ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিক্ষোভে উত্তাল সারাদেশ ॥ অভিজিতের ঘাতকদের অবিলম্বে গ্রেফতার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিক্ষোভে উত্তাল সারাদেশ ॥ অভিজিতের ঘাতকদের অবিলম্বে গ্রেফতার দাবি

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা ও ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে দেশব্যাপী মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, প্রদীপ প্রজ্বলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়েছে। জনাকীর্ণ স্থানে প্রকাশ্যে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হয়েছিলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ। অবিলম্বে এই হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। একই দাবিতে দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান করে গণজাগরণ মঞ্চ। বিকেলে সিলেট ও চট্টগ্রাম নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট সংগঠন, অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীবৃন্দ। বেলা ১১টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে হামলাকারীদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার দাবি জানানো হয়। অন্যথায় এর দায়-দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে বলেও জানানো হয়। প্রতিবাদী ছাত্র শিক্ষক ও নাগরিকদের ব্যানার থেকে আয়োজিত এই সমাবেশে বক্তারা বলেন, অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা দেশের মুক্ত চিন্তার ওপর বড় আঘাত। এ আঘাত মোকাবেলা করতে হলে সব মানুষকে সংগঠিতভাবে মাঠে নামতে হবে। একই সঙ্গে এ হামলার জন্য জামায়াত-শিবির ও মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততাকে দায়ী করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক কামাল লোহানী, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত, মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, হামিদা হোসেন, ব্লগার ও লেখক পারভেজ আলম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএসএম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক এজেএম শফিউল আলম ভূইয়া, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। জঙ্গীরাই এই হত্যাকা- চালিয়েছে অভিযোগ করে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সমাবেশে বলেন, তাদের হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে সাধারণ মানুষও বলতে পারবে একই জঙ্গীগোষ্ঠী এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। অভিজিতকে হত্যার জন্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে দায়ী করে প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা শুধু যুদ্ধ ঘোষণাই নয়, এদেশকে জঙ্গীবাদী দেশ করতে চায়, ‘বাংলাস্তান’ করতে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এটা চলতে পারে না। আমরা এটা চলতে দিতে পারি না। এদের প্রতিহত করতে আমাদের এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। সমাবেশে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী শক্তির বিচার অসমাপ্ত রাখায় দেশে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ দুই-তিন স্তরের নিরাপত্তার কথা বলে। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা কোন স্তরেই থাকে না, তারা তা জানে না। সাংবাদিক, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, দেশ প্রগতিশীল চিন্তার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটা হতে দেয়া যাবে না। মানবাধিকার নেত্রী হামিদা হোসেন বলেন, অভিজিৎ রায়ের ওপর হামলার সময় ঘটনাস্থলের অনেক কাছেই পুলিশ ছিল। এত কাছে থেকে তারা কী করছিল, সে প্রশ্ন আমাদের করতে হবে। কয়েক বছর আগে আজকের এই দিনে যখন হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হয়। তখনও ওই এলাকায় পুলিশ উপস্থিত ছিল। তাদের উপস্থিতিতে কীভাবে একজনকে হত্যা করা হয়েছিল তা আমার প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী বলেন, দেশে হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে চায় আর কেউ ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু হত্যাকারীর বিচার কেউ করে না। রাজনীতির এই হত্যার খেলার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত হতে হবে। একই ঘটনার প্রতিবাদে সকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে গণজাগরণ মঞ্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ পালন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। এসব সমাবেশ থেকে অভিজিতের হত্যাকারী ও তাঁর স্ত্রীর ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। এরপর পরই ‘ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যার প্রতিবাদে’ শাহবাগে অবস্থান নেয় গণজাগরণ মঞ্চ। এ সময় অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িতের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তির দাবিতে মঞ্চের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যারা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে তারা আত্মস্বীকৃত মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী। এই জঙ্গীরা অভিজিৎ রায়কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি দিয়ে আসছিল। মর্মান্তিকভাবে তাকে খুনও করা হলো অথচ এখনও এই হত্যাকাণ্ডের জড়িত মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। রাষ্ট্র ও সরকারকে এই মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, একই ঘটনাগুলোর বার বার ঘটছে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক শফিউল, ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর অভিজিতকেও হত্যা করা হলো। একের পর এক ঘটনা ঘটানো হলো কিন্তু হত্যাকারী জঙ্গীগোষ্ঠীর কোন বিচার হচ্ছে না। এর মাধ্যমে এক বিচারহীনতার সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে এই অপরাধীরা অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছে। এই কাপুরুষোচিত হত্যার মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতার না করা পর্যন্ত মঞ্চের এই অবস্থান চালিয়ে যাওয়া হবে বলেও জানান তিনি। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে আলোর মিছিলের আয়োজন করে ঘটনার প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। একই ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে বক্তারা ড. হুমায়ুন আজাদসহ মুক্ত চিন্তার লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এতে বক্তব্য দেন খেলাঘর চট্টগ্রামের নেতা ডাঃ একিউএম সিরাজুল ইসলাম, প্রকৌশলী দেলোয়ার মুজমদার, আবৃত্তিকার রাশেদ হাসান, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সুনীল ধর প্রমুখ। অংশ নেয় গণজাগরণ মঞ্চ, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, প্রগতিশীল ছাত্রজোট প্রভৃতি সংগঠন। হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শুক্রবার বিকেলে সিলেট নগরীতে প্রতিবাদী মিছিল এবং বিক্ষোভ সমাবেশ করে সিলেটের অনলাইন এক্টিভিস্ট ফোরাম। এতে অংশ নেয় সিটি কাউন্সিলর শামীমা স্বাধীন, উদীচী সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রতন দেব, নাট্যকর্মী সুপ্রিয় দেব শান্ত প্রমুখ। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠন। এদের মধ্যে রয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন।
×