ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বসন্তের বনফুলে মুগ্ধ প্রকৃতি

ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল পায়...

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৫ মার্চ ২০১৫

ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল পায়...

মোরসালিন মিজান ॥ জীবনানন্দ দাশ থেকেই বলা যাক। শুরু করা যাক। প্রিয় এই কবির কবিতায় যথারীতি এসেছে ভাঁটফুল। প্রিয়তম স্বামী লখিন্দরকে সাপে কাটার পর সতী স্ত্রী বেহুলা তাঁকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করেন। স্বর্গেও যেতে হয় তাঁকে। নেতাই ধোপানির সঙ্গে যান তিনি। সেখানে ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে রাজসভায় নাচেন। রূপসী বাংলার কবি সেই নৃত্যরত বেহুলার পায়ে নূপুর দেখেননি। ভাঁটফুল জড়িয়ে দিয়েছিলেন। কবিতায় লিখেছিলেন- বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়...। জীবনানন্দ যেহেতু কান্না শুনেছেন। ফুলের হাসিও কবিকে নিশ্চিত মুগ্ধ করেছিল। আর সাধারণ প্রকৃতিপ্রেমী ফুলপ্রেমী মানুষের কথা তো বলাই বাহুল্য। ক্ষুদ্র এ ফুলের রূপে-ঘ্রাণে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না কেউ। ভাঁট বসন্তের ফুল। এই ঋতুতে কম-বেশি সারাদেশেই হাসি হয়ে ফুটেছে। এমনিতে খুব পরিচিত। সবাই হয়ত নাম জানেন না। দেখলে ঠিকই চিনবেন। বিশেষ করে যদি গ্রামবাংলার কথা ধরা হয়, এই ফুল কাছ থেকে বার বার দেখা। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ রাস্তার ধারে, জঙ্গল বা বনের আশপাশ এলাকায় ফুটে থাকে। কারও যতেœর দরকার হয় না। কেউ তেমন ঘরে তুলে নেন না। তাতে কী? নিজ উদ্যোগে বেঁচে থাকে গাছ। এর ফুল প্রকৃতিকে সুন্দর করে। মানিকগঞ্জে এক রাস্তার ধারে দেখা মিলেছিল ভাঁটফুলের। নিবিড় তাকাতেই চোখে পড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। ছোট সাদা পাপড়ি। প্রতিটি ফুলে পাঁচটির মতো পাপড়ি। চারটির মতো সাদা লম্বা কেশর। ফুলের মাঝখানে হলুদের ওপর হাল্কা মেরুন রঙের ছোঁয়া। কেশরের অগ্রভাগে আবার বেগুনি রঙের রেণু। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, ভাঁটের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ক্ল্যারোডেনড্রাম ভিসকোসাম ভেন্ট। এর পাতা চার ইঞ্চি থেকে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিম্বাকৃতি পাতার আগা সরু। খসখসে। বোঁটা ১ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। মঞ্জরিদ- ১২ ইঞ্চির মতো। গাছ মাটি থেকে খুব উপরে ওঠে না। এর কচি কা-। গায়ে নরম রোম হয়। ফুলের বাইরের আবরণেও রোম থাকে। ভাঁটফুলের আরেক নাম ঘণ্টাকর্ণ। এ নামে আছে পৌরাণিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি এড়ায়নি এইটুকুন ফুল। তাঁর ‘সে’ শিরোনামে লেখা গল্পটিতে পাওয়া যায় ঘণ্টাকর্ণকে। গল্পের একটি চরিত্র ঘণ্টাকর্ণ। এর দুই কানে দুই ঘণ্টা। লেজও দুটি। দুই লেজে দুই হাতুড়ি। ওগুলো দিয়ে নিজেই নিজের ঘণ্টা বাজিয়ে যায়। ভাঁটফুলের আছে ঔষধি গুণ। সেই গুণের কথা বেশ মজা করে লিখেছেন বিপ্রদাশ বড়–য়া। লেখাটি এরকমÑ ঘণ্টাকর্ণের বিয়ে হয়েছিল বসন্ত-বিষফোঁড়া রোগের দেবী শীতলার সঙ্গে। এই ঘণ্টাকর্ণ, ঘেঁটু বা ভাঁটে জ্বর, চর্মরোগ, বিছের হুল ফোটানোতে ওষুধের কাজ করে। আর কি আশ্চর্য, বসন্তকালে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এমনকি ম্যালেরিয়া জ্বরে, পা-ু রোগে, অজীর্ণে এর রস কাজ করে ওষুধের মতো। এজন্য চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘণ্টাকর্ণ বৃক্ষের আরাধনা করা হয় চর্মরোগ নিবারণের জন্য। তিনি জানাচ্ছেন, এখনও গ্রামের মানুষ জ্বর হলে এর পাতার রস খেয়ে থাকে। ক্রিমি, পুরনো শূল বেদনা দূর করতে ভাঁট একটি উৎকৃষ্ট ভেষজ। বৈদ্যদের পাশাপাশি ইউনানি হেকিমেরাও এর ব্যবহার করেন বলে লেখায় উল্লেখ করেছেন বিপ্রদাশ বড়–য়া। তবে পরিশেষে ফুলটির রূপ আর মিষ্টি ঘ্রাণের কথাই বলতে হয়। ভাঁটফুলের এখন মৌসুম। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে সৌন্দর্য নিয়ে ফুটেছে অদ্ভুত সুন্দর ফুল। ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। এই সরল সুন্দর, মিষ্টি ঘ্রাণ নিশ্চিয়ই উপভোগ করবেন ফুলপ্রেমীরা।
×