ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা

বিদেশী তিন ব্যাংক বড় ধরনের ঋণ ঝুঁকিতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিদেশী তিন ব্যাংক বড় ধরনের ঋণ ঝুঁকিতে

রহিম শেখ ॥ অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ধারাবাহিক লোকসান ও বড় ধরনের ঋণ ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিদেশী খাতের ৩ ব্যাংক। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। ধারাবাহিক লোকসানে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে পাকিস্তানের সরকারী খাতের এই ব্যাংকটি। সম্প্রতি অনুমোদন না নিয়ে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দীর্ঘ ৮ মাস বাংলাদেশে অবস্থানের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়াই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এদিকে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণের অর্থ পাচারের অভিযোগে আবারও আলোচনায় এসেছে দি হংকং এ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি)। সম্প্রতি এমন অভিযোগে কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ, ব্যাংকটির সব শাখা পরিদর্শন ও তথ্য দেয়ার জন্য সুইস ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বিদেশী ঋণ অপব্যবহারে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে আরেক বিদেশী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। জানা গেছে, দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) কার্যক্রম। বড় কিছু গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় ও নতুন গ্রাহক ধরতে না পারায় বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। বাংলাদেশের ৫৬ ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অবস্থান সবচেয়ে তলানিতে। বিদেশী ৯ ব্যাংকের মধ্যেও ব্যাংকটির অবস্থান সবচেয়ে নিচে। ঢাকা, গুলশান, চট্টগ্রাম ও সিলেট শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এনবিপি। মূলত অন্য দেশের আমানতেই পরিচালিত হয় ব্যাংকটি। ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকটির খেলাপী ঋণ বাড়তে থাকে। ২০১০ সালের পর ১ বছর খেলাপী ঋণ কিছুটা কমলেও আবারও বেড়ে বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই খেলাপী হয়ে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপী ঋণ ৭০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ৪৫ দশমিক ৭৬ শতাংশই খেলাপী। এই বিপুল অঙ্কের খেলাপী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা। আর প্রতিবছর লোকসান গুনছে বড় অঙ্কের। সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে ২৫ কোটি ডলার নতুন পুঁজি এনে মূলধন ঘাটতি মেটাতে হয়েছে। সূত্রে জানা যায়, গত বছর ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) বাংলাদেশ শাখায় বড় অঙ্কের লোকসানের জন্য ৬১ কর্মকর্তাকে দায়ী করে রিপোর্ট দিয়েছে পাকিস্তানের একটি পার্লামেন্টারি প্যানেল। ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিপির বাংলাদেশ শাখায় লোকসানের পরিমাণ ১১ বিলিয়ন রুপী ধরা হলেও আসলে লোকসানের পরিমাণ ১৮.৫ বিলিয়ন রুপী। এর সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের ৬১ কর্মকর্তা। যারা শুধু বাংলাদেশ শাখায় নয়, আঞ্চলিক অফিস; বাহরাইন এবং প্রধান কার্যালয় করাচীতেও ছিল। এদিকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের প্রাথমিক তথ্যেও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ডিসেম্বরের মধ্যে এনবিপিকে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। সম্প্রতি বিনিয়োগ বোর্ডের কোন ওয়ার্ক পারমিট না নিয়ে ব্যাংকটির ঢাকা অফিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে পাকিস্তানী নাগরিক ইমরান ভাটের কর্মরত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়। প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেয়ার বিধান থাকলেও এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কোন আবেদন করা হয়নি। এমন অভিযোগে ওই কর্মকর্তা গত শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র না নিয়েই পাকিস্তানে চলে গেছেন। সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের এক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদমর্যাদার ব্যক্তি বাংলাদেশ অফিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। আগের সিইও মোহাম্মদ ওয়াসিম খান গত বছরের আগস্টে চলে যান। নতুন সিইও হিসেবে যোগ দেন ইমরান ভাট। পাকিস্তান থেকে তিনি ঢাকায় এসে গত বছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেন। ওই ব্যাংকের সিইও হিসেবে কাজ করার জন্য ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার ক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। শুরুতেই তার আবেদনপত্রটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সার্টিফিকেটের নাম ও এনবিপির প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে নামের মধ্যে ভিন্নতা দেখা দেয়। এছাড়াও কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এসব মিটিয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তার ব্যাপারে অনাপত্তি দিয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী ওই চিঠি দেখিয়ে তিনি বিনিয়োগ বোর্ড থেকে বাংলাদেশে কাজ করার অনুমোদন নেবেন। এর ভিত্তিতে তিনি বিনিয়োগ বোর্ডে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করেন। এরপর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয় দেখার জন্য। কিন্তু ৬ মাস গেলেও মন্ত্রণালয় থেকে কোন জবাব আসেনি। ফলে তাকে কাজের অনুমতিও দেয়া হয়নি। তবে তার আবেদন বাতিলও করা হয়নি। এ ব্যাপারে বিনিয়োগ বোর্ডের সদস্য নাভাস চন্দ্র ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, কোনভাবেই ওয়ার্ক পারমিট না পেয়ে কেউ কাজ করতে পারে না। বিনিয়োগ বোর্ড থেকে চিঠি পাঠানোর ৪৫ দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু কোন কোন সময় একটু সময় লাগে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এ অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তার বাংলাদেশে অবস্থানকালে সকল ধরনের কর্মকা- খতিয়ে দেখা হবে বলে তিনি জানান। এদিকে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণের অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠায় আবারও আলোচনায় এসেছে হংকংয়ে নিবন্ধিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক দি হংকং এ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি)। সম্প্রতি কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের এমন সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ১৭ এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যাংকের ১৬ গ্রাহক ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করেছে। ওইসব অর্থ বাংলাদেশের এইচএসবিসি শাখা থেকে সুইজারল্যান্ডের শাখায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কর ফাঁকি দিয়ে ব্যাংকটির সুইজারল্যান্ড শাখায় এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত হিসাব রয়েছে ১০ ও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে রয়েছে সাতটি হিসাব। ব্যক্তিগত ১০টি হিসাবের মধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী রয়েছেন ৫ জন। এর মধ্যে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ৪৪ লাখ ডলার পাচার করেছেন। তবে কারা এসব টাকা পাচার করেছেন তাদের পরিচয় সম্পর্কে সংস্থাটি নিশ্চিত হতে পারেনি। এতে আরও বলা হয়, ১৯৮৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে এইচএসবিসির সুইস প্রাইভেট ব্যাংকে বাংলাদেশীদের ৩৪ এ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এর মধ্যে ৩১ হিসাব এখনও সচল। বাকি হিসাব বন্ধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপ-প্রধান মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, এইচএসবিসি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা অর্থ পাচারের কোন তথ্য দেননি। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশে এইচএসবিসির সব শাখা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কোন অসঙ্গতি পাওয়া গেলে আন্তর্জাতিক ওই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, শাখা পরিদর্শনের পাশাপাশি এইচএসবিসি বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য দেয়ার জন্য সুইস ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
×