ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাশকতাপ্রবণ ৩ শতাধিক স্পট চিহ্নিত ॥ দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে দুই শতাধিক আটক

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নাশকতাপ্রবণ ৩ শতাধিক স্পট চিহ্নিত ॥ দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে দুই শতাধিক আটক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নাশকতাপ্রবণ তিন শতাধিক স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকার চল্লিশটিসহ দুই শতাধিক স্পটে বসানো হয়েছে গোপন সিসি ক্যামেরা। আর মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ৯৯৩। চলমান এসএসসি পরীক্ষার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত কয়েকদিন ধরেই কর্ডন পদ্ধতিতে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত জেলাগুলোতে। অভিযানে সারাদেশ থেকে দুই শতাধিক পেশাদার নাশকতাকারী ও শতাধিক বোমা সরবরাহকারী এবং বোমাবাজদের অর্থদাতা গ্রেফতার হয়েছে। যেকোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে র্যাবের হেলিকপ্টার। নাশকতাপ্রবণ স্পট, মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের আশপাশে অবস্থিত অফিস, আদালত, বাসাবাড়ি, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন এবং পেট্রোলপাম্পগুলোতে থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো সচল রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী বিএনপির ডাকা অবরোধ-হরতালে সারাদেশে ধারাবাহিক নাশকতায় ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন অর্ধশতাধিক। আহত হয়েছেন অন্তত হাজারখানেক। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন শত শত মানুষ। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হতে চলেছেন। ভাংচুর করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে শত শত যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যানবাহন। আহতদের চিৎকারে সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন ঝরছে। নাশকতাকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলছে। পাশাপাশি নাশকতাকারীদের ধরিয়ে দিতে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। নাশকতায় অতিষ্ঠ জনগণ নিজেরাই এবার রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও গণধোলাইয়ের শিকার হচ্ছে নাশকতাকারীরা। ইতোমধ্যেই অন্তত অর্ধশতাধিক নাশকতাকারী গণধোলাই খেয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ভিডিওফুটেজ, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের পাশাপাশি নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। তারা নাশকতাকারীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের যেসব এলাকায় বস্তি ও জামায়াত-শিবিরের প্রভাব বেশি সেসব এলাকায় নাশকতার ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব এলাকায় পেট্রোলবোমা ও ককটেল দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে। জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত নাশকতাপ্রবণ জেলাগুলোÑ চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, বগুড়া, গাজীপুর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট, পাবনা, ফেনী, নীলফামারী, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, লক্ষীপুর ও কক্সবাজার। এছাড়া রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া, মাতুয়াইল কাঠেরপুল, ভাঙ্গাপ্রেস, কাজলা, ডগাইর, পারডগাইর, শ্যামপুর, নামাশ্যামপুর, ফতুল্লা, কমলাপুর রেলওয়ে বস্তি, মতিঝিল টিটিপাড়া বস্তি, রামপুরা, বনশ্রী, নতুনবাড্ডা, মধ্যবাড্ডা, বাড্ডার সাঁতারকুল, ভাটারা, মহাখালীর আমতলী মোড়, আব্দুল্লাহপুর, পল্লবীর কালশী নতুন রাস্তার মোড়, মিরপুর বেড়িবাঁধের চটবাড়ি ও দিয়াবাড়ি, আশুলিয়া মোড়, গাবতলী, আমিনবাজার, শ্যামলী টেকনিক্যাল মোড় ও মোহাম্মদপুর বেঁড়িবাধ এলাকা বোমাবাজিপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে অন্তত ৪০ স্পটে গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও র্যাবের তরফ থেকে গোপন সিসি ক্যামেরা বসানো আছে। আরও সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। এগুলো বসানো হয়েছে অত্যন্ত গোপন জায়গায়, যা বাইরে থেকে দেখা যায় না। বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদে, দেয়ালে বা সুবিধাজনক জায়গায় এসব গোপন ক্যামেরা বসানো আছে। এসব ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি দেখে ইতোমধ্যেই রাজধানী থেকে অন্তত ২৫ বোমাবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ককটেল ও পেট্রোলবোমাসহ নাশকতা চালানোর অস্ত্রশস্ত্র। