ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বায়ন ও বাংলা ভাষা

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিশ্বায়ন  ও  বাংলা ভাষা

বাংলা ভাষায় এখন যথেষ্ট বাড়াবাড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে ইংরেজি বুলিমিশ্রণে। কখনো কখনো জেনেবুঝে ও ইচ্ছেমতো ইংরেজির মেশাল দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বাংলা ভাষার মাধুর্য রক্ষিত হচ্ছে না, তার বিকৃতিও ঘটছে। বিশেষ করে এক শ্রেণির বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রচারিত নাটক ও সিনেমায় আঞ্চলিক ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার করে এক অদ্ভুত মিশেল ভাষা চালু করার চেষ্টা চলেছে। কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতি নেই এমন চরিত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার মুখে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সুযোগ নেওয়ার জন্যে। আরও দুঃখজনক হল, সেই আঞ্চলিক ভাষাকেও বিকৃত করা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। নাটকের ক্ষেত্রে চরিত্রবৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে সংলাপে আঞ্চলিকতা থাকা দোষের নয়। কিন্তু হীন উদ্দেশ্যচালিত হয়ে প্রমিত বাংলাকে বিকৃত বা অবমূল্যায়ন করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হলে তা মেনে নেওয়া যায় না। সম্প্রতি নাটকে উদ্বেগজনকভাবে বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ লক্ষ করা গেছে। উৎকট উচ্চারণ প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তা মৌখিক প্রমিত বাংলার বিকৃতিতে সহায়ক হতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। কেউ কেউ এর পেছনে চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছেন, যদিও তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তথাকথিত আধুনিকতার নামে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ থেকে সচেতনভাবে সরে আসার জন্যেও কোনো কোনো গোষ্ঠী সচেষ্ট। তাতে বাংলা ভাষাপ্রিয় দর্শক-শ্রোতা বিচলিত বোধ করছেন। অনেকেই প্রতিবাদেমুখর হয়েছেন। বাংলাদেশে সম্প্রতি বাংলা ভাষা ব্যবহারে নতুন আর একটি উপসর্গও যোগ হয়েছে। একদল সংকীর্ণতাবাদী এই মত প্রচারে নেমেছেন যে, প্রমিত বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা। তাই তাঁরা উঠেপড়ে লেগেছেন বাংলাদেশের আলাদা ভাষা তৈরির জন্যে। সেটাও প্রকারান্তরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। কিন্তু এ ধরনের অপচেষ্টা বাংলা ভাষাপ্রেমীদের বিচলিত না করে পারে না। বাংলা ভাষা নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, সম্প্রতি বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ তথা ভাষাদূষণ হয় এমন সংবাদ পাঠ ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে উচ্চ আদালত। চরিত্রের কথোপকথনে সাবলীলতা ও স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা আনার জন্যে আঞ্চলিক ও আটপৌরে ভাষা ব্যবহার অসঙ্গত নয়। এ ক্ষেত্রে শিল্পীর অধিকার ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ভাবার ব্যাপার যে, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রভাবের এই যুগে যেসব শিশুকে প্রমিত বাংলা ভাষা শিখতে হচ্ছে ব্যাপক বুলিমিশ্রণ তাদের প্রমিত বাংলা শেখার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটা বিশেষভাবে ভেবে দেখা দরকার। