ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সহিংসতার প্রতিবাদে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ মার্চ ২০১৫

সহিংসতার প্রতিবাদে

শিল্পীসমাজের মানবিক উদ্যোগ মনোয়ার হোসেন ॥ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখেছে দেশের শিল্পীসমাজ। বায়ান্ন থেকে শুরু করে একাত্তর কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শিল্পীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। স্বদেশ ও সমাজের প্রতি দায়বোধে সব সময়ই সাড়া দিয়েছে শিল্পীরা। এক্ষেত্রে চারুশিল্পীদের ভূমিকা অনেকটাই অগ্রগামী। বিপন্ন মানবতাকে রক্ষায় তারা কখনও ক্যানভাসে এঁকেছেন আবার কখনও প্রতিবাদী হয়ে নেমেছেন রাজপথে। সম্প্রতি আন্দোলনের নামে চলমান সহিংসতায় মানবতার পক্ষে ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আবার প্রতিবাদী প্রকাশে অংশ নিলেন শিল্পীরা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে গ্যালারি চিত্রকের আয়োজনে ও বৃত্তান্ত ’৭১ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হলো ‘মানবতার পক্ষে, সহিংসতার বিরুদ্ধে চিত্রকর্ম’ শীর্ষক প্রদর্শনী। রাজনৈতিক নৃশংসতার প্রতিবাদী প্রকাশের এই প্রদর্শনীতে অংশ নেন দেশের নবীন-প্রবীণ, খ্যাতিমান ও বরেণ্য ৫০ শিল্পী। মানবহিতৈষী এসব চিত্রশিল্পী ওই প্রদর্শনীতে বিনামূল্যে জমা পঞ্চাশটি চিত্রকর্ম। সেই ছবিগুলো বিক্রির মাধ্যমে উঠে আসে ১৫ লাখ টাকা। আর পুরো টাকাই শুক্রবার বার্ন ইউনিটের ৩০জন অগ্নিদগ্ধকে প্রদান করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সেমিনার কক্ষে ডা. সামন্তলালের উপস্থিতিতে প্রত্যেকে ৫০ হাজার টাকা করে করে সহায়তা দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, নিসার হোসেন, গ্যালারি চিত্রকের নির্বাহী পরিচালক মনিরুজ্জামান প্রমুখ। ওই প্রদর্শনীতে খ্যাতিমান ও নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের সঙ্গে অংশ নেন তিন বরেণ্য শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রফিকুন নবী ও হাশেম খান। আর প্রদর্শনীতে নিজেদের অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটসহ দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটময় মুহূর্তে শিল্পীসমাজের ভূমিকা ও করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন তাঁরা। শাহাবুদ্দিন আহমেদ : মুক্তিযোদ্ধা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিল্পী বলেন, চিত্রকের পরিচালক মনিরুজ্জামান যখন এমন প্রদর্শনী আয়োজনের কথা বললেন তখন আগ্রহী হলাম। মনে হলো সহিংসতার শিকার এসব সাধারণ মানুষের জন্য আমাদের কিছু করা কর্তব্য। সেই সূত্রে ছবি দিলাম এবং মনিরুজ্জামান জানালেন এই প্রদর্শনীর ছবি বিক্রির অর্থ থেকে কোন পার্সেন্টেজ নেয়া হবে না। সব মিলিয়ে আমরা ৫০ জন শিল্পী নিজেদের শিল্পকর্ম জমা দিলাম। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ প্রদর্শনীর আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার প্রধান শিকার হচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এটা হার মানিয়েছে অতীতের যে কোন পৈশাচিকতাকে। প্রতিদিনই মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছে। ভয়ঙ্কর পেট্রোলবোমার আঘাতে ঝলসে যাচ্ছে মানুষের শরীর। আর এমন দুঃসময়ে আমরা শিল্পীরা না ভাবলে কে ভাববে? আমাদের প্রত্যাশা মানবিক ও সুস্থ-সুন্দর জীবন। আর সেই চাওয়া থেকেই এই প্রতিবাদী শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়। শিল্পী হিসেবে রং-তুলির আশ্রয়ে ক্যানভাসে প্রকাশিত হয়েছে আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভাষা। রফিকুন নবী : বরেণ্য এই শিল্পীর ভাষ্য, দেশের আন্দোলন-সংগ্রামসহ দুর্যোগময় মুহূর্তে ভূমিকা রেখেছে শিল্পীসমাজ। মানুষের দুর্গতিতে সাহায্যের জন্য কখনও ছবি আঁকি আবার কখনও অবতীর্ণ হই প্রতিবাদী ভূমিকায়। আর যে কোন দুর্যোগে একজন শিল্পীর প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ছবি আঁকা। এই প্রদর্শনীতে ছবি দিয়ে আমরা একইসঙ্গে সহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিবাদের প্রকাশ করেছি। আন্দোলনের নামে এখন পৈশাচিক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। কোন সভ্য সমাজে এটা মেনে নেয়া যায় না। আর আমরা শিল্পীরা তো দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, মুর্তজা বশীর, এমদাদ হকের মতো অগ্রজ শিল্পীরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামেও এদেশের শিল্পীরা ভূমিকা রেখেছেন। প্রদর্শনী সম্পর্কে তিনি বলেন, ছবি বিক্রির অর্থ থেকে প্রাপ্ত ১৫ লাখ টাকা আমরা অগ্নিদগ্ধদের সহায়তায় প্রদান করলাম। তবে বার্ন ইউনিটে গিয়ে যা দেখলাম মনে হলো এই তেমন অর্থ কিছুই না। সামান্য কিছু অর্থ পেলেও তা অগ্নিদগ্ধদের ভাঙ্গা ও পোড়া মনের ক্ষত কিভাবে দূর করবে আমার জানা নেই। তবে চিত্রকের এ প্রদর্শনীর আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিল্পী হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কিছুটা পূরণের সুযোগ পেলাম। বর্তমানে রাজনীতির নামে যে ধরনের নৃশংসতা চলছে সেটা সারাদেশের মানুষ পর্যবেক্ষণ করছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে কোন উদ্যোগ নিয়ে আমাদের হয়ত আবারও নামতে হবে। হাশেম খান : বরেণ্য এই শিল্পী বলেন, আমাদের চারুকলার সিলেবাসেই আছে দেশের ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও মানুষকে ভালবাসতে হবে। দায়বদ্ধ থাকতে হবে মানবতার প্রতি। আর দেশের চারুকলার ইতিহাসে দেখা যায়, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅনুভ্যত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং নানা দুর্যোগসহ সব সময় সাধারণ মানুষের মানবিক দাবিগুলোর প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শিল্পীরা। সেই প্রেরণা থেকেই সহিংসতার প্রতিবাদে এই প্রদর্শনীতে অংশ নেই এবং ছবি জমা দেই। আর ছবি বিক্রির অর্থ সহায়তা দিয়ে অগ্নিদগ্ধ মানুষের দুঃখের সাথী হওয়ার চেষ্টা করেছি। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে আসলে আন্দোলনের নামে চলছে সহিংসতা। মানুষ কি করে এতটা অমানবিক হয়? মূলত আন্দোলনের নামে জামায়াতের কথামতো কাজ করছে বিএনপি। ফলে উন্মোচিত হয়ে গেছে তাদের ছদ্মবেশ। আর এই দুই পক্ষ মিলে শুধু মানুষ নয়, হত্যা করছে দেশ ও সমাজকে। যে সহিংসতা চলছে এককথায় তা মানবতাবিরোধী।
×