ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিহতদের পরিবার দিশেহারা ॥ কান্না থামছে না

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নিহতদের পরিবার দিশেহারা ॥ কান্না থামছে না

আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর, পাঁচপীর, কালিরখামারসহ কয়েকটি গ্রামে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় নিহতদের পরিবার-পরিজনের কান্না যেন আর থামছেই না। তাদের মৃত্যুর ৯ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অথচ স্বজন এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলো এখন দিশেহারা। এখন কি করবে তারা। আর কিভাবেই বা কাটবে তাদের আগামী দিনের জীবন-জীবিকা। এসব কারণেই যেন এখনও তারা এই অক্ষম কান্না দিয়েই কষ্টকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অবরোধ-হরতালের নামে সহিংসতা এবং নাশকতায় ঢাকায় কাজের জন্য যাওয়ার পথে গাইবান্ধার তুলসীঘাটে শ্রমজীবী অতিসাধারণ মানুষগুলোকে যেভাবে পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে তা যেন তারা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। নিহতদের স্বজনদের এতো কষ্টেও তাদের একটাই দাবি ওরা ক্ষতিপূরণ চায় না, পেট্রোলবোমা হামলাকারীদের বিচার চায়, চায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আর একটি দাবি তাদের সন্তানদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। সরেজমিনে ওইসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এমন করুণ চিত্র, যা যে কাউকেই বেদনা-বিধুর করে তুলবে। সংসার চালাতে গ্রামের দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাধ্য হয়ে পথ খরচ বাবদ ৩০০ টাকা ঋণ নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন সৈয়দ আলী। কিন্তু তিনি তা শোধ করতে পারেননি। ইচ্ছা ছিল ঢাকায় গিয়ে কাজ করে টাকা শোধ করবেন। আর পরিবারের দু’বেলার দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে সে বাড়িতেও সংসার খরচের টাকা পাঠাবে। কিন্তু সে ইচ্ছা তার বাস্তবায়িত হয়নি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুলসীঘাটের বুড়িরঘর এলাকায় অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমার আঘাতে পুড়ে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অবশেষে পরিবারের শেষ সম্বলটুকু তুলে দিতে হয়েছে দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে তার ঋণের টাকা পরিশোধে। এখন তার তিন সন্তানসহ ৪ জনের সংসারে অভাব জেঁকে বসেছে। সৈয়দ আলীর স্ত্রী আছমা খাতুন জানান, গ্রামে কাজ নেই। তাই সুদের উপর টাকা নিয়ে মেয়ের গাইড বই কিনে দিয়েছিলেন। টাকা শোধ দিতেই তাড়াহুড়ো করে রওনা দেন ঢাকায় কাজের খোঁজে। ওই গ্রামের শ্রমজীবী বলরাম দাস তার স্ত্রী সাধনা রাণী ও গণ উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালিত বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীর ছাত্রী ৬ বছর বয়সের তাদের একমাত্র মেয়ে শিল্পী রাণীকে নিয়ে ঢাকার মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছিল অর্থ উপার্জনে। কিন্তু এই অসমাপ্ত যাত্রায় পেট্রোলবোমার আঘাতে হারাতে হয়েছে তার আদরের শিশু কন্যাটিকে। অসহায় মা সাধনা রাণী। শিশুটির ব্যবহৃত জামা-কাপড় নিয়েই যেন এ শোক ভোলার চেষ্টা করছেন। একই গ্রামের রং মিস্ত্রি শাহজাহান মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া ঢাকায় রং করার কাজে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময় গাইবান্ধার তুলসীঘাটে অবরোধ-হরতালকারীদের পেট্রোলবোমার আঘাতে সুমন মিয়াও মারা যায়। তার উপার্জনে নির্ভরশীল বৃদ্ধ পিতা-মাতা শাহজাহান মিয়া ও মজিদা বেগম। ফলে সন্তানকে হারিয়ে অসহায় এ বৃদ্ধরা জানে না তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ কিভাবে হবে। তাই তাদের কান্নাও যেন থামছে না। এ অবস্থা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের চ-ীপুর গ্রামজুড়েই। কাজের সন্ধানে ঢাকা যেতে বাসে উঠে একই অবস্থা গ্রামের নিহত ৮ দরিদ্র পরিবারের। পেট্রোলবোমায় পুড়ে মরতে হলো চ-ীপুর গ্রামের শিশুসহ ৮ দিনমজুরকে। এরা হলেনÑ সৈয়দ আলী, হালিমা বেগম, সুজন মিয়া, শিল্পী রাণী, সুমন মিয়া, সোনাভান, সাজু মিয়া ও আবু কালাম। সৈয়দ আলীর মতো অনেককেই দাদন ব্যবসায়ীর টাকা শোধ দিতে কাজের উদ্দেশে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। কিন্তু শুধু যাওয়াই হলো, বাড়িতে ফেরা হলো না। কারও গায়ে ক্ষত, আর কাউকে আগুনে পুড়ে নিথর কয়লা সাদৃশ্য দেহ নিয়ে বিদায় নিতে হলো পৃথিবী থেকে। চ-ীপুরের গৃহিনী শিল্পী বেগম জানান, নিহত ৮ পরিবারের স্বজনরাই পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যাকারীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। তারা চায় সরকার এ দরিদ্র মানুষের সন্তানদের খাওয়া-পরার সুযোগ দেবে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক এহছানে এলাহী বলেন, নিহত এবং আহতদের জন্য অর্থ সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও সহযোগিতা করা হবে।
×