ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পণ্যবাহী ট্রাকে পেট্রোল বোমা ছোড়া হচ্ছে

সরেজমিন দিনাজপুর ॥ রাতে ১৭ স্পটে নাশকতা, এক মাস ধরে বন্ধ ৬০ ভাগ চালকল

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সরেজমিন দিনাজপুর ॥ রাতে ১৭ স্পটে নাশকতা, এক মাস ধরে বন্ধ ৬০ ভাগ চালকল

রাজন ভট্টাচার্য/সাজেদুর রহমান শিলু ॥ অবরোধ-হরতালে দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত দিনাজপুর জেলা ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী ও ক্যাডাররা চালাচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ইতোমধ্যে জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন একজন ট্রাকচালক ও তার সহকারী। বিভিন্ন নাশকতায় আহত হয়েছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ১৭টি স্পটে রাতে পণ্যবাহী পরিবহন লক্ষ্য করে বেশিরভাগ ছুড়া হচ্ছে পেট্রোলবোমা। সমানতালে চলছে ভাংচুরসহ নাশকতা। ১২ মামলায় এক হাজারের বেশি আসামি। গ্রেফতার হয়েছে দুই শ’র মতো। প্রায় দুই শ’! জামিনে বেরিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী। বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস তা-বে বিপাকে পড়েছে কৃষক ও শিল্প মালিকরা। এক মাসের বেশি সময় বন্ধ জেলার ৬০ ভাগ চালকল। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। তবে জেলা প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের কারণে সন্ত্রাসী তৎপরতা কিছুটা কমছে। দিনাজপুর জেলা প্রশাসক আহমদ শামীম আল রাজী জনকণ্ঠকে বলেন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা সম্মিলিতভাবে জনগণের নিরাপত্তা ও সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে তৎপর রয়েছে। তিনি জানান, দিনাজপুরের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে দূরপাল্লার পণ্যবাহি ট্রাক চলাচল যৌথবাহিনীর সহায়তায় স্বাভাবিক রয়েছে। আগামীতেও এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে বলে তিনি আশাপ্রকাশ করেন। জামিনে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী ॥ রাজনৈতিক সহিংসতায় দিনাজপুর জেলায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। নানা কৌশলে এসব মামলার আসামিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে ফাঁকা সড়কে বিচ্ছিন্নভাবে জ্বালাও পোড়াও ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো যুক্ত হয়েছে কারাগারে আটক অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসীর জামিনে মুক্ত হওয়ার ঘটনা। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী ব্যাপক সহিংস ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে এসব সন্ত্রাসীকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উচ্চ ও নিম্ন আদালতের নির্দেশে এসব সন্ত্রাসী এক সময় জামিনে মুক্তি পায়। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন আইনজীবী জামিনের জন্য ওইসব সন্ত্রাসীর পক্ষে তদবির করেন। কারাগার থেকে বেরিয়েই এসব সন্ত্রাসী নাশকতায় মেতে উঠছে। এদিকে দেশব্যাপী ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস প্রতিরোধে পাড়ায় মহল্লায় ‘সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও দিনাজপুরে এর কোন অস্তিত্ব নেই। জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা যায়, ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে ১২টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার বিপরীতে মামলা হয়েছে ১২টি। মামলায় আসামি করা হয় ১ হাজার ১শ’ ৫২ জনকে। আটক করা হয়েছে ১শ’ ৭৮ জনকে। পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মারাত্মক আহত হন ৬ জন ট্রাক শ্রমিক। জেলার ১৩টি উপজেলার ১৭টি স্পটে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দিনাজপুরে সহিংসতার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল পণ্যবাহী ট্রাক। যাত্রীবাহী কোন পরিবহনে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ অথবা অগ্নিসংযোগের কোন ঘটনা ঘটেনি। দিনাজপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, হরতাল অবরোধের নামে চলমান নৈরাজ্য রোধে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা না হলেও, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী-সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এ জন্য দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এলাকার সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। যেখানে যেখানে সহিংসতা ॥ ঘটনাস্থল দিনাজপুর শহরের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মুন্সিপাড়া। ৫ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় জেলা বিএনপির একটি মিছিল থেকে একটি বহুতল মার্কেটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বীমা অফিস ভাংচুর করা হয়। এই মার্কেটটির মালিক জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মির্জা আশফাক হোসেন। ভাংচুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বীমা অফিসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঘটনায় জেলা বিএনপির সভাপতি লুৎফর রহমান মিন্টুসহ প্রায় ২১ জনকে আসামি করা হয়। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে লুৎফর রহমান মিন্টু বর্তমানে আত্মগোপন করে দলের কর্মকা- পরিচালনা করছেন। ৯ জানুয়ারি রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে বীরগঞ্জ-কাহারোল মহাসড়কের কাহারোল উপজেলার মল্লিকপুর নামক স্থানে পেট্রোলবোমার আগুনে আলু বোঝাই একটি ট্রাক সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। একই রাতে দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়কের চিরিরবন্দর উপজেলার সাহাপাড়া নামক স্থানে দুর্বৃত্তরা ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালায়। পেট্রোলবোমার আগুনে মালামালসহ ২টি ট্রাক ও একটি ট্যাংলরি পুড়ে যায়। ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বীরগঞ্জ উপজেলার ছোট বটতলী হিমাগারের সামনে একটি ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় দুর্বৃত্তদের মারপিটে ট্রাকের শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হন। একই দিন সদর উপজেলার সদরপুর টেক্সটাইল মিলের সামনে গাছ ফেলে সন্ত্রাসীরা ২টি ট্রাকের গতিরোধ করে। এরপর ট্রাক ২টিতে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়। একই তারিখ রাত বিরল উপজেলার তামান্না হাসকিং মিলের সামনে দুর্বৃত্তরা একটি পণ্যবাহী ট্রাকের কেবিনে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই তারিখ রাতে কোতোয়ালি থানার চকরামপুর স্থানে দুর্বৃত্তরা একটি ট্রাকে ভাংচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে কোতোয়ালি থানার খোসালপুর সড়কে দুর্বৃত্তরা একটি ট্রাকে পেট্রোলবোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০ জানুয়ারি রাতে চিরিরবন্দর উপজেলার লালদীঘি নামক স্থানে একটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২১ জানুয়ারি রাতে দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কে কাহারোল উপজেলার ভাতগাঁ ব্রিজের কাছে দুর্বৃত্তরা নাসির গ্লাস কোম্পানির একটি পণ্যবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছুড়ে। এতে ট্রাকচালক রফিকুল ইসলাম (৪৫) ও তার সহকারী মনির হোসেন (৩৭) আহত হন। একই তারিখ রাত সাড়ে ৯টায় দিনাজপুর-বগুড়া মহাসড়কে ঘোড়াঘাট উপজেলার নুরজাহান বালিকা মাদ্রাসার সামনের সড়কে দুর্বৃত্তরা একটি ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে চালক আহত হন। সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি মধ্যরাতে দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়কের চিরিরবন্দর উপজেলার বৈকুন্টপুর নামক স্থানে দুর্বৃত্তরা একটি ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে আলু বোঝাই ট্রাকটি পুড়ে যায়। মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন ট্রাকচালক আব্দুল মালেক (৪৫) ও তার সহকারী আব্দুর রশিদ (৩৬)। আহতদের প্রথমে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাদের রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জানুয়ারি ট্রাক হেলপার আব্দুর রশিদ মারা যান। ২৬ জানুয়ারি চিকিৎসাধীণ অবস্থায় মারা যান ট্রাকচালক আব্দুল মালেক। জানতে চাইলে দিনাজপুর পুলিশ সুপার মোঃ রুহুল আমিন সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধ সম্পর্কে জনকণ্ঠকে বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশ বাহিনী সর্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। যানবাহন চলাচল, বিশেষ করে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল সচল রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যৌথবাহিনীর প্রহরায় প্রতিদিন পণ্যবাহী ট্রাকসমূহ নিদিষ্ট গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। দূরপাল্লার দিবাকালীন কোচসমূহ স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় নৈশ্যকালীন সবগুলো যাত্রীবাহী কোচ চলাচল শুরু করেছে। দিনাজপুর জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ভবানী প্রসাদ আগরওয়াল জানান, দিনাজপুর জেলার ৩০টি রুটে ৬ জানুয়ারি থেকে গণপরিবহন নিরাপত্তাহীনতার কারণে চলাচল বন্ধ ছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বিধানের আশ্বাস দেয়ার পর বাসের মালিকরা রাস্তায় আবার গাড়ি নামাচ্ছেন। তিনি জানান, দিনাজপুরের মালিক সমিতির আওতায় ৩শ’ ১৭টি যাত্রীবাহী বাসে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক ও চালক নিয়োজিত রয়েছেন। জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ রফিক জানান, বুধবার থেকে জেলার সবকটি রুটে গণপরিবহন আবার চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির মুখে স্থানীয় শিল্প মালিকরা ॥ প্রায় ১ মাসের টানা অবরোধে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দিনাজপুরের অন্যতম শিল্প চালকলের মালিক গ্রুপ ও শ্রমিকরা। দেশের অন্যতম চাল যোগানকারী জেলা দিনাজপুরে অবরোধের ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলায় ২ হাজার চালকলের মধ্যে ১শ’ ৩৫টি অটোমেটিক মিল। বাকিগুলো মেজর ও হাসকিং মিল। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক। স্বাভাবিক অবস্থায় দিনাজপুর থেকে প্রতিদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও চৌমুহনীসহ দেশের অন্যান্য জেলায় ৫০০ করে ট্রাক যেত। কিন্তু ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ২০ দলের টানা অবরোধের ফলে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চাল পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২১ জানুয়ারি থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় যৌথবাহিনীর প্রহরায় এখন ১৫০ থেকে ২০০টি চাল বোঝাই ট্রাক চলাচল করছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই চাল পরিবহন ব্যবস্থা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। দিনাজপুর জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক রেজা হুমায়ুন ফারুক চৌধুরী জানান, অবরোধের ফলে চালকল মালিকরা অথনৈতিকভাবে নিদারুন সংকটে পড়েছেন। জেলার প্রায় ৬০ ভাগ চালকল ১ মাস ধরে বন্ধ। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের কমিশন সুদ দিতে না পারায় দেউলিয়ার পর্যায়ে পড়েছেন। ব্যাংক ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা-দিনাজপুরের ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা। আর এখন ২৪ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাক ভাড়া করতে হচ্ছে। চাল পাঠাতে না পেরে মিলগুলোর গুদামে জমে রয়েছে বিপুল পরিমাণ চাল।
×