ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংলাপের কফিনে বেগম জিয়া ঠুকলেন ॥ শেষ পেরেক!

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সংলাপের কফিনে বেগম জিয়া ঠুকলেন ॥ শেষ পেরেক!

উত্তম চক্রবর্তী ॥ মধ্যস্থতায় নামা ‘সুশীল সমাজকে’ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সম্ভাব্য সংলাপের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সরকার পক্ষ সন্ত্রাস, নাশকতা ও খুনীদের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও দেশী-বিদেশী নানা উদ্যোগের ফলে সংলাপ ইস্যুতে রাজনীতির ভাগ্যাকাশে যেটুকুও আলোর ঝলকানি দেখা দিয়েছিল সেটুকুও ভেস্তে দিলেন বিএনপি প্রধান নিজেই। ‘সর্বাগ্রে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে রাজি হলেই সংলাপ’-বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার এমন শর্তারোপকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, তার (খালেদা জিয়া) এমন দাবি শুধুমাত্র সংলাপের সম্ভাবনাই ভেস্তে দেবে না, ভবিষ্যতেও সংলাপ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। দেশকে আরও অন্ধকার ও সঙ্কটের দিকে ধাবিত করবে। শুধু আন্দোলনরত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতারাই নন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সুশীল সমাজের একাংশ এবং দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনের কথা বলা হচ্ছিল। সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন নাগরিক সমাজের ব্যানারে থাকা ব্যক্তিবর্গ। সরকার তরফে বর্তমান অবস্থায় সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও বলা হয়েছেÑ বিএনপি যদি আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা ও মানুষ হত্যা বন্ধ করে পরিবেশ সৃষ্টি করে তবে সংলাপের বিষয়টি ভেবে দেখবে সরকার। কিন্তু সব উদ্যোগকে ভেস্তে দিয়ে সংলাপ প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট দুটি আগাম শর্তজুড়ে দিয়ে সে সম্ভাবনাটুকুও ভেস্তে দিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। বুধবার পশ্চিমা বার্তা সংস্থা এএফপিকে টেলিফোনে প্রদত্ত সাক্ষাতকারে সংলাপ প্রশ্নে শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরে দাঁড়িয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কোন সুরাহা হবে না। যত দ্রুত এই নির্বাচন আয়োজন করা যায়; সবার জন্য তা হবে ততটাই মঙ্গলজনক। নির্বাচনের রূপরেখার বিষয়ে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে চান। আমরা চাই, সব দলের আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। শুধু সংলাপ প্রশ্নে শর্তারোপই নয়, ওই সাক্ষাতকারে বিএনপি নেত্রী চলমান নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয় দাবি করে তিনি বলেন, দৃশ্যত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগই পেট্রোলবোমা হামলা চালাচ্ছে! তবে এএফপিকে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতকার প্রদানের আগেই বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখা করার পর সাংবাদিকদের কাছে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, হরতাল-অবরোধের নামে যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে, তাদের সঙ্গে কোন সংলাপ নয়। পাল্টা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, খুনী-সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের সঙ্গে কীসের সংলাপ? মানুষরূপী মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারী দানবদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। আর যারা সংলাপের কথা বলেন, তারা আগে এই সন্ত্রাস বন্ধ করার উদ্যোগ নিন। আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার খেলা আগে বন্ধ করতে হবে। সংলাপ প্রশ্নে সরকারের পদত্যাগ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের খালেদা জিয়ার দাবি প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হবে। দেশ পরিচালনায় সাংবিধানিক বিধিবিধান অনুসরণ করে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের ফলে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সৃষ্টি, কৃষি-শিল্প ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি, শিক্ষায় বিপ্লব এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচনের দাবি আইন ও যুক্তিতে ‘অগ্রহণযোগ্য’। তবে দেশের ভবিষ্যত কি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই সিনিয়র আইনজ্ঞ বলেন, দেশে বর্তমানে যা চলছে তা মোটেই রাজনীতি নয়, রাজনীতির নামে সন্ত্রাস-নাশকতা ও জঙ্গীবাদ। অতীতের মতো গণআন্দোলন কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মতো কিছু ঘটলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এসব দাবির যৌক্তিকতা থাকত। কিন্তু বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে জনগণের ন্যূনতম স্বতঃস্ফূর্তাও দৃশ্যমান নয়। ফলে ওই দুই দাবি মেনে নিয়ে কথিত হরতাল-অবরোধের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা ও জঙ্গীস্টাইলে নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, অর্থনীতির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের সঙ্গে জড়িতদের কাছে সরকার নতজানু হলে ভবিষ্যতে অপরাধ প্রবণতাই উৎসাহিত পাবে। হঠাৎ করেই সংলাপ প্রশ্নে সরকারের পদত্যাগ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দাবির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা আন্দোলনে আছি। আন্দোলনের সফলতার স্বার্থেই হয়ত তিনি (খালেদা জিয়া) একথা বলেছেন। আর যেহেতু দলের চেয়ারপার্সনই একথা বলেছেন, তাই এ ব্যাপারে আর বেশি কিছু আমার বলার নেই। খালেদা জিয়ার সরকারের পদত্যাগ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বলেই মনে করছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতা ওবায়দুল কাদের। সচিবালয়ে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) উনার চিন্তা থেকে বলেছেন। বিরোধী দলে থাকলে হয়ত আমরাও তা বলতাম।’ চলমান পরিস্থিতিতে আলোচনা না হওয়ার জন্য সংলাপ প্রত্যাশী বিএনপিকেই দায়ী করে আওয়ামী লীগের এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলেন, সেদিন প্রধানমন্ত্রীর জন্য দরজা বন্ধ করা হয়নি, সংলাপের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে পরিস্থিতি সংলাপের অনুকূলে নয়। তবে আমাদের দেশে ঝড় আসে, ঝঞ্ঝা আসে, অন্ধকার আসে; আবার চলেও যায়। আমার মনে হয়, অন্ধকারের মধ্যে আলোর ঝলকানি হয়ত কোন সময় দেখা যাবে। গত মাসের ৩ তারিখ থেকে চলা একটানা আন্দোলন-হরতালের নামে ইতোমধ্যে ঝড়ে গেছে ৮০টিরও বেশি নিরীহ মানুষের প্রাণ; যাদের অধিকাংশই মারা গেছেন বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীদের নিক্ষিপ্ত পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে। প্রতিদিনই লাশের মিছিল বৃদ্ধি হওয়ায় শুধু দেশের মানুষই নন, উদ্বেগ জানিয়েছে বিশ্বের প্রায় সব বড় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রই। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-নাশকতার বিরুদ্ধে সারাদেশেই বিক্ষুব্ধ ও ফুঁসে ওঠা জনগণই নেমে পড়েছে রাস্তায়। হরতাল-অবরোধ না মেনে সাহস নিয়েই রাস্তায় নেমেছে শত শত যানবাহন। সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক নেতাদের বাসা-বাড়িতে প্রতিদিনই ছুটে যাচ্ছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কোন না কোন কূটনীতিক বা হাইকমিশনার। সবাই আন্দোলনের নামে এমন সন্ত্রাসী কর্মকা-ের নিন্দা জানিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছেন। খোদ বিএনপি-জামায়াতের নেতারাও যখন এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছেন, ‘এক্সিট রুটে’র কথা বলছেন- ঠিক তখন অনেকটাই আকস্মিকভাবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সংলাপ প্রশ্নে নতুন শর্তারোপ খোদ ২০ দলীয় জোটের নেতারাই ভাল চোখে দেখছেন না। জোটের কয়েক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর শোক জানাতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় কার্যালয়ে ঢুকতে না দেয়ার ঘটনা ছিল বিএনপির জন্য অনেকটাই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সে সময় বিএনপি নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করলে বর্তমান পরিস্থিতি এমন হতো না, এত প্রাণহানির ঘটনাও ঘটত না। সেই ভুল সিদ্ধান্তের রেশ কাটতে না কাটতেই সংলাপ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি সংলাপের যেটুকুও সম্ভাবনা ছিল, তা ভেস্তে যাবে বলেই তাদের আশঙ্কা। এ কথা স্বীকার করে বিএনপিরই এক সময়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত জোটের সমর্থক বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীকেই আলোচনা, সংলাপ করতে হবে। গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী একবার টেলিফোন করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া সাড়া দেননি। আর এ সাড়া না দেয়া ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভুল। তিনি বলেন, সমস্যা কি? প্রধানমন্ত্রীর আরেকবার টেলিফোন করতে তো বাধা নেই। দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে তিন মাসের মধ্যে সৃষ্ট সঙ্কটের সমাধান হতে পারে। তবে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী-নাশকতা ও জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের সঙ্গে কোন ধরনের আপোসের সম্ভাবনা আবারও নাকচ করে দিয়েছেন দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। বিজিএমইএ সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখ হয়, একশ্রেণীর হতাশাগ্রস্ত লোক, বুদ্ধিজীবী যারা সন্ত্রাস, নাশকতা, জঙ্গী তৎপরতা করছে তাদের সঙ্গে আমাদের এককাতারে দাঁড় করাতে চায়। তিনি বলেন, সন্ত্রাস হয় তাদের সঙ্গে যারা পলিটিক্স (রাজনীতি) নিয়ে কথা বলতে চায়। সন্ত্রাসের সঙ্গে যদি কেউ কোন দিন আপোস করে তাহলে সে দেশ টিকে থাকে না। সন্ত্রাসের সঙ্গে আপোস করলে দৃষ্টান্ত হয়, ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে আরও একটি দল চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
×