ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে ফুলের বাজারে ধস

ভালবাসার গোলাপ বিক্রি হচ্ছে পানির দরে

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ভালবাসার গোলাপ বিক্রি  হচ্ছে পানির দরে

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিবসি, রডিস্টিক, কেলেন্ডোলা ও চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল ফোটাচ্ছে গদখালী এলাকার চাষীরা। কিন্তু হরতাল-অবরোধে ফুলের দাম নেই। সামনে ভালবাসা দিবস। মাঠে ফুলের বাহার। ফুটে আছে হাজার হাজার ফুল। কিন্তু কৃষকের মনে শান্তি নেই। হরতাল-অবরোধ কৃষকের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। দেশের এক তৃতীয়াংশ ফুলের চাহিদা মেটে যশোরের গদখালী ও শার্শায় উৎপাদিত ফুল থেকে। ঢাকা খুলনা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলাশহরে রফতানি করা হয় যশোরের ফুল। টানা হরতাল-অবরোধে যশোরে ফুলের বাজারে ধস নেমেছে। ফুল ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাসসহ বিভিন্ন প্রকার ফুল। ভ্যালেনটাইন ডেÑ ভাষাদিবসের ফুলের বাজার হারাচ্ছেন চাষীরা। কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। শার্শা ও ঝিকরগাছার ১ হাজারের বেশি ফুলচাষী হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। ক্রেতা নেই ফুল বাজারে। ক্ষেতেই শুকিয়ে ও পচে নষ্ট হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার ফুল। আধুনিকতার এ যুগে পিছিয়ে নেই ফুলচাষীরা। স্বল্প জমিতে অল্প খরচে অধিক মুনাফার আশায় যশোরের শার্শা ও ঝিকরগাছা এলাকার কৃষকরা ঝুঁকে পড়েছেন ফুলচাষে। ফুলের রাজ্যখ্যাত গদখালী ও শার্শায় তিনশ’ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে নজরকাড়া দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। টানা হরতাল ও অবরোধের কারণে ফুল রফতানি করতে না পারায় চাষীদের উঠেছে মাথায় হাত। ফুল বিক্রি করতে না পেরে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন চাষীরা। ১০ বিঘা জমিতে রজনী ও গাঁদা ফুলের চাষ করে ৫ লাখ টাকা ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন নাভারন কলাগাছি গ্রামের আসলাম ও নুর মোহাম্মদ। টানা হরতালের কারণে ইতোমধ্যে ফুল ক্ষেতেই তিন লাখ টাকার ফুল পচে ও শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে বলে জানান তারা। শার্শা উপজেলায় এবার ত্রিশ হেক্টর জমিতে ফুলচাষ হয়েছে বলে জানান কৃষি অফিসার হীরক কুমার সরকার। তবে বিপণনের অবস্থা ভাল থাকলে চাষ আরও বাড়বে, কৃষকরা হবে উপকৃত। ফুল রফতানিতে হরতাল অবরোধের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানান ফুলচাষীরা। টানা অবরোধ আর ক্ষণে ক্ষণে হরতালের কারণে ফুল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন যশোরের গদখালীর চাষীরা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য গদখালীতে এখন ২০ থেকে ৩০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে ভালবাসার অনন্য উপহার একেকটি গোলাপ। আর বাহারি গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধাও মিলছে নামমাত্র মূল্যে। ক্ষেতে নষ্ট হওয়ায় অনেক কষ্টে উৎপাদিত ফুল পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষীরা। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। এখানকার উৎপাদিত ফুলই দেশের মোট চাহিদার ৬৫Ñ৭০ ভাগ পূরণ করে থাকে। প্রতিদিন সকালে ঝিকরগাছার গদখালীতে বসে ফুলের পাইকারি বাজার। এ বাজার থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন জাতের ফুল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। কিন্তু টানা অবরোধের কারণে ফুল পাঠাতে পারছেন না চাষী ও ব্যবসায়ীরা। ফলে ক্ষেতের ফুল ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। ফুলচাষীরা বলছেন, ক্ষেতে বিপুল পরিমাণ ফুল ফুটলেও অবরোধের কারণে তা বিক্রি করতে পারছি না। এতে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সমিতির