ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল

বিনামূল্যে উন্নত সেবায়ও রোগী সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিনামূল্যে উন্নত সেবায়ও রোগী সঙ্কট

আনোয়ার রোজেন ॥ জটিল সব অস্ত্রোপচারের জন্য অপারেশন থিয়েটার আছে ৭টি। প্রত্যেকটিই অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন। আছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। নবজাতক শিশুর জন্য রয়েছে উন্নত ইনকিউবেটর সার্ভিস। জরুরী রোগীকে বাসা থেকে আনার জন্য আছে ২৪ ঘণ্টার এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। চমৎকার পরিবেশে থাকার জন্য আছে পরিপাটি ১৫০টি শয্যা। প্রতি তিন শয্যার বিপরীতে আছেন একজন করে চিকিৎসক। আছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম এবং প্যাথলজিসহ বিভিন্ন পরীক্ষাÑনিরীক্ষার ব্যবস্থা। আর এসবই পাওয়া যায় বিনামূল্যে। তবে যাদের জন্য এ সমস্ত উন্নত চিকিৎসা সুবিধা, সেই রোগীই নেই সরকারী কর্মচারী হাসপাতালে। ঢাকার অন্য সরকারী হাসপাতালগুলোতে উপচেপড়া ভিড় থাকলেও বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি ভুগছে ‘রোগী খরায়’। গত চার বছরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন মাত্র ৪ হাজার ৩২০ জন রোগী। এ হিসাবে ১৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি হয়েছেন মাত্র তিনজন। একই সময়ে বহির্বিভাগে রোগী উপস্থিতির দৈনিক হার মাত্র ২৫০ জন। আর জরুরী বিভাগে প্রতিদিন গড়ে সেবা নিতে আসেন মাত্র তিনজন রোগী। আবার রোগী খরার পাশাপাশি রয়েছে জনবল সঙ্কট। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে বিদ্যমান চিকিৎসা সুবিধা ও সামর্থ্যরে অর্ধেকও আগত রোগীদের দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সংবিধানে সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রজাতন্ত্রের ‘কর্মচারী’ পরিচয়ে অভিহিত করা হয়েছে। তাই নামে কর্মচারী হাসপাতাল হলেও জাতীয় এই সেবা প্রতিষ্ঠানে সারাদেশের সব শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। দেশে বর্তমানে সরকারী চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এরমধ্যে শুধু চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীই আছেন চার লাখেরও বেশি। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের বিশাল একটি অংশের বসবাস খোদ রাজধানীতে হলেও সেবা নিতে তাঁরা এ হাসপাতালে যান না। হাসপাতালটির অবস্থান রাজধানীর ফুলবাড়িয়া এলাকায়। এর অদূরেই কয়েক হাজার সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মক্ষেত্র সচিবালয়। তাছাড়া হাসপাতালের চারপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বসবাস। বিশেষায়িত সেবা এবং তা বিনামূল্যে প্রাপ্তির সুযোগ থাকার পরও প্রত্যাশিত সংখ্যক রোগী না আসায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত রেলওয়ে কর্মচারী হাসপাতালটিই ১৯৭৮ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল নামে যাত্রা শুরু করে। সরকারী কর্মচারী, তাঁদের পোষ্যদের সংখ্যা ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধি বিবেচনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১) হাসপাতালটিকে ১৫০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতালে উন্নীতকরণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের পাঁচ বছরে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এভাবে প্রায় ১০ বছর ঝুলে থাকার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার তার প্রথম মেয়াদে হাসপাতালটিকে আবারও ১৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেয়। সে অনুযায়ী লাল রঙের পুরাতন হাসপাতাল ভবনটির পাশে ২ দশমিক ০৩ একর জমির ওপর ৪৬ কোটি ৭৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় হাসপাতালের নতুন চারতলা ভবন। সেবা কার্যক্রমে গতি আনতে ও নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করতে হাসপাতালের প্রশাসনিক ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইসিইউ সুবিধাসহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন। তবে সরকারী কর্মচারীদের দাবির প্রেক্ষিতে হাসপাতালটির আধুনিকায়ন করা হলেও তাঁরাই সেবা নিতে হাসপাতালে যান না। সরেজমিন দেখা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন হাসপাতাল ভবনের নিচতলায় জরুরী বিভাগ চালু হয়েছে। তবে রোগীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। গত দেড় মাসে (১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা মাত্র ১৪১ জন। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে মাত্র তিনজন রোগী জরুরী বিভাগে সেবা নিতে এসেছেন। নতুন চারতলা হাসপাতাল ভবনের আন্তঃবিভাগে সুসজ্জিত ১৫০টি শয্যা থাকলেও সেগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের মতো খালি পড়ে আছে। কেবল রোগীর অভাবে দোতলার শিশু ও মেডিসিন ওয়ার্ডের দুটি ইউনিট দেড় বছরেও চালু করা যায়নি। একই সময়ে চতুর্থ তলায় অবস্থিত ২৬টি সাধারণ কেবিন, একটি ভিভিআইপি কেবিন ও দুটি ভিআইপি কেবিনে কোন রোগী ভর্তি হননি। আন্তঃবিভাগের সেবা প্রদান কার্যক্রম তিনতলাতেই সীমাবদ্ধ। গত চার বছরে আন্তঃবিভাগে রোগী ভর্তির দৈনিক গড় মাত্র তিনজন। ৫০ শয্যার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার ছিল মাত্র একটি। বর্তমানে হাসপাতালে সার্জারি, গাইনি, ইএনটি, চোখ প্রভৃতির অস্ত্রোপচারের জন্য অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন অপারেশন থিয়েটার আেেছ ৭টি। তবে রোগী না থাকায় দুটি অপারেশন থিয়েটার এখনও চালু করা যায়নি। কিন্তু অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি অস্ত্রোপচারের সংখ্যা। বহির্বিভাগের সেবা প্রদান করা হয় হাসপাতালের পুরাতন ভবনে। আগের তুলনায় চিকিৎসা সুবিধা বাড়ায় বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। গত চার বছরে বহির্বিভাগ থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জন রোগী সেবা নিয়েছেন।
×