ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাটহাজারীতে র‌্যাবের অভিযানে আটক ১২ ॥ সিডি ও জিহাদী বই জব্দ

সেনা, এসএসএফ ও জঙ্গীদের ট্রেনিং দেয়ার ভিডিও উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সেনা, এসএসএফ ও জঙ্গীদের ট্রেনিং দেয়ার ভিডিও উদ্ধার

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মাদ্রাসা পাড়া হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা। এ উপজেলায় রয়েছে হেফাজতে ইসলামের অনুসারীদের আদলে গড়া বিভিন্ন মাদ্রাসা ও কিন্ডার গার্টেন। ২০০৯ সালেও হাটহাজারীর বিভিন্ন মাদ্রাসায় জঙ্গী প্রশিক্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের গ্রেফতার করেছিল শিক্ষার্থীদের জঙ্গী মদদ দানের অভিযোগে। পরে হাটহাজারী থানা পুলিশের দুর্বল রিপোর্টের কারণে তারা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে আবার শিক্ষকতার নামে মাদ্রাসা পেশায় নেমে এসে জঙ্গী প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাটহাজারীর আলীপুর থেকে একটি ভবনের দুটি কিন্ডার গার্টেনের আদলে গড়ে তোলা জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে দুই শিক্ষকসহ ২২ জনকে আটক করে। র‌্যাব সেভেনের পতেঙ্গা দফতরে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর অপরাধে জড়িত না থাকায় তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাকি ১২ জনকে হাটহাজারী থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে জেলে প্রেরণ করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে র‌্যাব সেভেন দফতরে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে বিভিন্ন তথ্য। এ ব্যাপারে র‌্যাব-৭ অধিনায়ক, লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, হাটহাজারীতে অনেক নামীদামী মাদ্রাসা রয়েছে। কিন্তু জঙ্গী প্রশিক্ষণ বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা সেল তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেই অভিযানে নামে। তবে এ ধরনের আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র‌্যাব-৭ সূত্রে জানা গেছে, দেশের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ও জঙ্গীবাদ দমনে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি ও অনুসন্ধান কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। ফলে জঙ্গী সেল তাদের গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে হাটহাজারি থানার আলীপুরে অভিযান চালায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। সেখানের সুলতান আহমেদ সড়কের এসকে সাফিনা ভবনে দেড় শতাধিক র‌্যাব ফোর্স অবস্থান নেয়। গোয়েন্দা তথ্যে ছিল সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে জঙ্গী প্রশিক্ষণ চলছে। ওই ভবনের চতুর্থ তলায় থাকা আল মাদ্রাসাতুল আবু বকর নামের কিন্ডার গার্টেনটিতে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। মাদ্রাসা নামের এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে প্রথমে ২২ জনকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু ট্যাব, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং মেমোরি কার্ড। এছাড়াও জিহাদী ও জঙ্গীবাদ বিষয়ের ওপর লেখা পা-ুলিপির কম্পিউটার টাইপকৃত কপি, সরকার বিরোধী অডিও এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই মাদ্রাসায় চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর শিশু কিশোরদের এবং যুব সম্প্রদায়কে আরবি সাহিত্য শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বিনামূল্যের শিক্ষার পেছনে রয়েছে জঙ্গী প্রশিক্ষণ ও মগজ ধোলাইয়ের কাজ। ব্রেন ওয়াশ করেই নিরীহ শিশু কিশোরদের জঙ্গীবাদের তাত্ত্বিক ধারণা দেয়া হয়। মূলত জঙ্গীবাদসহ সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য তাদের একে-৪৭ রাইফেলসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও প্রযুক্তি বিষয়ে ধারণা দেয়া হচ্ছে। একে-৪৭ রাইফেলের ব্যবহার, গুলি লোড, আনলোড করার ভিডিও রয়েছে তাদের সংরক্ষণে। এছাড়াও আইএস জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ, আল নুসরা ট্রেনিং ভিডিও, আল কায়েদার ট্রেনিং ভিডিও, হামাস ও হিজবুল্লাহর গেরিলা ভিডিও রযেছে তাদের কাছে। আনসারুল্লাহর বাংলা টিমের ভিডিও থেকেও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা স্বীকার করেছে গ্রেফতারকৃতরা। এদিকে আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসএসএফের ট্রেনিং ভিডিও কেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তা জানায়নি গ্রেফতারকৃতরা। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ভিডিও, প্লাইপার ট্রেনিং ভিডিও, বিভিন্ন সময়ের উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করার ভিডিও, অপহরণের কৌশল ভিডিও, বাচ্চাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ইরাক আরাকানসহ ফিলেস্তিনী মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও রয়েছে এই মাদ্রাসার কালেকশনে। ওসামা বিন লাদেন, আয়মান আল জাওয়াহিরি ও অন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও সাক্ষাতকার, বিভিন্ন জিহাদ বিষয়ক ভিডিও, আফগান যুদ্ধ, বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা হামলার দৃশ্য ইত্যাদির ভিডিও দেখিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। র‌্যাব সেভেন আরও জানায়, এ ঘটনায় আটককৃত হলো শেরপুরের নাকপাড়া এলাকার আব্দুর রহমান ইবনে আসাদউল্লাহ (২৫), মুন্সিগঞ্জের কামার বাড়ী এলাকার ওসমান গনি (২০), শেরপুরের বাকরাবাড়ী এলাকার মোস্তাকিম বিল্লাহ প্রকাশ মাশরুর (২১), ভোলার লালমোহন এলাকার মোঃ নাবিল হোসাইন (১৯), বাঁশখালীর চেঢ়ুরিয়া এলাকার মোঃ সিরাজুল মোস্তফা সোলাইমান (১৯), পাবনার আলিমপুরের শামিম হোসাইন ইসমাঈল (১৮), ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মাহমুদুল হাসান (২২), নেত্রকোনার পাঁচাশি গ্রামের মোঃ ইউসুফ (২৩), গোপালগঞ্জের কেকানিয়ার শফিকুল ইসলাম শেখ সালাউদ্দীন (১৯), জামালপুর জেলার ইসলামপুরের রফিকুল ইসলাম যুবায়ের (১৯), গোপালগঞ্জের কোনাগ্রামের আব্দুল কাইয়ুম শেখ মানছুর ইসলাম (১৮) ও শেরপুরের কুড়িকাহানিয়ার মোঃ হারুনুর রশিদ। এদিকে ফটিকছড়ি থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা ইউনুস মিয়া জানান, হাটহাজারী উপজেলা সদরের পৌরসভা এলাকায় একে শাহীনা ভবনে গড়ে ওঠা দু’টি মাদ্রাসায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় র‌্যাব-৭ অভিযান চালিয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহাবুবুল আলম, ২ শিক্ষকসহ ২২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব তাদের কাছ থেকে নিষিদ্ধ বই এবং কয়েকটি সিডি উদ্ধার করে। ওই সময় গ্রেফতারকৃতরা ওই ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় দু’টি আবদ্ধ কক্ষে জঙ্গীবাদ এবং নাশকতার ওপর হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, স্থানীয় আলীপুর নূর আহমদ সড়কের একে শাহীনা ভবনে দীর্ঘ কয়েক মাস আগে আদর্শ ইসলামী একাডেমি এবং আল-মাদ্রাসাতুল আবু বকর (রাঃ) মাদ্রাসা নামে দু’টি ইসলামী কিন্ডার গার্টেন গড়ে উঠে। সকালে এ মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিলেও বিকালে রাতে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, উঠতি বয়সের এ যুবকেরা সহজে ওই ভবনের কক্ষগুলো থেকে বের হতো না। তাদের খাওয়া দাওয়া চলতো খুব গোপনীয়ভাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, হাটহাজারী মডেল থানা ভবন নির্মাণের সময় অস্থায়ী থানা ছিল ওই ভবনে। থানা স্থানান্তর হওয়ার পর এ ভবনটি খালি হয়ে পড়লে উল্লেখিত মাদ্রাসা দু’টি ভাড়া নেয়। এ ভবনটির পশ্চিমে কিছুদূর গেলেই পাহাড়ী এলাকা। স্থানীয় জনগণ জানান, বেশ কিছু যুবক রাতের আঁধারে ওই ভবন থেকে নেমে পাহাড়ী এলাকায় যাতায়াত করত। তাদের ধারণা পাহাড়ী এলাকায় এরা জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিত।
×