ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইফতেখার আহমেদ খান

অভিমত ॥ দহন কালের রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অভিমত ॥ দহন কালের রাজনীতি

বাংলাদেশের মানুষকে পুড়ে মারা হচ্ছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পেশাজীবী, ছিন্নমূল, ধনবান থেকে শুরু করে পথের ভিখারী সকল জনতা পুড়ে মরার আশঙ্কায় ভীত এক অদ্ভুত আঁধার ঘিরে ধরেছে বাংলাদেশকে। পেট্রোলবোমায় ঝলসে যাওয়া শরীর কদাকার রূপ ধারণ করেছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার ও এ দেশীয় রাজাকাররা এভাবেই নিরীহ মানুষদের পুড়ে মারত। যে কোনভাবেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দুর্বার গতিরোধ করাই ছিল সেই পুড়িয়ে মারার কারণ। এতদিন পরে আবার তারা এ দেশের মানুষদের সেভাবেই পুড়ে মারছে। তারা তাদের মৌলিক চরিত্র হতে একটুও সরে আসেনি। এই পুড়ে মারার মূল কারণ বিশ্লেষণে এর অতীত প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। রাষ্ট্রীয় জীবনের এই দুর্দশার মূল কারণ নিহিত আছে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির অব্যবহিতকালে। কষ্টটা এখানেই যে; একই কারণ এখনও বিরাজমান এবং যা এখনও রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষ উপলব্ধি করতে অক্ষম। রাষ্ট্রের একটি মৌলিক সংজ্ঞা এমন : State is the formal structure of society with central authority. অর্থাৎ কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সহযোগে সমাজের আনুষ্ঠানিক কাঠামোই রাষ্ট্র। সেই অর্থে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র; যার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস এবং একটি সমৃদ্ধ অভ্যুদয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক ও জ্ঞানভিত্তিক ঘটনা। উল্লেখ্য, জ্ঞান স্থির কোন বিষয় নয়। সময়ের পরিক্রমায় জ্ঞানের আদল রূপান্তর হয়। বস্তুত দেখার বিষয়টি স্বতন্ত্র হলেও সময় বাস্তবতাজনিত কারণে যে বিষয়টি জ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তা সকলকে অভিন্ন চোখ দিয়েই দেখতে হবে। যদিও মানুষ প্রায়োগিক দিককেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং বলে থাকে তত্ত্ব হচ্ছে কল্পনা। পাঠক, যদি তাই হয় তাহলে বলা যায় সেই আদিকালের প্লেটোর একাডেমি থেকে শুরু করে আজ অবধি যত একাডেমি হয়েছে সেখানে কল্পনা চর্চাই চলে আসছে। বলা প্রয়োজন এই কল্পনা ভাঙলে যার প্রকাশ ঘটে তাই বাস্তবতা। বাস্তবতা হচ্ছে আলো আর সূর্য হচ্ছে তার তত্ত্ব। সূর্য না থাকলে আলো হবে না। আবার আলো না দিলে সূর্যের মূল্য কোথায়। একটি আরেকটির সহজাত। এইভাবে দেখলে তত্ত্বের গুরুত্বটা কি বোঝা যায় না? যে কোন সার্বভৌম দেশের একটি সংবিধান থাকে এবং কোন দেশের সংবিধান কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির রচনা নয়। সংবিধান একটি দেশের উপরিকাঠামো (Superstructure); যার মধ্যে সেই দেশের পরিচালন পদ্ধতি, স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসসহ জনমানসের চেতনার প্রতিফলন থাকে। এই চেতনা একদিন, দু’দিন, তিন দিনের নয়। এই চেতনা ইতিহাসের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। উত্তম সংবিধান মূলত সেইটা যেখানে জনচেতনার প্রকাশ থাকে। সামন্ত শাসনের পরবর্তী আমাদের আধুনিক শাসন ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী চেতনা। মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব। গণতন্ত্র মূলত সেই ব্যবস্থা যা রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। সেই রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও গঠন এবং দলভুক্ত হওয়ার বিষয়টি জাতিধর্মবর্ণ, জাতপাত, ধনী-গরিব, ধর্ম-অধর্ম নির্বিশেষে সর্বজনীন। রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়ের