ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংঘর্ষ কোন্দলের নেপথ্যে

অছাত্র, গ্রুপিং ও একক আধিপত্যে চবি ছাত্রলীগ বেপরো

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অছাত্র, গ্রুপিং ও একক আধিপত্যে চবি ছাত্রলীগ বেপরো

মোয়াজ্জেমুল হক/রহমান শোয়েব, চবি ॥ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ রাজনীতির একক আধিপত্য। মৌলবাদী শিবির চক্র ক্যাম্পাস ছাড়া। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক শক্তি একেবারেই দুর্বল। ফলে ছাত্রলীগ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ক্যাম্পাস রাজনীতি। অথচ এই ছাত্রলীগ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়ে আছে। সংঘর্ষ, হত্যা, দলাদলি, গ্রুপিংসহ নানা কারণে এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব আচরণের জের হিসেবে এই ছাত্রলীগ গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে অছাত্রদের সমন্বয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে অসুস্থ রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চয়তায় পড়ছে, তেমনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনছে। গত রবিবার ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং অছাত্র, বহিরাগত এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নতুন করে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপকর্মের ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে এসে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিনের জন্যও বন্ধ দেখতে চান না বলে ছাত্রলীগের গ্রুপিং দ্বন্দ্ব নিরসনের নির্দেশ দিয়েছেন। এর দু’দিনের মাথায় নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, চবি ভিসি অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ ও বিবদমান ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করেন। এরপর থেকে কিছুদিন সহাবস্থান পরিলক্ষিত হলেও গত ১৪ ডিসেম্বর বিবদমান গ্রুপের মধ্যে এক গ্রুপের গুলিতে নিহত হন সিএফসি গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার। এর পর থেকে ভেতরে ভেতরে গ্রুপিং তৎপরতা আবারও মাথাছাড়া দিয়েও উওঠে। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে বিশ্বাসে যেমন আনতে পারছে না তেমনি কেউ কাউকে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে দিতেও নারাজ। ফলে প্রায়শ এক গ্রুপের নেতাকর্মী আরেক গ্রুপের নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে অশ্লীল বাক্যে জর্জরিত করাসহ হাতাহাতি এবং নানা ধরনের অপ্রীতিকর কিছু ঘটনাও ঘটে যায়। সর্বশেষ রবিবারের দু’পক্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে তাপস হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে এক গ্রুপের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ছাড়া হয়। রবিবার সকালে পালিয়ে থাকা নেতাকর্মীরা আকস্মিকভাবে হল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অবস্থান নিলে সহিংসতার জন্ম নেয়। এ ঘটনায় হলে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ৬৪ জনকে গ্রেফতার করে; যাদের মধ্যে অনেকে পরীক্ষার্থী। এ গ্রেফতার নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, চবি প্রশাসন ছাত্রলীগের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টির বিরুদ্ধে কড়া কোন পদক্ষেপ গ্রহণ কখনও দৃশ্যমান হয় না। সর্বোচ্চ ভাইস-চ্যান্সেলরের পদটিও রাজনৈতিক নিয়োগের ঘেরাটোপে থাকায় বর্তমান সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অছাত্র ও বহিরাগতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলেও জোরালো অভিযোগ রয়েছে। চবিতে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের অনেকের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত এসব ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যা বেরিয়ে এসেছে তাতে পাওয়া গেছে ঘটনার নেপথ্যের মূল ৭টি কারণ। এর মধ্যে রয়েছেÑ নেতৃত্বের পদ নিয়ে লড়াই, অছাত্রদের ছড়াছড়ি, বগিভিত্তিক গ্রুপ উপ-গ্রুপে বিভক্ত থাকা, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষক রাজনীতিও জড়িয়ে পড়া, টেন্ডারবাজি এবং পদ-পদবির জন্য প্রশাসনের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থায় থাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতি মূলত আওয়ামী লীগ মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দিনকে ঘিরে। কিন্তু এ ছাত্রলীগ এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের এসব নেতার অজান্তে- অলক্ষে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যত অপকর্মের দায়ভার