বা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের কোন পথ নেই। কৃষকেরা বলছেন, এ অবস্থায় গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরাসহ অতিকষ্টে উৎপাদিত ফুল বিক্রি হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। ফুলের চাষ ও এর পরিবহন-বিপণনসহ নানা কাজে গদখালীর এক লাখেরও বেশি মানুষ গত কয়েকদিন ধরে বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। ঝিকরগাছার নন্দী, ডুমুরিয়া গ্রামের ফুলচাষী গোলাম রসুল ১০ বিঘা জমিতে এবার বিভিন্ন জাতের ফুলচাষ করেন। আবহাওয়া ভাল থাকায় বাগানে আগের চেয়ে বেশি ফুল হয়েছে। তিনি আশা করেছিলেন, ফুল বিক্রি করে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারবেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় তার সে স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। ফুলচাষী গোলাম রসুল জানান, অবরোধের কারণে তার প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার রজনীগন্ধ্যার স্টিক নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, “প্রতিটি স্টিক তিন টাকা দরে বিক্রি করতে পারতাম। ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে এখন।” একই গ্রামের আব্দুর রহিম জানান, আশির দশকের শেষদিকে শের আলী প্রথম আমাদের এলাকায় ফুলের আবাদ শুরু করেন। তার দেখাদেখি ফুলচাষ ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে এ অঞ্চলের যে জমিতে কৃষক ধান কিংবা সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা এখন পুরোপুরি ফুল চাষের উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, “অন্য ফসলের তুলনায় ফুলচাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা ফুলচাষকে বেছে নিয়েছেন। “এখন আর ভারত থেকে ফুল আমদানি হয় না। আমরাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি শুরু করেছি।” গদখালী ফুলচাষী ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, “গত কয়েক দিনের হরতাল অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচীতে গদখালীর ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।” এভাবে চলতে থাকলে ফুলচাষ ও ব্যবসায় ধস নামবে বলে আশঙ্কা তার। তিনি বলেন, দেশের ফুল উৎপাদনের শতকরা ৭৫ ভাগই উৎপাদিত হয় যশোরের গদখালীতে। চাষ, পরিবহন, বিপণনসহ নানা কাজে এ খাতে কাজ করছেন এক লাখেরও বেশি মানুষ। “সপ্তাহের প্রতিদিনই যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে ফুলের পাইকারি বাজার বসে।” আব্দুর রহিম বলেন, “ফুলচাষে বিপ্লব ঘটেছে গদখালীতে। শার্শা, বেনাপোল, ঝিকরগাছার ৬০টি গ্রামে এখন প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ হচ্ছে। আর এ ফুলচাষের সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার কৃষক সরাসরি জড়িত।” শার্শা সদরের রাজনগর গ্রামের ফুলচাষী সাইফুল আলম জানান, টানা অবরোধে বাজার জমছে না। যানবাহন চলাচল না করায় দূর-দূরান্তের পাইকাররা আসছেন না। ঝিকরগাছার হাড়িয়া গ্রামের ফুল ব্যবসায়ী শাহাজাহান আলী বলেন, “অবরোধের কারণে বাজার না জমায় ফুলচাষীরা জমি থেকে বিক্রির উপযুক্ত ফুল তুলতে পারছেন না। হিমাগারে ফুল রাখার ব্যবস্থা না থাকায় লাখ লাখ টাকার ফুল ফেলে দিতে হচ্ছে। ধানের বিকল্প হিসেবে চাষীরা এতদিন ফুলচাষ করছিল, চোখের সামনে ফুল নষ্ট হতে দেখে পেশা বদলের চিন্তা করছেন অনেকে বলেন তিনি। বছরে ১২ হাজার টাকায় প্রতি বিঘা জমি ইজারা নিয়ে পুটাপাড়া গ্রামের আবুল কাশেম চার বিঘা জমিতে ফুলচাষ করেছেন। তার প্রতিটি গাছে ফুল ধরেছে। এখন একদিন পরপর ওই ফুল তুলতে হচ্ছে কিন্তু হরতাল-অবরোধে ফুলের বিক্রি না থাকায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। আবুল কাশেম বলেন, “পরের জমি ইজারা নিয়ে ফুলের আবাদ করেছি। প্রতিদিন ফুল বিক্রির যে টার্গেট নিয়ে ছিলাম হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তা শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।”
×