ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণ সন্ত্রাস এবং নাশকতার দমন চায়

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

জনগণ সন্ত্রাস এবং নাশকতার দমন চায়

॥ ১ ॥ সংলাপ এবং সমঝোতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। পত্রিকা, টকশো, সুশীল সমাজের বক্তৃতা, বিজ্ঞজনের প্রবন্ধ- সর্বত্র একই কথা, একই আকাক্সক্ষাÑ দু’দলের সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমেই বর্তমান সঙ্কট নিরসন করতে হবে। সংলাপ-সমঝোতার প্রয়োজীয়তা নিয়ে এমনি এক টকশোতে একজন আলোচক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সংলাপ কী নিয়ে হবে’? অন্য আরেকজন উত্তর দিলেন, ‘বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে।’ এই বক্তব্যে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। এবার ‘বিতর্কিত বিষয়গুলো’ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এ বছর জানুয়ারির প্রথম দিকে ঘোষিত বেগম জিয়ার ৭-দফার মূল দাবি : ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন; খ. আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ; গ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান। প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করলেও এ দাবি প্রকৃতপক্ষে বিএনপির নহে; ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি তোলে; বিএনপি এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। জনগণের সমর্থন এবং আওয়ামী লীগের চাপাচাপিতে এই পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ইতিপূর্বে একাধিকবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্টকে কলুষিত করেছেÑ তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্টের প্রতি কারও কারও সমর্থন থাকলেও বিএনপিকে এই কনসেপ্টের চ্যাম্পিয়ন মনে করা যায় না; বিএনপি এটাকে আবার অপব্যবহার এবং কলুষিত করবে নাÑ সেটাও নিশ্চিত না। তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের প্রতিটি নির্বাচন পরাজিতশক্তি কর্তৃক বিতর্কিত হয়েছে, বিএনপি দ্বারাও। তাই এটাকে নির্ভেজাল সিস্টেম মনে করা যায় না। চতুর্থত, বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর বাহন হয়েছে এবং হরতাল-অবরোধের নামে জামায়াতে ইসলামী ও জঙ্গীবাদীরা ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনা করছে। ॥ ২ ॥ এবারে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের বিষয়টি। এক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৪টি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন হয়নি; এবং বিএনপিবিহীন নির্বাচন তাঁরা মানেন না। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিরোধী দল নির্বাচনে থাকলে এমনটা হতো না। বিরোধীরা নির্বাচনে এলো না, এটা তো আমাদের দোষ না’ সাধারণ মানুষ এই কথাটাই বুঝতে পারেন, গণতন্ত্রের তত্ত্বগত দিক বোঝেন না। কোন কোন বিজ্ঞজন বলেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র শতকরা ১৫-২০ জন ভোট দিয়েছেন; তাঁরা ভুল গড় হিসাব বলেন। সরকারী হিসাব বাদ দিলেও নিরপেক্ষ পর্যালোচকদের হিসাব অনুযায়ী ভোটের হার ৩৭ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ হবে। শুধু বিএনপি কর্তৃক বর্জনই নয়, প্রচ- বাধা-বিপত্তি, ভয়-ভীতি এবং নাশকতায় ও ভোটের এই সংখ্যা প্রশংসনীয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনবিরোধীরাও এই নির্বাচনকে সংবিধানবিরোধী বা বেআইনী বলতে পারেন না। সব মিলিয়ে জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সমর্থন করেন না। শেখ হাসিনা জাতীয়ভাবে দেশের ব্যাপক জনগণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং সংস্থাদের বিশ্বাস করাতে সমর্থ হয়েছেন যে, তিনি সাংবিধানিকভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে দেশে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াকে চালু রেখেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না করে বিএনপি এদেশে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। জাতীয় নির্বাচন বানচাল করার জন্য তারা যা করেছে তা সন্ত্রাসী এবং অগণতান্ত্রিক কাজ। বিএনপি আসলে গণতন্ত্রের পক্ষে নয়, শুধু ক্ষমতায় বসতে আগহীÑ যে কোনভাবেই হোক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপি এবং জবরদস্তি করে জয় ছিনিয়ে নেবেÑ বিএনপির অভিযোগ এবং আশঙ্কা সঠিক নয়। বিএনপি এমনটা ভাবে কারণ তারা নিজেরা মাগুরার নির্বাচনে জবরদস্তি করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং দেড় কোটি ভুয়া