বর্তায় এ দুই নেতার স্কন্ধে। এ ব্যাপারে জনকণ্ঠের প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অছাত্র ও বহিরাগতদের যতদিন ক্যাম্পাস ছাড়া করবে না ততদিন এ অবস্থার জন্ম হতে থাকবে। বিভিন্নভাবে চবি প্রশাসনকে অনুরোধ করা হলেও কোন রহস্যজনক কারণে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে না, তা তার অজানা বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি আ জ ম নাছির উদ্দিনও জানিয়েছেন অছাত্র ও বহিরাগতরা টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত। আধিপত্য বজায়ের জন্য মরিয়া। এরাই ছাত্রলীগের সাধারণ নেতা ও সদস্যকে ব্যবহার করছে। ফলে পুরো ছাত্রলীগের কর্মকা- আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চবি প্রশাসন কেন রহস্যজনক অবস্থানে থাকে তা তারও অজানা বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি চবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মঞ্জুর আলম মঞ্জুও দাবি করেছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের এসব ঘটনার জন্য নেতাকর্মীরা যে পরিমাণ দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী প্রশাসন। তার ভাষায় প্রশাসনের অবস্থা দেখলে মনে হয় না এরা কি পুরুষ না মহিলা। টেন্ডার বাণিজ্য ॥ অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে চবিতে ৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে কলা অনুষদ ভবন-২ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নির্মাণ কাজ। এর আগে সম্পন্ন হয়েছে তিনটি উন্নয়ন কাজ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবন, ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যয়ামাগার (জিমনেসিয়াম) ও ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা হলের নির্মাণ কাজ। সত্বরই প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সংখ্যালঘুদের জন্য দুটি হল এবং ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে চবির চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের টেন্ডার আহ্বান করার কথা। ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন ভার্সিটি এক্সপ্রেস নিজেদের নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুসারি দাবি করলেও তারা মূলত চবি ছাত্রলীগের সাবেক কয়েক নেতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বগিভিত্তিক দুটি সংগঠন ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও সিএফসি গ্রুপ নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম ব্যবহার করে নিজেদের অপকর্ম ও স্বার্থ হাসিলে লিপ্ত। অথচ নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের চবি ছাত্রলীগের অপরাজনীতির সঙ্গে নয় বলে তাদের দাবি রয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি নির্মাণ কাজের কন্ট্রাক্ট পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা হলের সাব-কন্ট্রাক্ট, জিমনেসিয়াম, কলা অনুষদ ভবন-২ ও জীববিজ্ঞান অনুষদের ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি কাজ। এসব কাজের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ভিএক্স গ্রুপ সদস্য না থাকায় শীঘ্রই যে ৩৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হবে তা হাত ফসকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এই নেতাদের। ফলে তারা ভিএক্সকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রলীগের একটি অংশ। নেতৃত্বের লড়াই ॥ বর্তমানে চবি ছাত্রলীগ চলছে অভিভাবকহীন তথা নেতৃত্বহীন। কমিটি না থাকায় উঠতি নেতাদের যেমন বাম্পার অবস্থা তেমনি সিনিয়ররাও কমিটির পদ পেতে মরিয়া। গত বছরের জুন মাসে ছাত্রলীগের কোন্দলে অতীষ্ঠ হয়ে চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর আগে চাঁদাবাজির অভিযোগে সভাপতি মামুনুল হককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তারই অনুসারীরা। আর সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে বিয়ে করে নিজ সংসার ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। এ অবস্থায় নতুন কমিটিতে পদ পেতে উঠেপড়ে লেগেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। নিজেদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে জাহির করতে কর্মীদের নিয়ে প্রায়ই শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় নেমে পড়ে সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলো। আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হামলা-মামলা তো রয়েছেই। কে কাকে ঘায়েল করে নতুন কমিটিতে নিজের কাক্সিক্ষত পদটি নিশ্চিত করবে সেই চেষ্টায়ই যেন চবি ছাত্রলীগের এখন প্রধান লক্ষ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএফসি গ্রুপ নেতা মোঃ সুমন মামুন লড়ছেন সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য। আর ভিএক্স গ্রুপ নেতা এস.