ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাসিরের গোলে স্বপ্নের ফাইনালে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নাসিরের গোলে স্বপ্নের ফাইনালে বাংলাদেশ

রুমেল খান ॥ বাঘের গর্জনে পরাভূত যুদ্ধবাজ হাতি! শুক্রবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচটা যদিও ছিল সেমিফাইনালের, তবে যারা স্টেডিয়ামে বসে এবং বাসায় টিভির পর্দায় চোখ রেখে খেলা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ‘ওটা ছিল ফাইনাল ম্যাচ!’ ঠিক তাই। ফাইনালের উত্তেজনা, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, গ্যালারিতে দর্শক-ঢল, টিকেটের জন্য হাহাকার ... একটি ম্যাচ ষোলোআনা উপভোগ্য হতে যা যা রসদ দরকার, তার সবই ছিল আন্তর্জাতিক ফুটবল আসর ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ’-এর শুক্রবার সেমির দ্বিতীয় ম্যাচে। সেই ম্যাচে ডিফেন্ডার নাসির উদ্দিন চৌধুরীর দেয়া একমাত্র গোলে স্বাগতিক বাংলাদেশ ১-০ গোলে থাইল্যান্ড অনুর্ধ-২৩ জাতীয় দলকে হারিয়ে পৌঁছে যায় স্বপ্নের ফাইনালে। একই ভেন্যুতে আগামী রবিবার তারা কাক্সিক্ষত শিরোপাটা নিজেদের করে নেয়ার জন্য মোকাবেলা করবে প্রথম সেমির জয়ী দল মালয়েশিয়া অনুর্ধ-২৩ জাতীয় দলের। গ্রুপ পর্বে এই মালয়েশিয়ার কাছেই ০-১ গোলে হেরে অভিযান শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কে বলে বাংলাদেশ দর্শক পরিপূর্ণ পরিবেশে ভাল খেলতে পারে না, চাপে পড়ে এবং হেরে যায়? শুক্রবার ম্যাচ হওয়ার পর মামুনুলবাহিনী সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। ম্যাচ শুরুর আগে দামী প্রশ্ন ছিলÑ হিংস্র বাঘের শক্তি বেশি, নাকি যুদ্ধবাজ হাতির শক্তি বেশি? উত্তরÑ বাঘের শক্তি বেশি। ৯০ মিনিটের তুমুল দ্বৈরথে ‘বেঙ্গল টাইগার্স’ লড়াই করেছে বাঘের মতোই। তবে ‘দ্য ওয়ার এলিফ্যান্টস’ খ্যাত আসিয়ান অঞ্চলের দেশ থাইল্যান্ডকে হারের তিক্ত স্বাদ উপহার দিতে এ জন্য বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে তাদের। হেড টু হেড পরিসংখ্যানে প্রতিপক্ষ থাইল্যান্ডের চেয়ে অনেক পিছিয়ে স্বাগতিক বাংলাদেশ। ১৫ ম্যাচে বাংলাদেশের ৩ জয়ের বিপরীতে থাইবাহিনীর জয় ৯টি। বাকি ৩ ম্যাচ ড্র। ফিফা র্যাঙ্কিংয়েও তাই। বাংলাদেশ ১৬৫, থাইল্যান্ড ১৪৪। টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা দল থাইল্যান্ড। খেলে ছোট ছোট পাসে। দলটি যথেষ্ট তারুণ্যনির্ভর। অভিজ্ঞতা, পরিসংখ্যান, ক্ষিপ্রতা এবং র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে একসময় ‘শ্যাম দেশ’ (আগে এটাই ছিল থাইল্যান্ডের নাম)। আর হোমগ্রাউন্ড এবং আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত জয় হলো আত্মবিশ্বাসেরই। এর আগে সর্বশেষ ২০০৫ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়শিপের ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ জাতীয় দল। সেবার ভারতের কাছে ২-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসের ফাইনালে আফগানিস্তানকে ৪-০ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশ স্বর্ণপদক জিতলেও সেটা ছিল বাংলাদেশের অনুর্ধ-২৩ দল। শুক্রবারের সেমির ম্যাচে থাইদের হারানোর পর জানা গেছে চমকপ্রদ এক তথ্য। দীর্ঘ ২৬ বছর পর তাদের হারাতে সক্ষম হলো বাংলাদেশ! ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা ছিল সেটি। ম্যাচ হয়েছিল এই ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই! তারিখ ছিল ১৯৮৯ সালের ৮ মার্চ। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ৩-১ গোলে। ম্যাচের শুরু থেকেই একের পর এক আক্রমণ করে থাই রক্ষণদুর্গে ত্রাসের সঞ্চার করেন বাংলাদেশের ফরোয়ার্ডরা। ৫ মিনিটের মধ্যেই ৬টি আক্রমণ করে তারা! ৬ মিনিটে বাংলাদেশের অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে বল পেয়ে শট করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ১০ মিনিটে এমিলির হেড পোস্ট ঘেঁষে চলে যায়। ২০ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে ঢুকে পড়েন উইঙ্গার জাহিদ। সতীর্থ হেমন্তকে পাস দিলেও হেমন্ত তা বুঝতে না পারায় গোলের সুযোগ নষ্ট হয়। ২৫ মিনিটে থাই বক্সে ঢুকে সোহেল রানা শট নিলে এক থাই ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে বল বাইরে চলে যায়। ২৬ মিনিটে সোহেল রানার থ্রো তে এমিলি হেড নিলে তা ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরে ফেলেন থাই গোলরক্ষক। ৩৯ মিনিটে আসে সেই বহুল কাক্সিক্ষত মাহেন্দ্রক্ষণ। ডান প্রান্ত থেকে কর্নার করেন অধিনায়ক মামুনুল। কর্নারের উড়ন্ত বলে ডিফেন্ডার নাসির উদ্দিন চৌধুরী বাঁ পা ছুঁইয়ে দিলে বল আশ্রয় নেয় থাইদের জালে। তা আর ফেরাতে পারেননি অসহায় থাই গোলরক্ষক ইয়স সমপর্ন (১-০)। উল্লাসে ফেটে পড়ে ১৬ কোটি বাংলাদেশী। দ্বিতীয়ার্ধে সমতা ফেরাতে মরিয়া হয়ে ওঠে থাই শিবির। ৫০ মিনিটে মিডফিল্ডার ভিরাসাত সাওয়াতের বিপজ্জনক কোনমতে আটকান বাংলাদেশের গোলরক্ষক শহীদুল আলম। ৫৫ মিনিটে বাংলাদেশের মামুনুলের শট থাই-পোস্ট ঘেঁষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৫৬ মিনিটে থাইল্যান্ডের ভিরাসাত সাওয়াতের শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৫৮ মিনিটে বক্সের বাইরে মিডফিল্ডার সাওয়াতকে ফাউল করেন হেমন্ত। সাওয়াতের ফ্রি কিকে পাকর্নের শট প্রতিহত করেন বাংলাদেশী মিডফিল্ডাররা। ৬১ মিনিটে হেমন্তর শট আটকে দেন থাই গোলরক্ষক। ৬৪ মিনিটে ফরোয়ার্ড পাকর্নের শট বারে লেগে ফেরত আসায় বেঁচে যায় বাংলাদেশ! ৬৯ মিনিটে পিমকনের শট আটকে দেন বাংলাদেশের ডিফেন্ডার রায়হান। ৭৫ মিনিটে জাহিদের ক্রসে বল পেয়ে প্রায় মাঝ মাঠ থেকে উঁচু শট নেন হেমন্ত। থাই গোলরক্ষক কোনমতে বল রক্ষা করেন। ৮৫ মিনিটে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় মামুনুলের শট। টুর্নামেন্টের ‘এ’ গ্রুপের দল বাংলাদেশ গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে শেষ চারে নাম লেখায় (২ খেলায় ১ জয় ও ১ হারে ৩ পয়েন্ট নিয়ে)। সিলেটে প্রথম ম্যাচে তারা ০-১ গোলে ‘মালয় টাইগার্স’ খ্যাত মালয়েশিয়ার কাছে হারলেও ঢাকায় দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ১-০ গোলে পরাভূত করে। পক্ষান্তরে থাইরা হচ্ছে ‘বি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল। তারা প্রথম ম্যাচে ৩-২ গোলে হারায় ‘দ্য লায়ন্স; খ্যাত সিঙ্গাপুরকে। দ্বিতীয় ম্যাচে ৩-০ গোলে হারায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনকে। ২ ম্যাচের প্রতিটিতেই জয় এবং পূর্ণ ৬ পয়েন্ট নিয়ে তারা পৌঁছে যায় সেমিতে। দু’দলের মধ্যে সর্বশেষ সাক্ষাত প্রীতি ম্যাচে। ২০১২ সালে ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত সে ম্যাচের ফল মোটেও সুখকর নয় লাল-সবুজ জার্সিধারীদের কাছে। থাইদের কাছে ০-৫ গোলে বিধ্বস্ত হয় তারা। এখন দেখার বিষয়, রবিবারের ফাইনালে মালয়েশিয়াকে হারিয়ে বদলা নেয়া এবং ট্রফি জেতাÑ দুটোই অর্জন করতে পারে কি না ক্রুইফের শিষ্যরা।
×