ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসূচী অব্যাহত রাখার ঘোষণা ফখরুলের মুক্তি চাওয়া হয়নি ৭ দফা দাবি পেশ;###;কর্মসূচী অব্যাহত রাখার ঘোষণা ;###;ফখরুলের মুক্তি চাওয়া হয়নি ;###;৭ দফা দাবি পেশ

সাংবাদিকদের সামনে খালেদার লিখিত বক্তব্য পাঠ ॥ দ্রুত সংলাপ চাই

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৪ মার্চ ২০১৫

সাংবাদিকদের সামনে খালেদার লিখিত বক্তব্য পাঠ ॥ দ্রুত সংলাপ চাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সর্বস্তরের মানুষের কঠোর সমালোচনার পরও টানা হরতাল-অবরোধের মতো নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী থেকে সরে এলেন না বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের নামে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের ৭০তম দিনে শুক্রবার বিকেল ৪টায় সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। তিনি সরকারের কাছে ৭ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এর মধ্যে রয়েছে -আন্দোলন দমনের উদ্দেশে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, পুলিশ ও যৌথবাহিনীর হয়রানি বন্ধ করা, নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার, বিচারবহির্ভূত সকল হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া, সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকা-ের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহর করা এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করতে হবে। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগই একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করেছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, সঙ্কটের সমাধান করতে চলমান সংসদে আবার একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকেই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ ব্যাপারে সমঝোতার জন্য আলোচনার ব্যবস্থা করার দায় সরকারেরই। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের ৩ দিন ধরে হদিস নেই অভিযোগ করে তিনি বলেন, অনতিবিলম্বে সালাহউদ্দিনকে মুক্তি না দিলে পরিণতি ভাল হবে না। সরকার বিএনপি জোটের আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে জঙ্গীবাদের অপপ্রচার চালাচ্ছে অভিযোগ করে তিনি আন্দোলনে সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য ও আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানান। এ ছাড়া তিনি বলেন, সরকার পদত্যাগ করলেই সঙ্কটের সমাধান হবে। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে দেয়া খালেদা জিয়ার বক্তব্যের একাংশে তার রাজনৈতিক অপরিপক্কতা প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, তিনি বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আন্দোলন স্থগিত করা ভুল ছিল। এর মাধ্যমে তিনি তার অতীত রাজনৈতিক কৌশলের ভুল শিকার করে নিয়েছেন। এ ছাড়া দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও সালাহউদ্দিন আহমেদের নাম উচ্চারণ করে গ্রেফতারকৃত সব নেতাকর্মীর মুক্তি চাইলেও দীর্ঘদিন জেলে থাকার পরও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নাম উচ্চারণ করেননি। খালেদা জিয়ার লন্ডন প্রবাসী ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বিরোধ থাকার কারণেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হওয়া সত্ত্বেও তার নাম উচ্চারণ করা হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন চলাকালেই সাংবাদিকরা কানাঘুষা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সুযোগ না দেয়ার বিষয়টি অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। কারণ, বেশ ক’টি সংবাদ মাধ্যমের সিনিয়র সাংবাদিকরা সংবাদ সম্মেলনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করে চলমান আন্দোলন কর্মসূচী সম্পর্কে ভালভাবে ২০ দলীয় জোটের অবস্থান জানতে। কিন্তু সে সুযোগ না দেয়ায় সিনিয়র সাংবাদিকরা তাদের মনের প্রশ্ন মনে নিয়েই ফিরে গেছেন। উল্লেখ্য, সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার লিখিত বক্তব্যের আগে এবং পরে তার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান জানান; আজ কোন প্রশ্ন নেয়া হবে না। তবে সংবাদ সম্মেলন শেষে বাধার মুখেই এক সিনিয়র নারী সাংবাদিক বার বার খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে থাকেন, ২ মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে কি পেলেন? প্রত্যুত্তরে খালেদা জিয়া প্রথমে বলেন, আবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে তখন প্রশ্নের জবাব দেব। পরে বসা থেকে উঠতে উঠতে তিনি বলেন, চলমান আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা আছে। উল্লেখ্য, দেশের মানুষ মনে করেছিল খালেদা জিয়া হয়ত আন্দোলন কর্মসূচীতে নতুন কৌশল প্রয়োগ করে গুলশান কার্যালয় থেকে সম্মানজনকভাবে বাসায় ফিরে যাবার পরিবেশ সৃষ্টির পথে যাবেন। সেই সঙ্গে রাজপথে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের সুযোগ নেবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তা না করে নেতিবাচক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেন। জানা