এম. আরিফুল ইসলামও একই পদের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ক্যাম্পাস থেকে একটি পক্ষকে বিতাড়িত করতে পারলে অপর পক্ষের জন্য এই পদ পেতে কোন সমস্যা হবে না- এমন ভাবনাতেই এই দুটি পক্ষের নেতারা বার বার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়ে সিএফসি নেতা ও সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মোঃ সুমন মামুন বলেন, ‘এখানে সবারই রাজনীতি করার অধিকার আছে। এখানে প্রতিযোগিতার রাজনীতি হবে তবে প্রতিহিংসার না। আর কেন্দ্র যাকে যোগ্য মনে করবে তাকে কমিটিতে পদ দেবে, এটা কেন্দ্রের এখতিয়ার।’ এ বিষয়ে ভিএক্স নেতা ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এস.এম. আরিফুল ইসলামের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া না যাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। অছাত্রদের ছড়াছড়ি ॥ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন চিহ্নিত ১৩ অছাত্র নেতা। এদের মধ্যে সিএফসি গ্রুপে রয়েছেন, অমিত কুমার বসু, এএম শাহাদাত হোসাইন জুয়েল, মোঃ সুমন মামুন, এসএম আলাউদ্দিন আলম, রাকিব হোসেন ও মোহাম্মদ ফারুক। আর ভিএক্স গ্রুপের মধ্যে রয়েছেন, আরিফুল ইসলাম, জালাল আহমেদ, হাবিবুর রহমান রবিন, রুপন বিশ্বাস, সরোয়ার পারভেজ জনি, আশরাফুজ্জামান আশা ও শফিক আহমেদ। এদের কেউ কেউ দুই বছর আগে আবার কেউ কেউ দেড় বছর আগে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে এখন ফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। ছাত্র রাজনীতির দোহাই দিয়ে নিয়মিত হলেও থাকছেন কেউ কেউ। এদের মধ্যে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর তাপস হত্যাকা-ের পর ভিএক্সের অধিকাংশ নেতাই ক্যাম্পাসে আসে না। কেউ কেউ আছেন আত্মগোপনে। এ বিষয়ে অমিত কুমার বসু বলেন, দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠকে বাণিজ্যভূমি বানানোর জন্য মূল ধারার ছাত্রলীগকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অংশ তাপসের খুনীদের ক্যাম্পাসে পুনঃপ্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা। আর এ চক্রান্ত প্রতিহত করার একজন বৈধ শিক্ষার্থীকে কিভাবে বহিরাগত বলা যায় তার প্রমাণ ও ব্যাখ্যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই দিতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে এলাকাবাসী ও অছাত্রদের ক্যাম্পাসে অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র করে দিয়েছে এ সকল নেতা। নিজেদের শক্তিসামর্থ্য প্রদর্শনে প্রায়ই আশপাশের এলাকার লোকজন ও অছাত্রদের কৌশলে নিজেদের মিটিং- মিছিলে হাজির করছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে প্রায়ই স্থানীয়দের হাতে হেনস্থা হন প্রতিপক্ষ ছাত্রনেতাসহ সাধারণ শিক্ষার্থী। সর্বশেষ স্থানীয়দের হাতে হেনস্থা হন সিএফসি নেতা ও সাবেক সহ-সভাপতি এ.এম. শাহাদাত হোসাইন জুয়েল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্থানীয়দের এমন নগ্ন হস্তক্ষেপ অতীতে কখনও দেখা যায়নি। গত বছর নবেম্বরে চবির বন্ধ আমানত হল খুলে দিলে ভিএক্স নেতাদের হলে তুলে দিতে নিজেই দলবল নিয়ে সশরীরে হাজির হন চিহ্নিত বহিরাগত ও সাবেক নেতারা। এরপর তাপস হত্যাকা-ের পর স্থানীয়দের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে ভিএক্স কর্মীরা। সর্বশেষ গত রবিবার বিবদমান দুটি গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালীন স্থানীয় কয়েক ভিএক্সের পক্ষে আতঙ্ক ছড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ‘লাল পাহাড়’ এলাকায় ফাঁকা গুলি ছোড়ে বলে অভিযোগ উঠেছে। বগিভিত্তিক গ্রুপ, উপ-গ্রুপে বিভক্ত ছাত্রলীগ ॥ নগর থেকে ২২ কি.মি. দূরে অবস্থিত চবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম শাটল ট্রেন। এ বাহনটির ওপর নির্ভরশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে আসন সঙ্কটের ভোগান্তি চবি শিক্ষার্থীদের নিত্য সঙ্গি। এর মাঝে উটকো ঝামেলা হিসেবে রয়েছে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠনগুলো। শিক্ষার্থীদের আসন সঙ্কটকে পুঁজি করে ছাত্রলীগ চালু করেছে বগি দখলের সংস্কৃতি। ছাত্রলীগের প্রতিটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে শাটল ট্রেনের প্রতিটি বগিকে কেন্দ্র করে। এসকল বগিতে পেছনের দিকের প্রায় ৭০ শতাংশ আসন থাকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দখলে। বগিভেদে এ সংখ্যা হেরফের হয়ে থাকে। যে বগির কর্মী বেশি তাদের আসন দখলের সংখ্যাও তত বেশি। দখলকৃত আসনসমূহে সাধারণ শিক্ষার্থীর বসা নিষেধ। তেমনিভাবে একটি বগির কর্মীর সঙ্গে অপর বগির কর্মীর বাকবিত-ার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও বেধে যায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এসকল সংঘর্ষে পঙ্গুত্ব বরণের পাশাপাশি আহত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। এসব বিষয়ে প্রশাসন একাধিকবার ব্যবস্থা নিলেও কোন সুফল হয়নি। প্রায়ই এখানে চরদখলের মতো বগি দখলের মহোৎসব চলে। একটি বগির সদস্যদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে পারলেই তাদের বগি দখল করে সেখানে রং দিয়ে লিখে দেয়া হয় ‘ফুললি ভ্যানিশ’। