁর কদর নিউজরুমে থাকেই। অপর সুবিধাটি হচ্ছে- যারা এই ‘কলিং’ বা ‘দাওয়াত’ দিয়ে সাংবাদিকদের ডেকে আনছে তারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারছে হরতালের ভীতি। ঢাকায় একটি/দুটি ককটেল ফুটিয়ে, কিংবা একটি গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে তারা সারাদেশের গাড়িচালকদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে- গাড়ি বের হলেই জ্বলবে। রাস্তায় বের হলেই শিকার হতে হবে ককটেল হামলার। অতএব সাবধান। ঘরে থাকো... হরতাল সফল কর। দিনভর এমন ককটেল আর আগুনের ঘটনা ঘটিয়ে দেশজুড়ে ভীতি ছড়ানোর পর বিকেলে কড়া মাড়ের ইস্ত্রি করা কড়কড়ে শার্ট কিংবা পাঞ্জাবি পরে ডজন ডজন টেলিভিশন আর নানা মিডিয়ার কর্মীদের সামনে নেতার দাম্ভিক উচ্চারণ দেশজুড়ে অভ্যুত্থান ঘটেছে, দেশজুড়ে সফল হরতাল। বাহ বেশ! কি অদ্ভুত ও যথেচ্ছ ব্যবহার মিডিয়ার! দুই-তিনটি তাজা ফুটেজ আর ছবি, এক-দুটি ব্রেকিং নিউজের আশায় কিভাবে ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছি আমরা সাংবাদিকরা! এর মধ্য দিয়ে আমরা জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছি মানবিক মূল্যবোধ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, সাংবাদিকতার নীতিমালা আর সর্বোপরি নীতি নৈতিকতা। ‘কলিং’ আর ‘দাওয়াত’র বিষয়টি এখন হরতালের মাঠে মিডিয়া কর্মীদের জটলায় সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। আগেই বলেছি, বিএনপি ডাকলে ‘কলিং’ আর জামায়াত-শিবির ডাকলে ‘দাওয়াত’। এই দাওয়াতে সাড়া দিয়ে চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান, অন্যান্য মিডিয়ার ফটোসাংবাদিক আগে-ভাগেই পৌঁছে যায় কোন ঘটনাস্থলে। সেখানে একটু পরেই জ্বালানো হয় কোন গাড়িতে আগুন। কিংবা, একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয় ত্রাস। আর তাজা ফুটেজ ধারণ হয় উপস্থিত সকলের ক্যামেরায়। এখানে সাংবাদিক ব্যবহৃত হয় দাওয়াতদাতার ইচ্ছামাফিক। আর সেকারণেই ফুটেজে কে ককটেল ফাটাচ্ছে তার ছবি থাকে না, ক্যামেরা তাক করা থাকে যেখানে ককটেল ফুটছে সেখানে। দাউদাউ আগুন জ্বলছে এমন ফুটেজ থাকে, কিন্তু কে বা কারা আগুন জ্বালিয়ে গেল তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আকুতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ছবি নয়, যারা সন্ত্রাস করছে তাদের ছবি তুলুন। এতে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হবে। কে ব্যবস্থা নেবে? পুলিশ! কিভাবে সম্ভব। পুলিশ নিজেই তো কনফিউজড। দাওয়াতে সাড়া দেয়া একজন ফটো সাংবাদিকের স্বীকারোক্তি শুনুন- নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলছেন, “একদিন দাওয়াতে গুলিস্তান গেলাম। সেখানে বাস পোড়ানো হবে। ক্যামেরা হাতে নয়, ব্যাগে। ঘুরছি। পুলিশ এসে পরিচয় জানতে চাইল। বললাম ফটো সাংবাদিক। জানতে চাইল ক্যামেরা কোথায়। বললাম সিভিলে আছি। সাংবাদিক সিভিলে! পুলিশ তো কনফিউজড। কিছু না বলেই চলে গেল।” বা মাঠে পুলিশকেও কনফিউজড করে দিচ্ছে সাংবাদিক। শোনা যাচ্ছে, পুলিশ এখন সেদিকে ছোটে যেদিকে সাংবাদিকরা যাচ্ছে। কারণ তারা ধরে নিচ্ছে সাংবাদিকরা যেখানে যাবে সেখানে কোন ঘটনা ঘটতে পারে। এরই মধ্যে ডিএমপি থেকে নোটিসও জারি করা হয়েছে, যেখানে সংবাদকর্মীদের জটলা দেখা যাবে সেখান থেকে যেন দূরে থাকে সাধারণ মানুষ। ডিএমপি জেনে গেছে, আগাম ‘দাওয়াত’ বা ‘কলিং’-এ সাংবাদিকরা জড়ো হলেই ধরে নিতে হবে তাদের কাছে সহিংসতার তথ্য আছে। এই কাজগুলো আর যাই হোক সাংবাদিকতা হতে পারে না। সাংবাদিকতার এতটা নিচু স্তরের ভূমিকা আর কোনকালে কোথাও ছিল না। