ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সব অস্ত্র প্রয়োগেও আন্দোলনে সাফল্য নেই বিএনপির

বিদেশই ভরসা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিদেশই ভরসা

শরীফুল ইসলাম ॥ দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের কঠোর চাপ থাকলেও সরকার ও বিএনপি এখনও নিজ অবস্থানে অনড়। দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থান যখন তুঙ্গে তখন রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে আবারও সমন্বয়কের দায়িত্ব নিয়েছেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এদিকে একে একে আন্দোলনের সকল অস্ত্র প্রয়োগ করেও সরকারকে টলাতে না পেরে জাতিসংঘসহ বিদেশী হস্তক্ষেপই বিএনপির এখন মূল ভরসা। অপরদিকে জাতিসংঘসহ বিদেশী কোন চাপ এলেও সরকার দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বাস্তবতা তুলে ধরে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার কৌশল নিয়েছে। তাই ২০১৩ সালের মতো এবারও তারানকোর সমঝোতার উদ্যোগ বিফল হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কা। এদিকে সুশীল সমাজের একাংশ এবং এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএসহ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন সংলাপ করে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য সরকার ও বিএনপির প্রতি চাপ প্রয়োগ করে আসছেন টানা অবরোধ-হরতাল শুরুর পর থেকেই। এছাড়া ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপের মাধ্যমে উভয়পক্ষকে সমঝোতায় পৌঁছার আহ্বান জানানো হয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে বিএনপি জোটকে আগে আন্দোলনের নামে নাশকতা বন্ধ করতে হবে এবং জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকে বাদ দিতে হবে। তারপর সংলাপ হতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও আগে নাশকতা বন্ধের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি জোট সরকারের কথায় কর্ণপাত না করে এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও একের পর হরতাল দিয়ে দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দানবের সঙ্গে কোন সংলাপ নয়। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, আগে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তবে এটি খালেদা জিয়ার মনের কথা নয়, রাজনৈতিক বক্তব্য বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন। দুই নেত্রীর সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানের পর বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সঙ্গে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ওয়াশিংটনে একটি বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কোন সমঝোতায় পৌঁছা যায় কি-না সে কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঢাকায় এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জর্জ ফার্নান্দেজ তারানকো। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক ছাড়াই এ দুই দলের কিছু সিনিয়র নেতাকে এক সঙ্গে নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু দুই দল কেউ কাউকে ছাড় না দেয়ায় সমঝোতা করাতে পারেননি তিনি। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু এতেও কোন কাজ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে এবার জাতিসংঘের সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কোন সুফল বয়ে আনবে কি-না এ নিয়ে আগাম জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। জানা যায়, জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো ইতোমধ্যেই সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। কিছু ‘ফাইল ওয়ার্ক’ শেষ করে তিনি ঢাকা আসবেন। এবার তিনি দুই দল ছাড়াও আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ বের করা যায় কি-না সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাবেন। তবে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের এখনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আস্থা রয়েছে। আর বিদেশী কোন সংস্থা বা কোন প্রভাবশালী দেশ এ অঞ্চলে কিছু করতে হলে বাস্তবতার আলোকেই এখন ভারতকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তাই জাতিসংঘ কিংবা বিশ্বের কোন দেশ কিছু করতে হলে আগে ভারতের মত নিতে হবে। এ বাস্তবতায় তারানকোর দায়িত্ব নেয়ার পরও সরকারের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতার বিষয়টি আলোর মুখ দেখবে কি-না এমন প্রশ্নও রাজনৈতিক অঙ্গনের কারও কারও মনে উঁকি মেরেছে। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে (৫ জানুয়ারি) সামনে রেখে আরও আগে থেকেই রাজধানীসহ সারাদেশে অচলাবস্থা সৃষ্টির প্রস্তুতি শুরু করে বিএনপি। ৫ জানুয়ারি বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে পুলিশের অনুমতি ছাড়াই নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন খালেদা জিয়া। ওইদিন বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠেন তিনি। কিন্তু পুলিশ গেটের তালা খুলে না দেয়ায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেটে লাথি মেরে সেøাগান ও মিছিলের মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ পালনের ঘোষণা দেন। অবশ্য অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ২৯ ডিসেম্বর গাজীপুরে সমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে সংলাপ করাসহ সরকারের কাছে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তবে এ প্রস্তাব না মানলে কত দিনের মধ্যে আন্দোলন শুরু করবেন তা তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেননি। নেতাকর্মীরা মাঠে না নামায় অবরোধ কর্মসূচী সফল না হওয়ায় এক পর্যায়ে অবরোধের মধ্যেই হরতাল পালন করতে থাকে বিএনপি। সেই সঙ্গে অবরোধ-হরতালে পেট্রোলবোমাসহ নাশকতামূলক কর্মকা-ও বাড়তে থাকে। এর ফলে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। কিন্তু বিশ্ব এজতেমায়ও আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত না করায় জনমনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর দিনে টানা হরতাল দিয়ে ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ায় বিএনপি সম্পর্কে জনমনে ঘৃণার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে ধারাবাহিক কঠোর সমালোচনার পরও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া পরীক্ষার সময় হরতাল স্থগিত না করায় এক পর্যায়ে তার গুলশান কার্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও শ্রমিকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রতিদিন জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। কিন্তু তারপরও আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত করছে না বিএনপি। তবে হরতাল-অবরোধে সহিংসতার ফলে জানমালে যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সেটি খালেদা জিয়াকে ভাবনায় ফেলেছে বলে জানা গেছে। এ জন্যই মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় প্রতিদিন বিএনপি পক্ষ থেকে শোক ও সমবেদনা জানানো হচ্ছে। গণমাধ্যমে পাঠানো বিএনপির বিবৃতিতে মাঝেমধ্যেই বলা হয়, অবরোধ-আন্দোলনে মানুষের কষ্ট, দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে বিএনপি সহানুভূতিশীল ও সজাগ। তবে সরকারের নেতিবাচক কর্মকা- অবসানের জন্য ধৈর্য ধরে সাময়িক কষ্ট স্বীকারের জন্যও দলের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম সামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজ ও বিজিএমইএর নেতৃবৃন্দ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে চিঠি লিখে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করার দাবি জানান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই রাজপথে অবস্থান নিয়ে হরতাল-অবরোধের নামে নাশকতা বন্ধের দাবি জানান। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের দাবি জানান। কিন্তু এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়াও হরতাল-অবরোধ বন্ধের কোন ঘোষণা দিচ্ছেন না। আর প্রধানমন্ত্রীও সংলাপের ব্যাপারে কোন আহ্বান জানাচ্ছেন না। এদিকে নেতাকর্মীরা মাঠে না নামায় এবং জনগণ বাস্তবতার তাগিদে আন্দোলনকে উপেক্ষা করায় বিএনপি জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ক্রমেই অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যানবাহন চলাচলসহ মানুষের জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তারপরও বিএনপির পক্ষ থেকে দফায় দফায় বিবৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, সরকার তাদের দাবি মেনে না নিলে আরও হরতালসহ আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবে। আন্দোলনের সব কর্মসূচীই কার্যত কোন ফল বয়ে আনতে না পারায় এখন বিএনপির একমাত্র ভরসা বিদেশীদের সাহায্য-সমর্থন। এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। এ কাজে বিএনপিপন্থী কিছু সাবেক কূটনীতিক আমলা কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
×