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন চবির পরিবহন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বিকুল তাজিম বলেন, সন্ত্রাসীরা যেভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীর অধিকার ক্ষুণœ করে বগি দখল করছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এসকল সন্ত্রাসী এই দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। তিনি অবিলম্বে ক্যাম্পাসে বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি একাকার ॥ চবিতে বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরাসরি একটি পক্ষকে আশ্রয়প্রশ্রয় দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্যাম্পাস বিতাড়িত সেই পক্ষটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রশাসন উঠেপড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, প্রশাসন নিজের জায়গায় নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি। প্রশাসন সকল পক্ষকে সমানভাবে না দেখে একটি পক্ষকে কাছে টেনেছে আর অপরটিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এমনটি চলতে থাকলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে বলেও আশঙ্কা করেন তারা। প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে গৃহপালিত একটি ছাত্রলীগ গড়ে তুলেছে। এ ছাত্রলীগের গ্রুপটি কখনও প্রশাসনের অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। তারা নানাভাবে প্রশাসন থেকে সুযোগসুবিধা নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ করেছে প্রশাসনের একটি অংশ। পাশাপাশি ছাত্রলীগের একটি অংশেরও একই অভিযোগ। গত বছর আগস্টে চবিতে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির সমালোচনা করে বলেন, ‘ছাত্ররা ছাত্রদের মতো রাজনীতি করবে আর শিক্ষকরা শিক্ষকদের মতো। কিন্তু যখন এ দুটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে তখনই বিপর্যয় দেখা দেবে। বর্তমানে চবিতে এ সঙ্কটটিকেই অনেকে বড় করে দেখছেন। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষকদের একটি অংশ প্রশাসনের মদদে ছাত্রলীগের একটি পক্ষকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর বেনু কুমার দে বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কোন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করলে কখনই মেনে নেব না সে যেই পক্ষেরই হোক না কেন। আর আমরা আমাদের প্রতিবাদলিপিতে কোন ছাত্রের নাম উল্লেখ করিনি এবং কোন সংগঠনেরও নাম উল্লেখ করিনি। তাই আমাদের বিরুদ্ধে আনীত এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এদিকে প্রশাসনের ছাত্রলীগের একটি পক্ষকে আশ্রয়প্রশ্রয় দানের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন উপাচার্য প্রফেসর অনোয়ারুল আজিম আরিফ। কিন্তু ছাত্রলীগের দফায় দফায় এসব ঘটনা নিয়ে ভিসি বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোন বক্তব্য কখনও তুলে ধরা হয় না। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যে কমিটির তথ্য সাধারণত আলো দেখে না। ছাত্রলীগের দফায় দফায় এসব ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতই ক্ষুব্ধ যে, রবিবারের ঘটনার পর তিনি আবারও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যে ছাত্রলীগের কারণে দলের দুর্নাম হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে সে ছাত্রলীগের কোন প্রয়োজন তার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল সূত্রে বলা হচ্ছে, অছাত্র, বহিরাগত এবং বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত ও বিভিন্ন মামলার আসামির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা না হলে এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের গ্রুপিং রাজনীতির কারণে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলতেই থাকবে; যা হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনকে বরাবরই পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
×