ফলে রাজার ছেলে রাজা হওয়ার নিয়মের যবনিকা ঘটে। যে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি যে কোন দল গঠন করতে পারে গণতান্ত্রিক দেশে। এই যে কোন শব্দটি কিন্তু শর্তসাপেক্ষ। এই শর্ত দার্শনিক বাস্তবতায় নির্মিত। এই দর্শনই চেতনা, যা গড়ে ওঠে ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারায়। অতীত অভিজ্ঞতা বিষয়টি এখানে শক্ত নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। যেমন, আধুনিক যুগের পূর্বের যুগটা ছিল মধ্যযুগ, যখন চিন্তার জগত ছিল অন্ধকারময়। ব্যবহারিকভাবে ব্যক্তিজীবন সমাজজীবন, রাষ্ট্র্রীয়জীবন এবং তত্ত্বীয়ভাবে রাজনীতি বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা; সব কিছুরই বিকাশ সে সময় রুদ্ধ হয়ে ছিল। সমগ্র মধ্যযুগ ধর্মের অপব্যখ্যায়, ধর্মীয় কুসংস্কারে তলিয়ে ছিল অন্ধকারের তিমিরে। পীর-ফকির, তাবিজকবজ, ঝাড়ফুঁক, যুক্তিহীনতা, রহস্যময়তা ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয়জীবনে আধিপত্য বিস্তার করে স্থান করে নিয়েছিল। কালক্রমে মানুষের চেতনায় পরিবর্তন আসতে থাকে। মানুষ যুক্তিশীল হয়ে উঠতে থাকে এবং ধর্মের প্রকৃত বিধান ও প্রয়োগ যুক্তির মানদণ্ডে বিচারের প্রয়াস পায়। চেতনার এই নব রূপায়নে সমকালীন দার্শনিকগণ বিশেষ ভূমিকা নেন। তারা জনসচেতনতার বিচ্ছিন্ন অংশগুলো একত্রিত করে পূর্ণ অর্থ তৈরি করেন। এটাই হলো তত্ত্ব। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। এই তত্ত্বের মূল কথা হলোÑ হিন্দু-মুসলমান ভারতবর্ষে দুটি জাতি, যাদের বাস একসঙ্গে সম্ভব নয়। পাকিস্তান মুসলমানের ভারত হিন্দুর। শুধু তাই নয়, এই দুই ধর্মের সদস্যগণ পরস্পরকে হত্যা করাকে ইমানী দায়িত্ব মনে করল। লাশ আর রক্তের স্রোতে দুই দেশ ভাগ হলো। কোটি কোটি মানুষ বাস্তু ত্যাগ করে অভিবাসন করল নিজ বাসভূমি ছেড়ে। পূর্বেই আমি উল্লেখ করেছি, রাজনৈতিক দল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সন্নিবেশ করে। মুসলিম লীগ বৃহৎ জনগণের স্বার্থের সন্নিবেশ করেনি। কারণ, সেখানে মুসলমানবিহীন অন্য কোন ধর্মের লোকের প্রবেশ ছিল না। বৃহত্তর জনগণ বলতে সকল জনগণকে বোঝায়। অর্থাৎ মুসলিম লীগ বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের সন্নিবেশ না করে বরং বিভাজন ঘটিয়েছে, সুতরাং আধুনিক ভাবনায় মুসলিম লীগ পরিত্যাজ্য। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়কালের পাকিস্তানী শাসনটি ছিল মধ্যযুগের শাসন। রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়। কারণ, তিনি হিন্দু। বাংলা পরিত্যাজ্য হয়। কারণ, হিন্দু ব্যক্তিদের দ্বারা এর বিকাশ লাভ হয়েছে। এইসব অনাচার আর অযুক্তির প্রতিবাদ হচ্ছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন সেই পাকিস্তানী শাসকগণ ও এদেশীয় রাজাকাররা মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল, নারীদের ধরে নিয়ে সম্ভ্রমহানি করেছিল আর বলেছিল এসব কাজ হচ্ছে ধর্ম রক্ষার জন্য। গণতান্ত্রিক সমাজে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়া একটি রীতি। সরকারের কোন নীতি- সিদ্ধান্ত ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত গঠন হতে পারে। এজন্য এটা গণতন্ত্র। কথা হলো, নিরীহ মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে মারা কেন। বিএনপি-জামায়াতের এই হত্যাযজ্ঞ নিছক নির্বাচনের জন্য নয়। এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাসহ বাঙালীর বাংলাদেশের সকল আধুনিক আর বিধিসম্মত নীতির বিলোপ সাধন করে পুনরায় সেই পাকিস্তানী নীতিভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠা। এই প্রচেষ্টার প্রকাশে আজ পুড়ে মরে বাংলাদেশ; যেমন পুড়ে মরেছিল ১৯৭১ সালে। লেখক : উন্নয়নকর্মী ও গবেষক [email protected]
×