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে, বিশেষ করে শিশুতোষ অনুষ্ঠানে, যদি প্রমিত বাংলার ব্যাপক প্রয়োগ ঘটে তবে ক্ষেত্রবিশেষে বুলিমিশ্রণ শিশুর প্রমিত ভাষা শেখার পক্ষে তেমন অন্তরায় হয় না। কোমলমতি শিশুদের প্রমিত ভাষা শেখাতে হলে অবশ্যই হিন্দি ছায়াছবি, হিন্দি ধারাবাহিক, ইংরেজি ছায়াছবি ও নানারকম কিম্ভূত বাংলার প্রভাব বলয় থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। একসময় শিশুদের ভাষা শেখা ও ভাষা চর্চাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করত শিশুসাহিত্য ও শিশুতোষ পত্রিকা। শ্রেণি-পাঠাগার, স্কুল-পাঠাগার এবং পারিবারিক ও স্থানীয় পাঠাগারগুলোর আকর্ষণীয় সংগ্রহ তাদের মনের খোরাক জোগাতো। এখন সে সুযোগ শিশুদের নেই। স্কুলের পড়া আর কোচিংয়ের পর তাদের খুব-একটা সময়ও থাকে না। যেটুকু সময় হাতে থাকে তা কেটে যায় কম্পিউটার-নির্ভর নানা রকম খেলায় কিংবা কার্টুন দেখায়। এ ক্ষেত্রে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম তাদের ভাষামানসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাতে প্রমিত বাংলার বদলে অন্য ভাষার সঙ্গে তাদের মিথস্ক্রিয়া ঘটলে তার ফলে প্রমিত বাংলা শেখায় অনুকূল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয় শিশু। সম্প্রতি কার্টুন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে শিশুদের মধ্যে কথায় কথায় হিন্দি বলার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি উদ্বেগজনক। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে, আকর্ষণীয় ও বিশ্বখ্যাত কার্টুনগুলিকে বাংলায় ভাষান্তরিত করার পদক্ষেপ নেওয়া। তা না হলে এই প্রবণতা বাংলা ভাষার জন্যে প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। নতুন প্রজন্ম ক্রমেই বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে। বর্তমানে এক শ্রেণির বাঙালির ঘরে ঘরে বিদেশী টিভি চ্যানেলের প্রভাবে শিশু-কিশোর-যুবকরা হিন্দি ছবি, কার্টুন দেখে, গান শুনে হিন্দি চর্চায় আকৃষ্ট হচ্ছে। তাদের অনেকেই ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু মেশানো বাংলায় কথা বলে নিজেদের অত্যন্ত আধুনিক ও কেতাদুরস্ত ভাবছে। উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একাংশও কথায় কথায় ইংরেজি বুলি ব্যবহার করছেন। তাতে অবচেতনে বাংলা ভাষার প্রতি উপেক্ষার মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের নামকরণে কেবল ইংরেজির আধিপত্য বিস্তৃত হয়নি, টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামকরণেও তা লক্ষণীয়। যেমন টিভি চ্যানেলের ইংরেজি নামের মধ্যে রয়েছে : আরটিভি, এটিএন নিউজ, এটিএন বাংলা, এনটিভি, চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি, চ্যানেল নাইন, চ্যানেল আই, বাংলাভিশন, মাই টিভি ইত্যাদি। তবে, এর পাশপাশি একুশে, দেশ, সময়, মাছরাঙা, মোহনা, বৈশাখী, দিগন্ত ইত্যাদি টিভি চ্যানেলের নামকরণ বাংলা ভাষাপ্রীতিকেই সমুন্নত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। টিভি চ্যানেলগুলো যেসব অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে সেগুলোর নামকরণে ইংরেজি ব্যবহারের প্রবণতা সত্যিই লজ্জা ও আশঙ্কাজনক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ইংরেজি নামের মধ্যে রয়েছে : আওয়ার ডেমোক্রাসি, আজকের রেসিপি, এনটারটেইনমেন্ট, ওয়ার্ল্ড মিউজিক, কমেডি আওয়ার, ক্লাস রুম, গেম শো, গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড, জিরো আওয়ার, টক শো, টপ চার্ট, টপ মডেল, টিউন ফ্যাক্টরি, টেলি কুইজ, টোটাল স্পোর্টস, ট্রাভেল অন, ডক্টরস চেম্বার, ড্যান্স ফর ইউ, নিউজ আওয়ার, নিউজ আওয়ার এক্সট্রা, নিউজ অ্যান্ড ভিউজ, নিউজ টুয়েন্টি ফোর, পাপেট শো, প্রিংকস অ্যান্ড ডেজার্ট, ফিফটি মিনিটস, ফেইস টু ফেইস, বিউটি টাইম, বিজনেস টক, বিজনেস ভিশন, বিজিদের ইজি শো, বিটস আনলিমিটেড, ব্রাইডল শো, মার্কেট ট্রেন্ড, মিউজিক ট্রেন, মিউজিক বক্স, মিউজিক্যাল লাউঞ্জ, মিট দ্য মেকার্স, মিডিয়া গসিপ, রিপোর্টাস ডায়রি, লাইফ স্টাইল, লিড নিউজ, লুক অ্যাট