ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৩ মার্চ ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

আগের সপ্তাহ থেকে চলতি সপ্তাহের ঢাকা কি যথেষ্ট বদলে গেছে? তার দিন আর রাতের চেহারায় কি এসেছে অভিনব কোন ছাপ! এমনটা বলা যাচ্ছে না। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি বলতে যদি ঋতু বা প্রকৃতি এবং রাজনৈতিক আবহাওয়ার কথা বলি, তাহলে কিছু পরিবর্তনের প্রসঙ্গ মোটা দাগেই তোলা যাবে। পঞ্জিকা অনুসারে ঋতুরাজ বসন্ত চলছে এখন। ফাল্গুন গুনগুন করে গাইতে না গাইতেই আধাআধি মাস ফুড়ুত করে চলে গেছে। তবু ঢাকায় বইছে না ফাল্গুনী হাওয়া। রীতিমতো হাঁসফাঁস গরমে কষ্ট পাচ্ছে ঢাকাবাসী। শীত বিদায় নিয়েছে ঢাকাবাসীকে চূড়ান্ত কাবু না করেই। এবার শীতের ছোবল মোটেই তীব্র হয়নি, বরং বলতে পারি তা চুমু খেয়ে গেছে কম্বলের কিনারায়। আর ফাল্গুন! সাড়ম্বরে স্বাগত জানানো হয়েছিল ফাল্গুনের আগমনী দিনটিতে; পরদিন ভালবাসা দিবসেও বসন্তকে আহ্বান জানানো হয়েছিল বেশ আদিখ্যেতা করেই। তবু কি ঋতুরাজ এসেছে রাজধানীতে? তবে কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে কোথাও কোথাও; আর ফাগুন-রাঙা শিমুল ফুটেছে। রাজপথের ধারে শিমুলের রাঙা-রাজত্বর নয়নলোভন আলোকচিত্র ছাপা হয়েছে রবিবার জনকণ্ঠের প্রথম পাতায়। সেদিন থেকে টানা ৭২ ঘণ্টা হরতাল দিয়েছে ২০ দলীয় জোট বিগত চার-পাঁচ সপ্তাহের মতোই। যদিও আগের সপ্তাহ থেকেই ঢাকা একেবারেই মানছে না এই একঘেয়ে কর্মসূচী। বিষয়টা হয়তো ভাবনায় ফেলে দিয়ে থাকবে হরতালওয়ালাদের। তাই সেই পুরনো ধাঁচে হরতালের আগের সন্ধ্যায় ঢাকায় তারা সাত-সাতটি যানবাহনে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রেমিকের মনে ফাল্গুন তেমন আগুন লাগাতে না পারলেও হরতাল আহ্বানকারীদের ক্রোধের আগুনে প্রাণহীন যানবাহন বার বার জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। আর রবিবারের কথা কী বলব। সেদিন যথারীতি যানজটে নাকাল হয়েছে ঢাকাবাসী। হরতালওয়ালারাও রাগে-দুঃখে যানজটের ভেতরেই বাসে আগুন দিয়েছে। এছাড়াও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রোবাসের জানালার কাচ ভেঙ্গে ভেতরে আগুন গলিয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবারে সাত যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটলেও পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যা না করায় মনে মনে ভাবছিলাম ওদের বোধহয় সুমতি হয়েছে। কিন্তু পরদিন রবিবার রাতেই সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো বনশ্রীতে পেট্রোলবোমায় পাঁচ যাত্রী দগ্ধ হওয়ায়। এদিন ঢাকায় আটটি যানবাহনে আগুন দেয়া হয়, যার সাতটিই ছিল গণপরিবহন বা বাস। আগুন নিয়ে যে খেলা খেলছে দেশের অন্যতম প্রধান দলটি তাতে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিজেদের আগুনের আঁচে শেষ পর্যন্ত তারাই বেসামাল হয়ে উঠবে। এক সপ্তাহ ব্যবধানে ঢাকার তাপমাত্রা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে আগুনের আতঙ্ক সরিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসা মানুষের সংখ্যাও। রাজপথে মানুষের চলাচল দেখেই এমনটা ধারণা হয়। যেসব স্কুল পুরোপুরি বন্ধ ছিল সেগুলো শুক্র-শনি এই দু’দিন খোলা রাখতে শুরু করেছে। আর এসএসসি পরীক্ষাও যথারীতি ওই দুই দিন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঢাকাবাসীর মনে আশা জাগছে, মানুষ পুড়িয়ে মারার নৃশংসতা অবসানে সরকার আরো কঠোর হবে। শুরু হলো স্বাধীনতার মাস স্বাধীনতার মাস শুরু হলো। একাত্তরের এই সময়টা ছিল অগ্নিঝরা উত্তাল। স্বাধীনতার মাস শুরু হলেই দেশের গণমাধ্যম ধারাবাহিকভাবে মার্চের দিনগুলোর ঘটনাপঞ্জি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে তুলে ধরে। এটি গভীর দায়িত্ববোধেরই পরিচয়। যারা একাত্তর দেখেনি তাদের কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার নানা লেখায় উঠে আসে। বয়োজ্যেষ্ঠদের দায়িত্ব নবীনদের সেই ইতিহাস পাঠে