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের নাশকতাপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে থাকা সিসি ক্যামেরা সচল রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। সিসি ক্যামেরার মালিকদের বোমাবাজ ও বোমাবাজির জন্য সংগঠিত হওয়ার দৃশ্য দেখামাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। অনেক বাসাবাড়ি, অফিস- আদালতে থাকা সিসি ক্যামেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে লাগানো হয়েছে। যদিও তা প্রচারে বিধিনিষেধ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত জেলাগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ও নাশকতাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই যে কয়েকটি ভয়াবহ নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, তা জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। সর্বশেষ কুমিল্লার মিয়ারবাজারে পেট্রোলবোমা মেরে আটজনকে হত্যা করা হয়েছে। এলাকাটিতে জামায়াত-শিবিরের প্রভাব রয়েছে। চলমান এসএসসি পরীক্ষার নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত জেলার নাশকতাপ্রবণ এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে থাকা সিসি ক্যামেরার ভিডিওফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা নষ্ট সিসি ক্যামেরাগুলোতে দ্রুত চালুর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাঁড়াশি অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে। দেশের বেশ কিছু এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সারাদেশে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের সহায়তা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে ৩২৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, অনেক বোমাবাজ ও তাদের মদদদাতারা বোমাবাজির আগে পুরো এলাকা রেকি করছে। বোমাবাজরা টার্গেটকৃত স্থানগুলোতে সিসি ক্যামেরা আছে কিনা তা আগাম জানার চেষ্টা করছে। বোমাবাজদের নির্দেশদাতারা তাদের টার্গেটে দৃশ্যমান সিসি ক্যামেরা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তথ্য সংগ্রহকারীদের সিসি ক্যামেরাগুলো ব্যক্তিগত তরফ থেকে লাগানো হয়েছে বলে অফিস- আদালত বা বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে জানানো হচ্ছে। এমনকি এসব সিসি ক্যামেরা অধিকাংশ সময়ই বন্ধ রাখা হয় বলেও সিসি ক্যামেরা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহকারীদের জানানো হয়ে থাকে। রাজধানীতে আরও সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। এছাড়া পুলিশ সদস্যের বুকে বডিওর্ন ক্যামেরা লাগিয়ে রাস্তায় নামানো হয়েছে। এসব ক্যামেরা দীর্ঘ সময় বিভিন্ন জায়গার ভিডিওফুটেজ সংগ্রহ করতে সক্ষম। এসব বডিওর্ন ক্যামেরা বেশিরভাগই লাগানো হচ্ছে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্যের গায়ে। গোপনে ভিডিও করতেই এমন কৌশল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী টানা অবরোধ আর খ- খন্ড হরতালে নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত ও বখাটে। তাদের নিজস্ব কোন বাহন নেই; যা দিয়ে তারা পেট্রোলপাম্প থেকে পেট্রোল বা অকটেন সংগ্রহ করতে পারে। তাদের কাছে সরবরাহ করা পেট্রোলবোমা ও ককটেল দলের তরফ থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও দেশে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীরা টাকার বিনিময়ে এসব বখাটে ও মাদকাসক্তদের দিয়ে বোমাবাজি করাচ্ছে। ইতোমধ্যেই সারাদেশ থেকে বোমাবাজির সময় গ্রেফতার হয়েছে অন্তত দুই শতাধিক। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অন্তত ৭০ জনই বখাটে ও মাদকাসক্ত। তারা বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দা। টাকার বিনিময়ে তাদের দিয়ে বোমা হামলা করানো হয়েছে। বোমা হামলাকারীরা গ্রেফতার এড়াতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছাড়াও বস্তিতে আত্মগোপন করছে। নাশকতায় ব্যবহৃত বোমা ও পেট্রোলবোমার কারিগরদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আবার পেশাদার বোমা প্রস্তুতকারীও রয়েছে। তারাই মূলত ককটেল ও পেট্রোলবোমা মাঠ পর্যায়ের বোমাবাজদের হাতে তুলে দিচ্ছে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে চলমান অভিযানে কুড়িটি তাজা বোমাসহ ঢাকার লালবাগ থেকে গ্রেফতার হয় থানাটির বিএনপির সভাপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার আলতাফ হোসেন, ২০ পেট্রোলবোমাসহ গেন্ডারিয়ার স্বামীবাগ থেকে যুবদলকর্মী মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন, গত ২১ জানুয়ারি মহাখালী টিবি গেট এলাকার আমিনুল ইসলাম ভিলার ছাত্র শিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে ১৩০ বোমা, পেট্রোলবোমা তৈরির জন্য মজুদ রাখা দুই লিটার পেট্রোল, ১০ কেজি পাথরের কুচি, এককেজি গান পাউডারসহ নাশকতা চালানোর অস্ত্রশস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় বনানী থানা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানসহ ৫ জন। এছাড়া লালবাগের ঢাকেশ্বরী এলাকার ৩১ নম্বর বাড়িতে বোমা তৈরিকালে বিস্ফোরণে আহত হয় হ্যাপি (১৪), রিপন (৬), বাপ্পী (২০) ও রিপনের মা ঝুমুর বেগম (২২)। পরবর্তীতে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানার সাধারণ সম্পাদক বাপ্পীর পরবর্তীতে মৃত্যু হয়।
×