ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

নিঃশব্দতার চাপাতি ও জীবন বাঁচাতে জীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৪ মার্চ ২০১৫

নিঃশব্দতার চাপাতি ও  জীবন বাঁচাতে জীবন

(১২ মার্চের পর) ব্লগার, মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায়ের মৃত্যুতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শোকাভিভূত। ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে সন্দেহভাজন ফারাবীকে। সন্দেহের তালিকায় অনেকে আছে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার তদন্ত করছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এফবিআই এসেছে অধিকতর তদন্তের জন্য। দেখা যাক সামনের দিনে এ তদন্ত কোন্ দিকে যায়। উইকিলিকসে প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালের এক তারবার্তায় মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি জানাচ্ছেন : ‘‘At the meeting, Acting Awami League Secretary General Syed Ashraful Islam reiterated his party’s position that Jamaat should be banned because it is a party of “war criminals.”[2] এই বক্তব্য যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাচ্ছে সরকার গঠনের আগে আওয়ামী লীগের পরিষ্কার অবস্থান ছিল জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। ২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে কি সেই বাস্তবতা বদলেছে? জামায়াত শুধু যুদ্ধাপরাধী সংগঠন নয়, সন্ত্রাসী সংগঠনও বটে। এই দলটির সরাসরি যোগাযোগ জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকত-উল-জিহাদ আল ইসলাম (হুজি), হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাথে। অথচ জামায়াতকে আজও নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে হারিয়ে যায়নি, তা তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শাহবাগে জাতীয় পুনর্জাগরণে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম। তারা সরাসরি দাবি জানিয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হোক। তাহলে কেন এই দ্বিধা, এই ভয়? নিঃশব্দের চাপাতি কি শুধু রাজনৈতিক নেতারা প্রদর্শন করছেন? না, তা নয় অবশ্যই। অভিজিতের মৃত্যুর পর কি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? যে শিক্ষক সমিতির গোটা কার্যকর পরিষদে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকরা রয়েছেন, অভিজিতের নির্মম মৃত্যুতে তাঁরা কোন কর্মসূচী নেয়া তো দূরের কথা, একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিতে পারেননি। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে জাতিকে, রাজনীতিবিদদের দিক-নির্দেশনা দিত, আজ তাদের এই পরিণতি? নিঃশব্দতার চাপাতি তাদেরও হাতে। মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের দারিদ্র্য, সেখানে তা যে পরিব্যাপ্ত হবে সর্বত্র, তাতে সন্দেহ কি? তাই আমরা দেখি জঙ্গীদের চাপাতির আঘাতে অভিজিতের মৃত্যুর পর ছাত্রলীগ দায়সারা গোছের কর্মসূচী পালন করে দায়িত্ব শেষ করে। অতীতে যেখানে ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দল ও তার নেতাদের সামনে হাজির করতে পারত উচ্চতর কর্মসূচী, বাধ্যও করত তা বাস্তবায়নে, সেখানে আজ ছাত্রনেতারা তাকিয়ে থাকে রাজনৈতিক নেতাদের ভাবনার দিকে। বিশ্বস্ত লেজুড়ের মতো তাদের নির্দেশ তালিম করে যায় তারা। অন্যদিকে অভিজিত হত্যার প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ডাকা ধর্মঘট কতটুকু প্রগতিশীল? বাস্তবে এই ধরনের লোক দেখানো কর্মসূচীর জামায়াত-শিবির-হিজবুত তাহরীর-আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে ফুলের টোকা দেয়ার ক্ষমতাও নেই। সময় নষ্ট না করে জঙ্গীদের তালিকা তৈরি করে তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দাও। সময়ের সদ্ব্যবহার হবে। সংগঠিত হয়ে হাজির হও শিবিরের আস্তানায়। তাদের তুলে দাও পুলিশের হাতে। বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলোর গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস আছে। তাদের বর্তমান অবস্থাটি কি? ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের অংশ। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাঁদের দলের উচ্চতর কর্মসূচী কোথায়, যা দিয়ে তাঁরা আওয়ামী লীগ ও সরকারকে আলোকিত করতে পারেন? যা তাঁরা পারতেন এরশাদবিরোধী মোর্চাবদ্ধ আন্দোলনের সময়। এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মতো তাঁরাও অভিজিতের পিতাকে সমবেদনা জানাতে তাঁর বাসায় যান, কিন্তু তা প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। সিপিবি ও বাসদের অবস্থা আরও করুণ। এ দুটো দলের মেধাবী সভাপতিগণ টিভি চ্যানেলের টকশোতে অধিক ব্যস্ত আছেন। দেশের এই দুঃসময়ে তাঁরা বহু সময় ব্যয় করেন এই তত্ত্বকথা বোঝাতে যে, বিএনপি ও জামায়াত এক নয়। বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত অবরোধ-হরতালের মধ্যে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য তাঁরা খোঁজেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুধু ১৯/২০ পার্থক্য দেখেন। বেগম খালেদা জিয়াকে স্পষ্ট বলতে পারেন না, প্রথমে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করুন। সংলাপের কথা হবে পরে। অবাক বিস্ময়ের কথা, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই তত্ত্ব দেন যে, অবরোধ-হরতালের সঙ্গে অভিজিতের হত্যাকে এক করা যাবে না। এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়ত বোঝাতে চান, বেগম খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া-জামায়াতের লক্ষ্য ইসলামী জঙ্গীদের থেকে আলাদা। শিক্ষক ও সুশীলদেরও একই অবস্থা। সামান্য প্রাপ্তির জন্য তারা কোথায় নামতে পারে মান্না ও খোকার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে তা একেবারে খোলা হয়ে যায়। তাই দেখি নাগরিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত সুশীলরা ধর্মীয় জঙ্গীদের হাতে অভিজিতের হত্যা বিষয়ে রাজনীতিবিদের মতোই নিঃশব্দ থাকেন। আরও গুরুতর কথা, জামায়াত-বিএনপির কাতারে নেমে গিয়ে ক্ষমতার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সুশীলদের মুখপাত্র মাহমুদুর রহমান মান্না। নিঃশব্দতার চাপাতি তাই আজ সর্বব্যাপী। আজ দেশ ও জনগণের মূল শত্রু ধর্মীয় মৌলবাদ ও তাদের জঙ্গী সহিংসতা। জামায়াতে ইসলাম তার পরিকল্পনাকারী। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক জিয়া সে ষড়যন্ত্রে শামিল আছেন। নানা জঙ্গী সংগঠনের নামে এরা একের পর এক আঘাত করে চলেছে মানবতার ওপর। তাদের চাপাতির আঘাতে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক এম তাহের, অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম লিলন, প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া, আহমেদ রাজীব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, জগতজ্যোতি তালুকদার, জাফর মুন্সী, ড. অভিজিতরা জীবন দিচ্ছেন। আমাদের চোখের সামনে একের পর এক ঘটে যাওয়া এইসব মৃত্যু আমরা অবলীলায় হতে দিচ্ছি। কারণ আমরা নিঃশব্দ থাকছি, সরব হচ্ছি না। ঘুমিয়ে আছি এই জন্য যে, ‘ঘুম ভাঙলেই পাবে ভূতের ভয়।’ কিন্তু চোখ বন্ধ করে রাখলেই প্রলয় বন্ধ হবে না। ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যতই জামায়াত নেতাদের নিজ দলভুক্ত করেন না কেন তাদের চাপাতি ও পেট্রোলবোমার হাত থেকে তাঁরা রক্ষা পাবেন না। খবর নিয়ে দেখুন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কত অসংখ্যক নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী জামায়াত-শিবির ও তাদের নানা ঘাতক সংগঠনের হাতে জীবন দিয়েছেন। এও খবর নিন, এদের মূল টার্গেট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। অতীতেও ছিলেন, এখনও আছেন। অভিজিতের পিতাকে জানানো সমবেদনা গোপন রাখলেও তার হেরফের হবে না। সে কারণেই নিঃশব্দতার চাপাতি হিম-শীতল-ভয়াবহ। কে পারে মৌলবাদী ধর্মীয় জঙ্গীগোষ্ঠীর হাত থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে? বাস্তব নিখাদ সত্য হলো, একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই তা পারেন। যিনি মহাপরাক্রমশালী আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন- এদের পরোয়া না করে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পারেন, তিনিই তো যথার্থ অর্থে সেই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক যিনি সঙ্কটে সেই রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে পারবেন যা দিয়ে ধর্মীয় জঙ্গীবাদকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা যাবে। একবার, দু’বার নয় গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে, সংসদে বিরোধী দলের নেতা বা সরকার প্রধান হিসেবে, কারাগারের ভেতরে কিংবা বাইরে শেখ হাসিনা সঙ্কট মোকাবেলায় যে রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টি দেখিয়েছেন, ১৯৭০ সালের পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আরও এক নির্ধারক নির্বাচনী বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষতবিক্ষত সংবিধানকে কিছু সীমাবদ্ধতাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফসলে ফিরিয়ে এনেছেন, সরকার গঠনের মাত্র এক মাসের মাথায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডকে দুর্দমনীয় সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে জামায়াত-বিএনপির ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান ও রায় কার্যকর করার দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, ২০১৩ সালের ৫-৬ মে তারিখে শাপলা চত্বরে সমবেত হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির জঙ্গী আক্রমণে ক্ষমতা দখলের নীল-নকশা অকার্যকর করেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত সৃষ্ট ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে তাকে এক অপার সম্ভাবনার দেশে পরিণত করতে চলেছেন এবং সর্বশেষ, সরকার পতনের লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত দীর্ঘ-প্রলম্বিত অবরোধ-হরতালকে অন্তঃসারশূন্য ও অকার্যকর করে দিয়েছেন- সেই শেখ হাসিনাই পারবেন ওই রাজনৈতিক দৃঢ়তা, সাহস ও দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে, যা দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গী মৌলবাদকে কার্যকরভাবে নির্মূল করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপলব্ধি, বিশ্বাস ও দৃঢ়তা তাঁকে প্রতিনিয়ত সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। আজ বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় জঙ্গীবাদের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মানবতা, আইএস জঙ্গীদের হাতুড়ির আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্যের করুণ পরিণতির এই দুঃসময়ে বাংলাদেশকে খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া-জামায়াতের একই জঙ্গী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চালিত করতে পারেন একমাত্র শেখ হাসিনা। দেশের সত্যিকার সুশীল সমাজের কর্তব্য হচ্ছে এই বাস্তবতা স্বীকার করে শেখ হাসিনার পেছনে কাতারবন্দী হওয়া। তা হতে পারলেই দেশের আলোকিত অংশ অতীতের গৌরবময় দিনগুলোর মতো সেই নৈতিক বিবেকের জায়গাটি ফিরে পাবেন, যার ওপর দাঁড়িয়ে নিঃশব্দতার চাপাতির ভার থেকে শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক রাজনৈতিক শক্তিকে মুক্ত করতে নিঃশঙ্ক সমালোচনায় তাঁরা ব্রতী হতে পারবেন। আমরা সবাই যে অতল গিরিখাদের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি, তা থেকে উদ্ধার পেতে আর কোন বিকল্প আমাদের সামনে নেই। ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি, এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’ জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার প্রতিটি কথা আজকের বাংলাদেশের এই সময়, তার সুশীল সমাজ এবং শকুন ও শেয়ালের হাতে অভিজিতের মতো মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে কতই না সাযুজ্যপূর্ণ। কিন্তু জীবনেরা আছে। তার কথা দিয়ে শেষ করি। ‘অদ্ভুত আঁধারে’ পথ দেখিয়েছে জীবন। জীবন বাঁচাতে সে এগিয়ে এসেছে। আমাদের ভয় কি? (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ
×