ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যে সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

যে সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি

বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমার মাতৃভাষা জীবনে জীবন যোগের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজসহ সারাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ আন্দোলন ও নানামুখী সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সর্বদাই সোচ্চার হন এবং সর্বস্তরের মানুষকে এ সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার কারণে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশমতো পুলিশের গুলিতে কতিপয় ছাত্র মৃত্যুবরণ করেন এবং এই মহান শহীদদের রক্তদানের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই আপোসহীন আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের অস্তিত্ব বা শিকড়ের সন্ধান লাভ করেছি। ভাষা আন্দোলনে উর্দু মাতৃভাষার স্বীকৃতির প্রশ্ন ছিল না, ছিল আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। যে পূর্বপাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার প্রথম সংগ্রাম। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক এক নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু শহীদ দিবস নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই গৌরব প্রতিটি বাঙালীর গৌরব। এ জন্য আমরা অবশ্যই নিজেদের ধন্য মনে করি। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বাংলাদেশ নতুন আত্মপরিচয় নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্রাজ্যবাদ-পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশ নামক এই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে গ্রহণ করতে পারেনি। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই একমাত্র রাষ্ট্রটিকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিতে ষড়যন্ত্র বন্ধ থাকেনি এক মুহূর্ত। একাত্তরের পর সরকারের পতনটি ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দেশের জন্য হৃদয়বিদারক ঘটনা। সেটি কোন গণঅভ্যুত্থান ছিল না, যা ছিল সাম্রাজ্যবাদ মদদপুষ্ট একটি সেনা অভ্যুত্থান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল। আগস্ট থেকে নবেম্বর পর্যন্ত নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়াউর রহমান। দেশে সামরিক স্বৈরাচার চেপে বসে। শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা। জেনারেল জিয়ার শাসনের শুরুতেই তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এক ধর্মীয় সমাবেশে প্রথম আঘাত হানেন ভাষা আন্দোলনের ওপর। তিনি প্রকাশ্যে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক সকল শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ প্রদান করেন। সামরিক শাসনের মধ্যেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। চতুর জেনারেল জিয়া পরিস্থিতি সামলাতে তাঁর বিমানবাহিনী প্রধানকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন। পাকিস্তানীদের প্রধান দালাল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকে পাকিস্তান থেকে ফেরত নিয়ে আসা হয়। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্গঠিত করার সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৮১ সালে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান জেনারেল জিয়াকে হত্যা করে। এই সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আরেকটি সরকারের পতন হয়। ইতোমধ্যেই সাম্প্রদায়িক শক্তি সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করে, যার নাম ফ্রিডম পার্টি। এবার ক্ষমতায় এলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ সময় প্রথম রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে যুক্ত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান ঘটে। ফ্রিডম পার্টির মতো রাজনৈতিক দলকে তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে জায়গা করে দেয়া হয়। যদিও প্রথমদিকে প্রচ- দাপট নিয়ে শাসন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ; কিন্তু তাঁর দেশ শাসনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ। দেশজুড়ে শুরু হয় গণতন্ত্র এবং মক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। আওয়ামী লীগ-দশ দল ও বামপন্থী শক্তি মাঠে নামে। দেশকে সামরিক শাসনমুক্ত করে গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার নতুন প্রয়াস শুরু হয়। তিন জোটের রূপরেখা প্রস্তুত হয় আগামী দিনের জন্য। বিএনপি বাধ্য হয়ে এই তিন জোটের রূপরেখায় স্বাক্ষর করে। শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে সৈ¦রাচারী এরশাদের পতন হয়, যাকে আমরা ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান হিসেবে জানি। দেশে তরুণ সমাজ-আপামর জনগণ আবার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শক্তি থেমে থাকেনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই অভিযোগ আছে যে, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানও বিএনপি, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) ও জামায়াতে ইসলামীর ঐক্যবদ্ধ ষড়যন্ত্রে বানচাল হয়ে যায়। ক্ষমতায় আসে বিএনপি। এভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তি পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয় গোপনে। বাংলাদেশকে আরব সংস্কৃতির অংশে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জনগণের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। কিছু বিরতি দিয়ে ২০০১ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসে। এবার বিএনপি একা নয়, সঙ্গে আসে জামায়াত। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গীরাও বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয় ও সহায়তা পেতে থাকল। দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল এই অপশক্তিকে রুখতেই ২০০৩ সালে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ-ওয়ার্কার্স পার্টি-জাসদ ও অন্যান্য প্রগতিশীল বামশক্তি নিয়ে ১৪ দলীয় জোট। এ ঐক্য ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশকে আবার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে পুনর্প্রতিষ্ঠার। যে যাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে, যা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক নতুন স্তরে উন্নীত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আবার শুরু হয় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমা দুনিয়া, পাকিস্তানী জঙ্গীদের লাগাতার বিরোধিতা সত্ত্বেও এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। শুরু হয় জামায়াত-বিএনপির নতুন ষড়যন্ত্র, দেশের সংবিধান ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রে অভিযাত্রার বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধী এবং মুক্তিযুদ্ধে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল তাদের বিচারকার্য শুরু হলে বিএনপি-জামায়াত আরও ক্ষিপ্র তৎপরতা শুরু করে। বিএনপিকে জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিএনপি এখন জামায়াতের রাজনীতিকেই ধারণ করেছে। গণজাগরণের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, যা এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত নতুন করে আরেক মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও আঁতাত করে। সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা চালায়। ঢাকা শহর রণাঙ্গনে পরিণত হয়। বিএনপি নির্বাচন বয়কটের পথে এগিয়ে যায়। সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমা দুনিয়া সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদকেই মদদ যোগায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে জামায়াত-বিএনপি সহিংস ও সন্ত্রাসবাদী আচরণের মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা চালায়। আক্রমণ চালায় রেল, সরকারী দফতরে, মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থানে, এমনকি ১৯৫২ সালের একুশের ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনারে। ফলে ৪৮টি শহীদ মিনার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নির্বাচন বয়কটের নামে সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কত শতাংশ ভোট পড়েছে ৪২% না ৪৫%Ñ যা আমাদের কাছে বড় নয়। বড় হলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে দেশ কোথায় যেত? সেটা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। জামায়াত-বিএনপি দেশকে আবার পাকিস্তানী ধারায় নিয়ে যেত। বাংলাদেশ এক উগ্রসাম্পদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। ২১ ফেব্রুয়ারির স্মৃতির প্রতীক শহীদ মিনার আবার ’৭১-এর মতো ধ্বংস হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নির্বাসিত হতো। স্বাধীনতার পর গত নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ ছিল- এটাই জনগণের উপলব্ধি; ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি। এমনকি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আজও সে সংগ্রাম শেষ হয়নি। এখন বাংলাদেশের জনগণ সে সংগ্রামের বিজয় অর্জনে প্রস্তুত হচ্ছে। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পাটি
×