ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দানবের সঙ্গে সংলাপ নয় ॥ নাশকতা বন্ধ করলে চিন্তা করা যায়

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দানবের সঙ্গে সংলাপ নয় ॥ নাশকতা বন্ধ করলে চিন্তা করা যায়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ চলমান নাশকতা ‘বন্ধ না করলে’ বিএনপির সঙ্গে ‘কোন সংলাপ হবে না’ বলে সরকারের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। রবিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দানবের সঙ্গে মানবের কোন সংলাপ বা রাজনৈতিক আলোচনা হবে না। আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা নেতার সঙ্গে সংলাপ আর সম্ভব নয়। দেশব্যাপী চলমান নাশকতা বন্ধ করলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা রাজনৈতিক আলোচনা নিয়ে চিন্তা করা হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধের এক মাস তিন দিন পর চলমান নাশকতা নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে এলেন তথ্যমন্ত্রী। সংলাপের কথা বললেও বিএনপি ‘গঠনমূলক কোন প্রস্তাব’ দিতে পারেনি মন্তব্য করে ইনু বলেন, সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির জন্য ২০ দলীয় জোট নেত্রী ‘অস্বাভাবিক প্রস্তাব’ দিচ্ছেন। গত ৫ জানুয়ারি সারাদেশে অবরোধ ডাকার আগে গত বছরের শেষ দিন সংবাদ সম্মেলন করে সব পক্ষের সামনে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তার ওই প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ছিল ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন করা, যে সরকার হবে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের’ সম্মতির ভিত্তিতে। খালেদার সেই প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে উল্লেখ করে তখনই সরকারের পক্ষ থেকে নাকচ করে দেয়া হয়। এরপর সারাদেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন খালেদা জিয়া। এই কর্মসূচীর মধ্যে প্রতিদিনই নাশকতার ঘটনা ঘটছে। এ পর্যন্ত ৬০ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, যাদের অধিকাংশই মারা গেছেন বোমার আগুনে পুড়ে। এসব নাশকতার জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে আইনের ধারা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও তথ্যমন্ত্রী জানান। ‘সুশীল সমাজের’ প্রতিনিধিদের সংলাপের আহ্বান প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, আমার বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা আরও ভাল করে হোমওয়ার্ক করে, প্রস্তাব দিক। নির্বাচন নয়, খালেদা জিয়ার ‘গোপন এজেন্ডা’ রয়েছেÑ মন্তব্য করে ইনু বলেন, এজন্য তার রহস্যময় ভূমিকা দেখছি। তিনি দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরিতে ব্যস্ত আছেন। লিখিত বক্তব্যে ইনু বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ (অব) দুটি বিবৃতি প্রদান করেছেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে দেশের বেশকিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক গোলটেবিল বৈঠক করে একটি ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের পরিস্থিতি এবং এসব বক্তব্য-বিবৃতির ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে বক্তব্য তুলে ধরার জন্য তার এই সংবাদ সম্মেলন। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, উনি ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’ এর ডাক দিয়েছেন এবং ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা’ পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে’। প্রায় প্রতিদিন যাত্রীবাহী বাস, জনপরিবহনে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ যাত্রীদের নির্মমভাবে হত্যা, রেললাইন উপড়ে ফেলা, পণ্যবাহী ট্রাক জ্বালিয়ে দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এর নমুনা! বেগম জিয়া তার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘তাদের সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে পেট্রোলবোমায় কয়েকজন নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। এসব ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।’ বেগম জিয়ার এ বক্তব্য ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়কে ঘাঁটি বানিয়ে এবং তার পুত্র তারেক রহমান লন্ডন থেকে ৫ জানুয়ারির আগেই ভিডিও বার্তায় প্রকাশ্যে নাশকতা-অন্তর্ঘাতের উস্কানি দিয়েছেন এবং দিয়েই চলেছেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া তার আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তাদের সমর্থন চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে প্রতিদিনই আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে, এ ব্যাপারে তার সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ নেই। বেগম জিয়া ‘যৌক্তিক পরিণতি’ বা ‘অভীষ্ঠ লক্ষ্যে’ না পৌঁছা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তার আন্দোলনের ‘যৌক্তিক পরিণতি’ বা ‘অভীষ্ঠ লক্ষ্য’ কি? দেশকে অচল করে, অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে, রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে সংবিধানের বাইরে দেশকে ঠেলে ফেলে দিয়ে অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা? সেই জন্যই কি তিনি আন্দোলনের নামে অস্বাভাবিক সব পন্থা গ্রহণ করেছেন, যা গণআন্দোলনের বা গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোন সংজ্ঞা বা ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না? তিনি বলেন, মেজর হাফিজ (অব) তার বিবৃতিতে ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ দাবি করেছেন। দেশে তো সাংবিধানিক নিয়মেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এসেছিল। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। তারা যেন নির্বাচন করেন সেজন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ছোট করে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয় সরকার’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়াকে ফোন করে সংলাপের সূত্রপাত করেছিলেন, সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন বেগম জিয়া ও বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বিনম্র আহ্বানকে চরম অসৌজন্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেদিন প্রমাণ হয়েছে এখনও প্রমাণ হচ্ছে, নির্বাচন তাদের এজেন্ডা না। তারা নির্বাচন বানচাল করে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি, দেশকে সংবিধানের বাইরে ঠেলে দেয়া, অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই তাদের এজেন্ডা। ইনু বলেন, ইদানীং বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এখন একটু সরব হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকে সরকার উৎখাতের জন্য উস্কানি-ষড়যন্ত্র, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে নাশকতা-অন্তর্ঘাতের সূত্রপাতে হলেও তখন দেশের এই বুদ্ধিজীবীরা মুখ বন্ধ করে ছিলেন। এ বুদ্ধিজীবীরা সংলাপ নিয়ে যতটা সরব, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার বিরুদ্ধে ঠিক ততটাই নীরব। দেশের জন্য, মানুষের জন্য ওই বুদ্ধিজীবীগণের সামান্য মায়া থাকলে তারাতো বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে নিয়ে তাকে বলতে পারতেন, ‘বেগম জিয়া সবার আগে আপনি আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা বন্ধ করুন। তারপর রাজনৈতিক সমস্যা যদি কিছু থাকে তা নিয়ে আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলব।’ তারা এটা করেননি। বরং তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সংলাপ’ নিয়ে কথা হচ্ছে। গণতন্ত্রে একটি গণতান্ত্রিক নেতা বা দল বা জোট এর সঙ্গে আরেকটি গণতান্ত্রিক নেতা বা দল বা জোটের সংলাপ স্বাভাবিক। এমনকি যুদ্ধের মধ্যেও দুইপক্ষের সংলাপ হয়। সংলাপের একটি উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্য হতে পারে- যুদ্ধ-বিরতি, শান্তি বা ভবিষ্যতের জন্য আরও শান্তি। বেগম খালেদা জিয়া কি আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা-অন্তর্ঘাত-নাশকতা-সন্ত্রাস বন্ধে বা সাময়িক বিরতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন? উনি কি শান্তির ঘোষণা দিয়েছেন? উনি কি শান্তির নিশ্চয়তা দিয়েছেন? বেগম জিয়া আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারতেই থাকবেন, তাহলে তার সঙ্গে কিভাবে সংলাপ-কিসের সংলাপ? অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, বিএনপিকে না-কি সভা-সমাবেশ করার বা তাদের তাত্ত্বিক ভাষায় ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ দেয়া হচ্ছে না বলেই বিএনপি সন্ত্রাস-নাশকতা-অন্তর্ঘাতের পথে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ আগে তো বেগম জিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে আসছিলেন। এমনকি ৫ জানুয়ারিতেও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি প্রকাশ্য জনসভা করেছে। বেগম জিয়া বা তার পুত্র যখন প্রকাশ্যেই অন্তর্ঘাত-নাশকতার উস্কানি দেন তখন সরকার কি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। বেগম জিয়া শান্তির নিশ্চয়তা দিলে, অন্তর্ঘাত-নাশকতার পথ পরিহার করলে, তখন বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া হলে, এ কথা উঠতে পারে যে, ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ দেয়া হচ্ছে না। যারা সব জেনে-শুনে-বুঝে এটা বলছেন, তারা নিজেরাই বিএনপির সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিকে, সন্ত্রাস-নাশকতা-অন্তর্ঘাতকে বৈধতা দিতে চাচ্ছেন। এছাড়া আর কিছুই না। সরকার রাজনৈতিক কর্মসূচীর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকার নাশকতা বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
×