মি, শপারস গাইড, শপিং অ্যান্ড কুকিং, সিনেমা এক্সপ্রেস, সিনে হিটস, সেলিব্রেটি সিক্রেট, স্টার্স ফান, স্টুডিও কনসার্ট, স্পোর্টস টাইম, স্পোর্টস টুয়েন্টি ফোর, স্পোর্টস ডেইলি, স্পোর্টস ভিশন, হাই লাইভ, হাউস ফুল ইত্যাদি। এ থেকেই কি বোঝা যায় না যে, বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমে বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতির ওপর ইংরেজির আগ্রাসন কী ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে? অন্যদিকে টিভির অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়ও কোনো কোনো গণমাধ্যমের বাংলা ভাষার প্রতি রয়েছে মারাত্মক উন্নাসিকতা। সেসব টিভির উপস্থাপক-সঞ্চালকরা শ্রোতা-দর্শকদের ‘প্রিয় শ্রোতা’ বা ‘প্রিয় দর্শক’ বলে সম্বোধন করতে সংকোচ বোধ করেন, তাঁরা বলেন ‘ডিয়ার ভিউয়ার্স’, ‘ডিয়ার লিসেনার্স’। তাঁরা কখনো গান বাজিয়ে শোনান না, সব সময় ‘সং প্লে’ করেন। কোনো কোনো টিভি নাটকের সংলাপও ভাষা বিকৃতিতে ভূমিকা রাখছে। এ ধরনের নাটকের পাত্রপাত্রীদের সংলাপের প্রভাবে তরুণদের মধ্যে চালু হয়েছে এক ধরনের ডিজ্যুস বোলচাল। তাঁরা ‘অসাধারণ’ না বলে বলেন ‘অ’সাম’, ‘খুব সুন্দর’ না বলে বলেন ‘জোশ’, ‘খুব ভালো’ না বলে বলেন ‘হেব্বি’। তাঁরা অথবা তাঁদের পেছনের কুশীলবরা ইচ্ছাকৃতভাবে জগাখিচুড়ি বাংলিশ ভাষারীতি তৈরির এবং নতুন প্রজন্মকে বুলিমিশ্রণে প্ররোচিত করায় সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। বাংলা শব্দ ভা-ারে উপযুক্ত শব্দ থাকলেও কথায় কথায় ইংরেজি বাকভঙ্গি ও পদবন্ধ ঢুকিয়ে দেওয়ায় তাঁরা তৎপর। তাঁরা ‘যাহোক’ না বলে বলেন ‘অ্যানি ওয়ে’ , ‘প্রসঙ্গত’ না বলে বলেন ‘বাই দি ওয়ে’, ‘চমৎকার’ না বলে বলেন, ‘একসেলেন্ট’। এমনিভাবে তাঁদের কথায় অবলীলায় স্থান পায় ‘এক্সকিউজ মি’, ‘গুড জব’, ‘টাইম নাই’, ‘সাইড দেন’ ইত্যাদি প্রয়োগ। বুলিমিশ্রণে ভুল প্রয়োগেরও ছড়াছড়ি ঘটে। যেমন : আমাকে ফোন দিও। (ফোন করার বদলে ফোন দান করা?), ওর বিহেভ ঠিক না। (বিহেভ ক্রিয়াপদ; হওয়া উচিত : বিহেভিয়া’, ওকে লট অফ রিমাইন্ড দিয়েছি। (হবে : আ লট অফ রিমাইন্ডার) অনেক বুদ্ধিজীবী দৈনন্দিন কথোপকথনে, টেলিভিশনের আলাপচারিতায়, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে বিবেচনাহীনভাবে ইংরেজি শব্দের মেশাল দেন। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে, সম্পাদকীয়তে, কলামে ও প্রবন্ধ-নিবন্ধেও বাংলা হরফে ইংরেজি শব্দ অবাধে স্থান করে নিচ্ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন যাঁরা বাংলা ভাষা নিয়ে এত ভাবেন তাঁরা ‘টেলিভিশন’, ‘কম্পিউটার’, ‘ব্যারিস্টার’ ইত্যাদি শব্দ বাংলায় ব্যবহার করেন কেন? এ প্রশ্ন আসলে বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক। প্রকারান্তরে এর পেছনে ইংরেজিয়ানা লুকিয়ে আছে। তবে এ প্রশ্নের উত্তর হল, বাংলা ভাষা এত রক্ষণশীল নয় যে তাতে বিদেশি শব্দ ব্যবহার একেবারেই চলবে না। আসলে যে ধারণা বা ধারণা-প্রকাশক শব্দ বাংলায় নেই সেসব ধারণা প্রকাশের জন্যে বিদেশি শব্দ গ্রহণ করতে কারো আপত্তি থাকার নয়। বাংলা ভাষায় ইংরেজি ভাষাসহ অন্যান্য ভাষা থেকে আগত এমন অসংখ্য শব্দ গৃহীত হয়েছে। পারিভাষিক শব্দ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে বাংলা অভিধানে স্থান পেয়েছে বহু বৈভাষিক শব্দ। কিšুÍ যে শব্দ বাংলায় আছে তাকে উপেক্ষা করে তার বদলে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হলে তাতে আপত্তি ওঠা অবশ্যই সঙ্গত। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ইংরেজিয়ানা। সড়ক ও সড়ক-সংলগ্ন স্থানের নামকরণে রোড, হাইওয়ে এভিনিউ, স্কোয়ার, স্ট্রিট, হাইওয়ে প্লাজা ইত্যাদি সর্বত্রই চোখে পড়ে। পরিবহনের নামের বেলায় ট্রান্সপোর্ট, গেইটলক, সিটি সার্ভিস, অল দ্যা ওয়ে ফার্স্ট ক্লাস, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি ব্যবহার ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দোকানের নামের ক্ষেত্রে শপ, শপিং কমপ্লেক্স, শপিং মল, শপিং সেন্টার, এমপোরিয়াম, বুটিক হাউস, চেইন স্টোর, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মেগাশপ, সুপার শপ, রেস্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুড শপ, ফার্মেসি, স্টোর, সেলস কর্নার, সেলস সেন্টার ইত্যাদি শব্দের ছড়াছড়ি। বাসার নামের বেলায় ম্যানশন, লজ, ভিলা, হাউস, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি অহরহ চোখে পড়ে। এসব কখনো কখনো বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়, তবে ভাষা ইংরেজি। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও ইংরেজিতে। এ দেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হয়ে গেলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণে ‘ভিক্টোরিয়া’, ‘কুইনস’, ‘রয়্যাল’ ইত্যাদি নামের মহিমার প্রতি এ দেশের এক শ্রেণির লোকের আনুগত্য এখনো বহাল রয়েছে। বাংলা ভাষায় ইংরেজির যে মিশ্রণ ঘটছে তাকে বাংলিশ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে এক শ্রেণির বেতার মাধ্যম। কোনো কোনো এফ এম রেডিওতে যে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয় তার শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ ইংরেজি ভাষার শব্দ। এফ এম বেতারগুলোর বাংলিশ ভাষার উৎকট ও ব্যাপক ব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণ ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি চলছে অদ্ভুত ধরনের উচ্চারণবিকৃতি। বাংলা উচ্চারণকে বিকৃত করে এক ধরনের ‘ডিজ্যুস’ উচ্চারণ চালু করায় উঠে পড়ে লেগেছে এক শ্রেণির তরুণ। ইংরেজিয়ানা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সচেতনভাবে। তারা ‘আমাদের’ উচ্চারণ করে ‘আমাদেড়’, ‘রেডিও’-ও বদলে বলে ‘ড়েডিও’। তাদের বাংলা বুলিতে তারা ব্যবহার করে ইংরেজি উচ্চারণভঙ্গি। তার অনুকরণ ও অনুসরণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে। কম্পিউটার ও মোবাইলফোনে বাংলা ফন্টের ব্যবহার শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের বাধ্য হয়ে হয় ইংরেজি ভাষায়, না-হয় বাংলা কথাকে ইংরেজি হরফে লিখে বৈদ্যুতিনবার্তা (ই-মেইল), খুদে বার্তা (এস এম এস) লিখতে হয়েছে। তাও পরোক্ষে ইংরেজি আধিপত্যের নামান্তর। এছাড়া আমাদের অনুষ্ঠানমূলক সংস্কৃতিতেও বিদেশিয়ানাকে সাড়ম্বরে জায়গা করে দিচ্ছি আমরা। বাংলা গানের ভাবসম্পদকে লালন না করে বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে, বাসে-রেস্তোরাঁয় ইংরেজি-হিন্দি গান বাজানো হচ্ছে হরদম। সাম্প্রতিক কালে আর একটা বিশেষ লক্ষণীয় ব্যাপার ঘটছে বিয়ে, জন্মদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। এসব অনুষ্ঠানে কোনো বিদেশি অতিথি থাকেন না। তবু নব্বই শতাংশ আমন্ত্রণপত্র তৈরি হয় ইংরেজি ভাষায়। এ প্রবণতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাঙালির একটা অংশ ক্রমেই হয়ে পড়ছে বাংলিশ সংস্কৃতির ধারক-বাহক। তার প্রভাব পড়ছে সাধারণ বাঙালির জীবনেও। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও মাদ্রাসাগুলিতে প্রমিত বাংলা ভাষার চর্চা নেই বললেই চলে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলা ভাষা বলতে গেলে পুরোপুরি উপেক্ষিত। দেশের মাটিতে জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি এদের অন্ধ আকর্ষণ এবং লেখায় ও বাচনে প্রমিত বাংলা ব্যবহারে এদের অদক্ষতা বাংলা ভাষার প্রতি চরম উপেক্ষারই প্রকাশ। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষা এক ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×