ভোটার বানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের দাবিÑ কোনরূপ অভিযোগ ছাড়াই তাদের আমলে ৫টি সিটি কর্পোরেশনসহ মোট ৫,৮০৩টি নির্বাচন সুচারুভাবে অনুষ্ঠিত করে তারা প্রমাণ করেছে যে, তাদের সরকারের আমলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সর্বোপরি বিএনপি জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসকে অতীতেও লালন-পালন করেছে, ভবিষ্যতেও করবে; অপরপক্ষে আওয়ামী লীগ জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসকে নির্মূল করার চেষ্টা করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। সকলেই জানে যে, জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসের বিষয়ে আন্তর্জাতিক দেশ ও সংস্থাসমূহ খুবই উদ্বিগ্ন। তাই বর্তমান হরতাল-অবরোধের প্রতি দেশের সব জনগণের এবং আন্তর্জাতিকভাবে উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং সংস্থাসমূহের সমর্থন নেই। ॥ ৩ ॥ এ কথা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে, সন্ত্রাস এবং নাশকতা দমন করে অবিলম্বে দেশে স্বাভাবিক জনজীবন ফিরিয়ে আনতে হবে। জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং স্বাভাবিক জনজীবন নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব এক্ষেত্রে কোন অজুহাত বা অন্যকে দোষারোপ জনগণ মানবে না। দেশের এ সঙ্কট উত্তরণের জন্য যা প্রয়োজন সরকারকে তাই করতে হবে। জনগণ সরকারের সকল যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ সমর্থন করে। কিছুদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হবে। এর কয়েকদিন পর আরেক নেতা বললেন, জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এ প্রসঙ্গে বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার দুটি অনলাইন মতামত জরিপের ফলাফল উল্লেখ করছিÑ শতকরা ৭০ জনের বেশি ভোটদাতা মনে করেন সরকার আরও কঠোর হলে সহিংস অবস্থার নিরসন হবে (‘প্রথম আলো’, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫)। শতকরা ৭২ জনের বেশি ভোটদাতা মনে করেন আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে আইনমন্ত্রীর নির্দেশ যৌক্তিক (‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে যে, অনেক সময় ইতোমধ্যেই পার হয়ে গেছে, সকলেই সহ্য এবং ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। সরকারযদি সন্ত্রাস এবং নাশকতা দমন করতে ব্যর্থ হয়, অবিলম্বে স্বাভাবিক জনজীবন ফিরিয়ে আনতে না পারে, তাহলে সরকারের অক্ষমতাই প্রমাণিত হবে এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং সংস্থাসমূহ সরকারকে অকার্যকর ভাববে। এটা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হবে। পরিশেষে আরেকটি অনলাইন মতামত জরিপের ফলাফল উল্লেখ করছি। শতকরা প্রায় ৮০ জন ভোটদাতা মনে করেন সরকারকে রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে (‘প্রথম আলো’, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেই হোক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা দিয়েই হোক, সন্ত্রাস এবং নাশকতা দমনের সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান/সমঝোতা করতে হবে। এটি কেবল আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তির অংশগ্রহণের মাধ্যমে, জাতীয় ভিত্তিতে একটি নাগরিক চার্টার প্রণয়ন করে এটা করা যেতে পারে। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এই ধরনের জাতীয় সংলাপে নিম্নলিখিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে : সকল প্রকার নাশকতা-সহিংসতা পরিহারে জাতীয় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং সকল প্রকার ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা না করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা। সাংবিধানিক রীতিনীতি সমুন্নত রাখা এবং সংবিধান ও আইনের কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করা। হয়রানিমূলক রাজনৈতিক গ্রেফতার না করা এবং নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত না থাকলে শুধু রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার উপযোগী নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষমতার আওতা নির্ধারণ এবং নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয়ভাবে শক্তিশালী করা। যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধের অপরাধের দ্রুত বিচার সম্পন্ন এবং রায় বাস্তবায়নে অভিন্ন জাতীয় অবস্থান গ্রহণ করা এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। লেখক : প্রকৌশলী, প্রাবন্ধিক
×