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা তার ‘মহান পেশা’ নামটি হারাচ্ছে। কিভাবে ‘কলিং’ বা ‘দাওয়াত’ আসে তা এখন সবার জানা। বিএনপি বা হালে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগও সাংবাদিকদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তারা টেক্সট মেসেজে অথবা টেলিফোন করে বাছাই করা সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন কোথায় হামলা, ভাংচুর বা প্রতিরোধ হবে। একজন খবর পেলে, তাজা খবর/ফুটেজ/ছবির আশায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া সাংবাদিক দল ঘটনা ঘটার আগেই হাজির হয়ে যাচ্ছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগের ধরনটা এখনও সেকেলে। এক্ষেত্রে জামায়াত শিবিরের ‘দাওয়াত’ কর্মসূচী আরও বেশি গোছানো ও আধুনিক! এরা জানে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি রয়েছে। রয়েছে ফোন ট্র্যাকিংয়েরও ব্যবস্থা। তাই দাওয়াত দিতে তারা দুটি ফোন ব্যবহার করছে। একটি থেকে স্রেফ টেক্সট আসছে স্থান ও সময়ের নাম। আর অন্যটি থেকে আসছে ফোন। ‘ভাই কেমন আছেন... গতকাল তো ভাই ব্যস্ত ছিলেন... আসতে পারেন নাই... আজকে আইসেন একটু আমার বাসায়... আপনার দাওয়াত।’ দাওয়াত পাওয়া একজন সাংবাদিকের দেয়া তথ্যে আরও জানা গেল, এতে ফোন ট্র্যাকিং হলেও ধরার উপায় নেই। যে কেউ মনে করবে এটি খাওয়ানোর দাওয়াত। আর যদি আদালত পর্যন্তও গড়ায় এই বক্তব্য থেকে কোন সহিংসতায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ করা যাবে না। শিবির ঢাকা মহানগরীকে চার ভাগে ভাগ করে চারটি ভিন্ন মিডিয়া ইউনিট করে এসব অপকর্ম করছে। বিকল্প ব্যবস্থাও নিয়ে রেখেছে তারা। সাংবাদিক না এলে নিজেদের ইউনিট কাজ করছে। ছবি তুলছে, নিচ্ছে ভিডিও ফুটেজ। পরে তা পাঠিয়ে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের কাছে। দ্রুতই তা প্রচার হতে শুরু করছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ক্যামেরাম্যান একজন মিস করলে ক্ষতি নেই অন্যজনের কাছ থেকে তা দ্রুতই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে একযোগে প্রচারিত হচ্ছে অনেক চ্যানেলে। ছবি প্রকাশিত হচ্ছে অনেক অনলাইনে। পরের দিনের দৈনিকেও প্রকাশিত হচ্ছে একই ছবি। সংবাদ মাধ্যম এভাবে আর কতদিন ব্যবহৃত হবে? এই প্রশ্নের জবাবে গেটকিপার সাংবাদিকরা বাংলানিউজকে বলেন, এই অনৈতিক সাংবাদিকতার চর্চা এখনই থামাতে হবে। তাঁরা বলেন, এরই মধ্যে তাঁরা নিজ নিজ বার্তাকক্ষে বলে দিয়েছেন এ ধরনের কোন ডাকে আর সাড়া দেয়া যাবে না। তাঁরা দাবি করেছেন, এখন আর প্রি এ্যারেঞ্জড কর্মসূচীগুলো কাভার করছেন না। যারা এ ধরনের ডাকে সাড়া দেবে তাদের স্রেফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে এ সংক্রান্ত কোন দুর্ঘটনা বা পুলিশী জটিলতায় পড়লেও তারা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাবে না।
×