যায়, সংবাদ সম্মেলন করার আগে খালেদা জিয়া তার ছেলে তারেক রহমান ছাড়া দলের আর কোন নেতার মতামত নেননি। এমনকি দলের সিনিয়র নেতাদের সংবাদ সম্মেলনে আসার জন্যও বলেননি। তবে মঞ্চে গুলশান কার্যালয়ে তার সঙ্গে অবস্থান করা নেতাদের নিয়েই তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। গুলশান কার্যালয়ের নিচতলায় সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেনÑ স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ভাইস-চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এম এ কাইয়ুম, খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আল আমিন ডিউ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, খালেদা জিয়ার প্রেস উইয়ং কর্মকর্তা সামসুদ্দিন দিদার ও শায়রুল কবির খান। খালেদা জিয়া বলেন, একটি শান্তিময়, সুখী-সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের বীর সন্তানরা জীবন দিয়েছিলেন। অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সেই দেশ আজ গভীর সঙ্কটে। এ সঙ্কট রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক। আর এ সঙ্কটের স্রষ্টা আওয়ামী লীগ এবং আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ হাসিনা। জনগণের সম্মতি ছাড়া কারসাজির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে সেই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার উদগ্র বাসনা আজ সমগ্র জাতিকে এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেক বিবাদ-বিসম্বাদের পর বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এই মর্মে একমত হয়েছিল যে, কোন দলীয় সরকারের অধীনে এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই আলোকে জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আমরা প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। এই ব্যবস্থার অধীনে কয়েকটি নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ একতরফা সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। তারা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করে। এ লক্ষ্যে তারা সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে তাতে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথই প্রায় রুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন সুযোগই রাখা হয়নি। সঙ্কটের মূল উৎস সেখানেই। খালেদা জিয়া বলেন, মহাবিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এক নির্লজ্জ প্রহসনের মধ্য দিয়ে তারা গণতন্ত্রের নাম-নিশানাও মুছে দিয়েছে। এই প্রহসনের অংশ হিসেবে অপকৌশলের মাধ্যমে তারা ভোট ছাড়াই সংসদের ১৫৩টি আসনে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। এই ঘৃণ্য কারসাজির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বহীন একটি অবৈধ ও স্বেচ্ছাচারী সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। জবাবদিহিতাহীন এ সরকারের দেশ পরিচালনার কোন নৈতিক অধিকার, ভিত্তি ও এখতিয়ার নেই। মহাকারসাজির নির্বাচনী প্রহসনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শেখ হাসিনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকারও করেছিলেন। কিন্তু যথারীতি তিনি তার সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন। আসলে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোন দৃষ্টান্ত তাদের নেই। খালেদা জিয়া বলেন, গত ৫ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনটিকে আমরা গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালনের কর্মসূচী দিয়েছিলাম। ঢাকায় আমাদের সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচী ছিল। সেই কর্মসূচী বানচালের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা ৩ জানুয়ারি থেকে অঘোষিতভাবে দেশ অবরুদ্ধ করে ফেলে। সড়ক ও নৌপথে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রাজধানীকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। আমাদের কর্মসূচীর আগের রাতেই আমাকে এই কার্যালয়ে বালু ও ইটবোঝাই ট্রাক, জলকামান ও সাঁজোয়া যান দিয়ে ঘিরে অবরুদ্ধ করা হয়। পুলিশ বাইরে থেকে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। বিরোধী রাজনীতি ও ভিন্নমতকে এরা দমন করে দেশে কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ফেলেছে। সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। মানুষের সব অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই না করলে আমাদের স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই আমরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। জনগণের সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন এখন চলছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ স্বাভাবিক করতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং একের পর এক উস্কানিমূলক আচরণ করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটানো হচ্ছে। কাজেই যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। আন্দোলনে দেশবাসী ও নেতাকর্মীর কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির কথা আমরা জানি ও বুঝি। এ সম্পর্কে সকলেই সচেতন। কেবল ক্ষমতাসীনদের কোন বোধোদয় নেই। জনগণের দুর্দশা লাঘবের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাদের কাছে বড়। সাহসিকতার সঙ্গে সবাই অংশগ্রহণ করলে এ আন্দোলন অচিরেই সফল হবে ইনশাআল্লাহ্। এই সাময়িক কষ্ট জাতির বৃহত্তর স্বার্থে স্বীকার করার জন্য আমি সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, সারাদেশে যারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন আমি তাদের সাধুবাদ দেই। