ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাখাইন পল্লীতে শিক্ষাকেন্দ্র দাবি

ভাষা শেখার অদম্য লড়াই হারিয়ে যাওয়া বর্ণ চেনার সুযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১২ মার্চ ২০১৫

ভাষা শেখার অদম্য লড়াই হারিয়ে যাওয়া বর্ণ চেনার সুযোগ

মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ রাখাইন তরুণী শ্যো শ্যো নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বর্তমানে সে ডালবুগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। শ্যো শ্যো বলতে পারে নিজস্ব ভাষা। আর পড়তে ও লিখতে জানে কেবল বাংলা ভাষা। তার নিজস্ব ভাষায় অক্ষর জ্ঞান নেই। তাই সে পারে না লিখতে কিংবা পড়তে। প্রায় এক বছর ধরে নিজের জাতির ভাষা শেখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে। সকাল-বিকেল নিজস্ব ভাষা শেখার পাঠ চুকিয়ে পরে স্কুলের লেখাপড়া করে শ্যো শ্যো। শ্যো শ্যোর মতো অবস্থা ৭ম শ্রেণীর খ্যানকেনের। টানা দুই বছর চেষ্টার পর নিজের ভাষা রপ্ত করছে। চ্যোরি অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সেও দুই বছর ধরে নিজস্ব ভাষা শিখছে। এ দশা একই শ্রেণীর আরেক তরুণ সিওয়ানচোর। দু’বছর আগেও এরা কেউ নিজের ভাষার বর্ণমালা চিনত না। লিখতেও পারত না। এ সব শিশু ও যুবকসহ ২৭ শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে রাখাইন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র। সকালে ১০টা পর্যন্ত আর বিকেলে সুযোগ মতো সময় চলছে শিক্ষা কেন্দ্রটি। যেন নিজের ভাষা চিনতে লড়াই করছে এ সব রাখাইন শিক্ষার্থীরা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নের বৌলতলী রাখাইন পল্লীতে অবস্থান শিক্ষা কেন্দ্রটির। একমাত্র মহিলা শিক্ষক ম্যেম্যেউ রাখাইন জানালেন, আগে তার বাবা স্কুলটি চালাতেন। তিনি সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। এখন শিক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্ব তার ওপর। বৌলতলী পাড়া ছাড়া পার্শ্ববর্তী বেতকাটা পাড়ার রাখাইন শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীরা এখানে নিজস্ব ভাষা শিক্ষা নিচ্ছে। চতুর্থ শ্রেণীর শিশু মেচো, অমেং জানায়, তারা এখন অন্তত নিজেদের বর্ণমালা চিনতে পারছে। লিখতেও পারছে কিছু কিছু। নিজস্ব ভাষার ক্লাস থ্রী পর্যন্ত শেখার সুযোগ পাচ্ছে সব শিক্ষার্থী। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস তাদের সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় কেন্দ্রটি পরিচালিত করে আসছে। মাত্র ১৯শ’ টাকার মাসিক সম্মানিতে এ ভাষা শেখার কাজটি চালাচ্ছেন ম্যেম্যেউ। ২০০৭ সাল থেকে এটি ছাড়াও আরেক রাখাইন পল্লী নাইয়রিপাড়ায় আরও একটি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চালু রয়েছে। ফলে হারিয়ে ফেলা নিজস্ব ভাষা চেনার সুযোগ পাচ্ছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর অর্ধশত সদস্য। ’৮০-এর দশক পর্যন্ত রাখাইনদের নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ । প্রত্যেক পাড়ায় ছিল খাস পুকুর। প্রত্যেক পাড়ায় নিজের ভাষা শেখার একটি করে স্কুল ছিল। সকাল-সন্ধ্যা শোনা যেত নিজের বর্ণমালা শেখার ক্ষুদে কণ্ঠস্বর। রাখাইনদের এমন স্বকীয়তা এখন আর নেই। শুধু ভাষা নয়, হারিয়ে ফেলছে তাদের জমিজমা, পাড়া থেকে বাড়ি-ঘর পর্যন্ত। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রাখাইন জনগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলেছে তাদের নিজস্ব ভাষা চেনার সুযোগ। এ অঞ্চলে মাত্র দুটি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চালু থাকায় অন্তত অর্ধশত রাখাইন শিশু-কিশোর-যুবক শিখতে পারছে নিজস্ব ভাষা। চিনতে পারছে নিজেদের বর্ণমালা। সহায়ক সংস্থা রাখাইন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য ক্লাস থ্রী পর্যন্ত বই সরবরাহ করছে। বৌলতলী রাখাইন পল্লীর বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মংচিন থান ওরফে মংচান জানান, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে তাদের পাড়াগুলোয় একটি করে ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চালু রাখলে অন্তত নিজস্ব ভাষা শেখার সুযোগ পেত সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠী। নইলে চিরতরে বর্তমান প্রজন্ম থেকে কেউ রাখাইন ভাষা শিখতে পারবে না। হারিয়ে ফেলবে নিজেদের বর্ণমালা চেনার সুযোগটি। এমনকি যে সব স্কুলে রাখাইন শিক্ষার্থী রয়েছে ওইসব স্কুলের পাঠক্রমে রাখাইন ভাষা পড়ানোর আলাদা শিক্ষক নিয়োগের দাবি এ সম্প্রদায়ের।
×