উদ্বুদ্ধ করা। আজ স্বাধীন দেশে আমরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, আত্মগৌরব ও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছি, মুক্তিযুদ্ধে বিপুল আত্মত্যাগ বিনা সেটা সম্ভবপর হতো না। নবীন প্রজন্মের কাছে সেসব কথা যথাযথভাবে তুলে না ধরলে কিভাবে তাদের ভেতর দেশপ্রেম এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে! তাই আমাদের প্রত্যেককেই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য এই স্বাধীনতার মাস আহ্বান জানায়। আজ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিজয়ী হলে আমরা লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করি। সেই পতাকাটি প্রথম কিভাবে উত্তোলিত হয়েছিল সে কথা মার্চের শুরুতেই দেশের সংবাদপত্রে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়। অল্পকথায় বলি- একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক বিক্ষুব্ধ জনপদে। এদিন ওড়ানো হয়েছিল মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। এর আগের দিন ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ইয়াহিয়া খান এক ফরমানের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। তাঁর সেই অবৈধ এবং স্বৈরাচারী ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালী জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করা ছাড়া অধিকার আদায়ের আর কোন বিকল্প নেই। পাকিস্তানী শাসকদের এই মনোভাবের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ২ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র এদিন বটতলায় এসে জমায়েত হন। বটতলার সমাবেশে ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারী ঘোষণার ধিক্কার জানানো হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বটতলার ঐতিহাসিক সমাবেশে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি উত্তোলন করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয়েছে আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে। মুক্তমনা অভিজিৎ এই ঢাকায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অভিজিৎ রায়। বাবাকে নিয়ে তাঁর লেখাতেই পেলাম নিজের জন্মসময়ের কথা। অভিজিৎ লিখেছেন- ‘দেশ তখন স্বাধীনতার জন্য উত্তাল। যুদ্ধের ডামাডোলের ভেতরেই বাবা আমার জন্মের খবর পেলেন। বাবা তখন কুমিল্লা বর্ডারে যুদ্ধ করতে করতে ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং সেলের সদস্য হয়েছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারির কাজগুলোও তাকেই সামলাতে হচ্ছে। আমার জন্মের খবর পেলেও সময়মতো আসতে পারলেন না। যখন আসলেন, অভিমানী মা তার সঙ্গে কথা না বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। বাবা তাঁর প্রথম সন্তানকে কোলে তুলে নিলেন জন্মের চৌদ্দ দিন পরে।’ বাবাকে নিয়ে অভিজিতের হৃদয়স্পর্শী এই লেখাটি আবার নতুন করে পঠিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরও অনেক লেখার পাশাপাশি। যেহেতু প্রধানত তিনি বিজ্ঞান নিয়েই লিখতেন, তাঁর প্রথম বইয়ের নাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ মূলত মহাবিশ্বের উৎপত্তির সাম্প্রতিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে বই, তাই সাধারণ পাঠকদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত ছিলেন তিনি। বিশেষ করে কম্পিউটারে বাংলা রচনার পাঠকের কাছে নয়, শুধু ছাপানো বইয়ের পাঠকদের কাছে। তবে বিশ্বব্যাপী আজকের প্রজন্মের বাঙালি পাঠক তথা ইন্টারনেটের ব্লগ যারা পড়েন বা সেখানে লেখেন তাঁদের কাছে সুপরিচিত ছিলেন অভিজিৎ। দেশের প্রথম দিককার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভেতর খুব কমসংখ্যক ব্যক্তিই আছেন যাঁরা অভিজিৎ প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’ ব্লগ পড়েননি। অভিজিৎ পরিচিতি পেয়েছিলেন একজন ‘মুক্তমনা’ হিসেবেই। গত সপ্তাহে জঙ্গীদের হাতে অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর তার প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে দেশব্যাপী। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য জনপথে পুলিশের চোখের সামনেই খুন হওয়ার পর প্রতিদিনই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন প্রতিবেদন। প্রতিদিনই অভিজিৎকে নিয়ে লেখা বেরোচ্ছে। অভিজিৎ কী লিখতেন, কেমন লিখতেন সেটা নিয়ে এখন সাধারণ পাঠকদের ভেতর কৌতূহল তৈরি হচ্ছে। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অজয় রায়ের বেদনাভারাতুর হৃদয়ের কষ্ট ও ক্ষোভ যেন আমাদের বহুজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অভিজিতের কন্যার বক্তব্য পড়ে আমরা কান্না লুকাতে পারি না। ফেসবুকে অভিজিৎকন্যা তৃষা তাঁর বাবা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘তিনি আমাকে যা শিখিয়ে গেছেন, যে ভালোবাসা দিয়ে গেছেন তা আমি সবসময় মনে রাখব। আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি বাবা। প্রতিটি জিনিসের জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ।’ তিনি আরও লিখেছেন, “ইসলামী মৌলবাদীরা তাঁকে ছুরির আঘাতে হত্যা করেছে। ওই ঘটনায় আমার মা-ও গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যদি বলি এই ঘটনায় আমি আতঙ্কিত বা মর্মাহত, তাহলে কম বলা হবে। ... পরিস্থিতি ‘যত খারাপ হোক না কেন’ পৃথিবীকে ‘ভালো’ জায়গায় পরিণত করতে ‘যুক্তির লড়াই’ শেষ হয়ে যাবে না।” তৃষা লিখেছেন, ‘আমার বয়স যখন ছয় বছর, তখন আমার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু তাঁর। এর পরের ১২ বছরে ক্রমে তিনি আমার বন্ধুতে, আমার নায়কে, আমার আদর্শে, বিশ্বস্ত নির্ভরতায়, আমার নাচের সঙ্গীতে এবং আমার বাবায় পরিণত হন।’ বাবার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ফেসবুক এ্যাকাউন্টে আরও উল্লেখ করেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক। বিজ্ঞান এবং নিরীশ্বরবাদ বিষয়ে লেখার জন্য মূলত তিনি পরিচিত ছিলেন।’ তৃষা আহমেদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তিনি আটলান্টার একটি স্কুলের শিক্ষার্থী। বইমেলার শেষ দু’দিন অভিজিতের ওপর জঙ্গী হামলা হয়েছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে। তিনি সেদিন বহু সময় বইমেলায় কাটিয়েছেন। ইতোমধ্যেই পাঠকরা জেনেছেন নিজের লেখা দুটি বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষেই মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে তিনি দেশে এসেছিলেন। বইমেলা তাঁকে ভীষণ আকর্ষণ করত। অভিজিৎ খুন হওয়ার পর বইমেলার শেষ দুদিন শুক্র ও শনিবার বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। বিশেষ মূল্যছাড়ে বই কেনার শেষ সুযোগ হাতছাড়া করেননি বইপ্রেমীরা। তবে পরিচিত মহলে অভিজিতের প্রসঙ্গটি দুদিনই উচ্চারিত হয়েছে নানাভাবে। জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর- অভিজিতের বই প্রকাশকারী প্রধান দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে তাঁর লেখা বই প্রচুর বিক্রি হয়েছে। অভিজিতের লেখক-বন্ধু ও প্রকাশকরা মিলিতভাবে ব্যানার নিয়ে মৌন প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বার বার উঠে এসেছে মুক্তচিন্তার লেখক হুমায়ুন আজাদের প্রসঙ্গও। ২০০৪ সালে বইমেলা থেকে ফেরার পথে একই কায়দায় তাঁর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। অবশ্য সেদিন তিনি গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। এবার ঘাতকরা তাই অভিজিতের ক্ষেত্রে ছিল আরও সতর্ক। অভিজিতের মাথা ছিল আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। তাদের আঘাত এত তীব্র ছিল যে, অভিজিতের করোটি ভেদ করে মগজের কিছু অংশ ছিটকে পড়ে রাস্তার উপরে। হুমায়ুন হত্যাকারীদের এখনও সাজা হয়নি। অভিজিতের ঘাতকদের এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এভাবে কি চলতে পারে একটি স্বাধীন দেশ? ১ মার্চ ২০১৫ [email protected]
×