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সকল শ্রেণীর জনগণ, দল-জোটের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক ও সাংবাদিক বন্ধুরাসহ সবাই যে নির্যাতন, জেল-জুলুম ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন তার জন্য প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাই। যারা নিহত, আহত ও গুম হয়েছেনÑ বেদনাহত চিত্তে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সমাবেদনা জানাই। আল্লাহ্র রহমতে দিন পরিবর্তন হলে আমরা অবশ্যই আপনাদের পাশে দাঁড়াব। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের যে সব বন্ধুরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং গণমাধ্যম ও সিভিল সমাজের সদস্যবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক মানুষ জীবন দিয়েছেন, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। উন্নত কিংবা অনুন্নত কোন দেশেই গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং সংগ্রামী মানুষের আত্মত্যাগ কখন বৃথা যায়নি। বাংলাদেশেও তা বৃথা যাবে না ইনশাআল্লাহ্। আমাদের বিশ্বাস, এই প্রক্রিয়াতেই আমরা সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারব। আন্দোলনকে দ্রুত নিয়ে আসতে পারব শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে। খালেদা জিয়া বলেন, জীবনের এই প্রান্তে ক্ষমতা আমার কাছে বড় কিছু নয়। দেশবাসীর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আমি অতীতে কয়েকবার দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছি। প্রিয় সেই দেশবাসীর জন্য তাদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতেই আমরা লড়াই করছি। এই আন্দোলন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তির নয়। কোন দলের বিরুদ্ধে কোন দলের নয়। এ আন্দোলন আদর্শের। এ আন্দোলন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার। এ আন্দোলন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকলের। আজকের এই আন্দোলন ক্ষমতা দখলের আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার আন্দোলন। আমি এ আন্দোলনে দল-মত-পেশা-শ্রেণী নির্বিশেষে সকল ব্যক্তি ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে শামিল হবার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আমার আহ্বান, যারা এখনও নিষ্ক্রিয় আছেন তাঁরা সক্রিয় হোন। নিজ নিজ অবস্থান ও এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলুন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলুন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। খালেদা জিয়া বলেন, গণবিচ্ছিন্ন শাসকগোষ্ঠী জনগণের আন্দোলনে ভীত হয়ে হত্যা-উৎপীড়নের পাশাপাশি ষড়যন্ত্র, নাশকতা ও অপপ্রচারণায় মেতে উঠেছে। তারা এখন পুরোপুরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যে এসব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ভার কতিপয় দলবাজ কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে তাদের মাধ্যমে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীকে বিরোধী দল ও জনগণকে নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করছে। আমরা বারবার বলেছি, আজ আবারও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে আইনসম্মতভাবে কর্তব্য পালনের আহ্বান জানাচ্ছি। হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, বন্দী অবস্থায় গুলি করে পঙ্গু করা, বাড়িঘরে হামলা, পাইকারি গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা দায়েরের বেআইনী প্রক্রিয়া থেকে তাদের দূরে থাকতে বলছি। দেশবাসী জানেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি বরাবরই সন্ত্রাস ও সহিংসতানির্ভর। অতীতে আন্দোলনের নামে তারা যে ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়েছে তা সকলেরই জানা। মাসের পর মাস টানা হরতাল-অবরোধ-অসহযোগ কর্মসূচীর নামে তারা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। খালেদা জিয়া বলছেন, স্বল্পমেয়াদী ৬ষ্ঠ সংসদদের নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বর্জন করে সেই নির্বাচন ঠেকাতে তারা ‘গণকার্ফু’ জারি করে দেশব্যাপী হত্যা ও ধ্বংসের তা-ব চালিয়েছিল। এই আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অচল এবং রেলস্টেশন, যানবাহন, অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। অফিসগামী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকাশ্য রাজপথে বিবস্ত্র করেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছে। এসব পৈশাচিক তা-বের প্রকাশ্য নির্দেশ শেখ হাসিনা নিজে দিয়েছেন এবং এসবের বহু দালিলিক প্রমাণও রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ আজ বিচার বিভাগের মর্যাদার কথা বলে। অথচ তারা রায় পছন্দ না হওয়ায় বিচারকদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করেছে। সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তি বসিয়েছে। দেশের প্রধান বিচারপতির এজলাসে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে। ক্ষমতায় বসেই তাঁরা নিজেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করেছে। সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামিদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় মুক্ত করেছে। বিরোধী দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে তাঁদের নজিরবিহীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে রিমান্ডে রেখে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আমাদের দলের অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় প্রায় এক মাস ধরে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত বিরোধী দল সমর্থক মেয়রদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দলীয় লোক বসানোর জন্য তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসা শাসকদের কাছে জনগণের ভোটের যে কোন মূল্য নেই তা তারা হাতেনাতে প্রমাণ করছে। আমাদের দলের অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে আপনারা জানেন। তাকে গ্রেফতার করেও গত তিন দিনেও সরকার স্বীকার করেনি। এখন পর্যন্ত তার কোন হদিস নেই। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার ব্যাপারেও সরকার প্রথম অস্বীকার করে পরে নাটক সাজিয়ে ২১ ঘণ্টা পর তাকে গ্রেফতার দেখায়। সম্প্রতি ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের বক্তব্য-বিবৃতি সংবাদ-মাধ্যমে প্রচার না করার নির্দেশ দেয়। তারপরও বিএনপি ও ২০ দলের পক্ষে সালাহউদ্দিন আহমেদের দেয়া বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারিত হতে থাকায় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাকে কত হীন পন্থায় হয়রানি ও হেনস্থা করা হয়েছে ও হচ্ছে; আমি তার বিবরণ দিতে চাই না। দেশবাসী সব জানেন এবং দেখছেন। খালেদা জিয়া বলেন, যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষকে দগ্ধ করে শোচনীয় মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমরা এসব পৈশাচিক বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছি। হীন সন্ত্রাসে জড়িতদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিরও দাবি করে চলেছি। কিন্তু আমাদের আহ্বানে তারা কর্ণপাত করেনি। তারা তাদের ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছে এবং নিরপরাধ মানুষের শোচনীয় মৃত্যুকে তারা তাদের ঘৃণ্য রাজনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। দেশে যখন নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে তখন বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের কোন উদ্যোগ নেই। তার বদলে চলছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার। কোন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা তদন্তে ও তথ্য-প্রমাণ ছাড়া মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দায়ী করে ক্রমাগত বক্তব্য রাখা হচ্ছে। যার ফলে তদন্ত প্রভাবিত এবং ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের অফিসগুলো তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ আমাদের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় শাসক দলের মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মহড়া করানো হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ‘দেখা মাত্র গুলি’ করার বেআইনী আদেশ দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসের জন্য কলঙ্কিত ছাত্রলীগের সদস্যদের অপরাধী ধরিয়ে দেয়ার নামে রাষ্ট্রীয় অর্থে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও নৈরাজ্যকর করে তোলা হচ্ছে। আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই যে, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এই শাসক মহলই সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে যানবাহনে তুলে পরিকল্পিতভাবে শোচনীয় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসব পরিকল্পিত বোমা হামলার সঙ্গে তারাই জড়িত বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে। নিরপরাধ মানুষের জীবনকে যারা রাজনীতির পণ্যে পরিণত করে তাদের ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই। খালেদা জিয়া বলেন, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে, জনগণের স্বাধীনতা এবং মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। আজকের সঙ্কট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সঙ্কট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। তাহলেই আমরা সঙ্কট মুক্ত হয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারব। আমি আশা করি, ক্ষমতাসীনদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা সমঝোতার পথে ফিরে আসবে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সঙ্কট দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নেবে।
×