ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বেকসুর খালাস ২

জুবায়ের হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন ৬

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

জুবায়ের হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন ৬

কোর্ট রিপোর্টার ॥ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যা মামলার রায়ে ৫ জনকে ফাঁসি ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত। এছাড়া আরও ২ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে রায়ে। রবিবার ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবিএম নিজামুল হক এ রায় ঘোষণা করেন। জুবায়ের আহমেদের হত্যাকা- বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতির আদর্শহীন চেহারা মেলে ধরেছে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। যে কোন ধরনের হত্যা বা সন্ত্রাস প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ যুগোপযোগী আচরণবিধি তৈরি করবে, সেই প্রত্যাশাও করেছেন আদালত। অন্যদিকে, দ্রুত আসামিদের দ- কার্যকর চায় জুবায়েরের পরিবার। মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলেন- প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আশিকুল ইসলাম আশিক, খান মোহাম্মদ রইস ও জাহিদ হাসান, দর্শন বিভাগের রাশেদুল ইসলাম রাজু এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্র মাহবুব আকরাম। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে দর্শন বিভাগের ইশতিয়াক মেহবুব অরূপ ও কামরুজ্জামান সোহাগ, ইতিহাস বিভাগের মাজহারুল ইসলাম, পরিসংখ্যান বিভাগের শফিউল আলম সেতু ও অভিনন্দন কু- ওরফে অভি এবং অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নাজমুস সাকিব তপুর। যাবজ্জীবন কারাদ-ের পাশাপাশি প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। এ হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র নাজমুল হাসান প্লাবন ও ইতিহাসের মাহমুদুল হাসান। দ-িতদের মধ্যে আশিক, রইস, আকরাম ও অরূপ শুনানি চলাকালে কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যান। মাহবুব আকরাম ছাড়াও নাজমুস সাকিব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। রায় ঘোষণার আগে সকালে আসামিদের মধ্যে কারাবন্দী সোহাগ, মাজহারুল, সেতু, অভি, তপু, প্লাবন ও মাহমুদুলকে আদালতে হাজির করা হয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার কথা থাকলেও অবরোধের মধ্যে আসামিদের কারাগার থেকে না আনায় তা পিছিয়ে যায়। তিন বছরের বেশি সময় বিচার চলার পর গত ২৮ জানুয়ারি বিচারক নিজামুল হক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন দিয়েছিলেন। ওই দিনই সাত আসামির জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যাদের দু’জন খালাস পেয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র জুবায়ের ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। জুবায়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এ হত্যা মামলায় দ-িতরাও একই সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। এ ঘটনায় পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নিবন্ধক হামিদুর রহমান আশুলিয়া থানায় এই হত্যা মামলা করেন। ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ ছাত্রের বিরুদ্ধে ঢাকার হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মীর শাহীন শাহ পারভেজ। হত্যাকা-ের দেড়বছর পর মামলাটি অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে এলে তা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। জুবায়ের নিহত হওয়ার পর ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সময়কার উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। রায়ের পর্যবেক্ষণ ॥ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জুবায়ের আহমেদের হত্যাকা- বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতির আদর্শহীন চেহারা মেলে ধরেছে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন। আর এর ফলে যে সব পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের এক ধরনের অসহায়ত্বও ধরা পড়েছে আদালতের চোখে। রায়ে বলা হয়েছে, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনার গভীরে ঢুকে বর্তমান রাজনীতির চরম বিশৃঙ্খলা, নীতিহীন ও আদর্শচ্যুত চেহারাই উন্মোচিত করেছেন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আশিকুল ইসলাম আশিক ও দর্শন বিভাগের রাশেদুল ইসলাম রাজুকে নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্যের সূত্র ধরে আদালত নীতিহীন রাজনীতির কথা বলে। আশিকুল ও রাশেদুল ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর করতেন ছাত্রদল। জুবায়েরও তখন ছাত্রদল করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর এরা সবাই ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষ, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী ও শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, শিক্ষকদের সঙ্গে অশালীন আচরণ উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটও এসব প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় না। কারণ প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। এসব বিষয়ে বিচারক রায়ে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে উল্লেখিত অনৈতিক কর্মকা-ের শেষ পরিণতি হচ্ছে জুবায়ের হত্যাকা-। আর অনুরূপ অহেতুক হত্যাকা- মানবতা ও নৈতিকতাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করে। এতে ভুক্তভোগীর পরিবারের ওপর নেমে আসে শোকের ছায়া। এমনকি পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক নানারকম সমস্যাও পরিবারকে গ্রাস করে। রায়ে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তির জোরে কোনো ধরনের সহিংসতা, নৃশংসতা, অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা শিক্ষার অনূকূল পরিবেশের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা কারও কাম্য হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত কোনো হত্যাকা- বা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিচার সাম্প্রতিক অতীতে না হওয়াটাও পরবর্তীতে একই ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণ। রায়ে বলা হয়েছে, এ রকম হত্যাকা-ে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়, যা স্বাভাবিক কারণেই ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করে। যে কোনো ধরনের হত্যা বা সন্ত্রাস প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ যেন যুগোপযোগী আচরণবিধি তৈরি করে, সেই প্রত্যাশা করেছে আদালত। দু’জনকে খালাসের কারণ ॥ রায়ে বলা হয়েছে, মামলার বিচারে উঠে এসেছে যে, প্লাবন ঘটনার সময় সেখানে থাকলেও মারধর থেকে জুবায়েরকে বাঁচাতে তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন। সে মোবাইল ফোনে মাহমুদুল হাসান মাসুদকে ঘটনাস্থলে ডেকে নিয়ে আসে যেন জুবায়েরকে পিটুনির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। ফাঁসি দ্রুত কার্যকর চায় পরিবার ॥ জুবায়ের আহমেদকে হত্যায় মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের দ- দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে তার পরিবার। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জুবায়েরের বড় ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন এ দাবি জানান। তিনি বলেন, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ জনের মধ্যে আশিকুল ইসলাম আশিক ও খান মোহাম্মদ রইস পালিয়ে গিয়ে এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি চলাকালে মাহবুব আকরাম ও ইশতিয়াক মেহবুব অরূপের সঙ্গে কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যান আশিক ও রইস। মাহবুবের মৃত্যুদ- হলেও অরূপের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পলাতক রইস বর্তমানে ডেনমার্কে এবং আশিক মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। এছাড়া পলাতক দ-িতদের মধ্যে কয়েকজনকে সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ‘র‌্যাগ ডে’র অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা গেছে বলে জানান তিনি। এদিকে রায়ে অসন্তোষ জানিয়ে এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন বলে জানিয়েছেন দ-িতদের আইনজীবীরা।
×