ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীতে গণধোলাই খাচ্ছে বোমাবাজরা, হাতেনাতে আটক জামায়াত নেতা ॥ র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হত ২

নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে মানুষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নাশকতাকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না অবুঝ শিশু, নারী, মন্ত্রী, এমপি, সাধারণ মানুষ এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। আর বাস-ট্রাক-রেলে ধারাবাহিকভাবে নাশকতা চালানো হচ্ছে। বুধবার জয়পুরহাটে বেইলি সেতুর পাঁচটি পাটাতন খুলে আট ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল অবরোধকারীরা। অতিষ্ঠ জনতা নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে। বুধবার রাজধানীতে মন্ত্রীর গাড়িতে বোমা হামলা করে পালানোর সময় গণধোলাই দিয়ে দুই বোমাবাজকে পুলিশে দিয়েছে জনতা। এছাড়া হাজারীবাগ থানাধীন বেড়িবাঁধ এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে বোমা হামলা চালানোর সময় বোমাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ে গণধোলাই খেয়েছে জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা ও এক যুবদল নেতা। এছাড়া বুয়েটে পেট্রোলবোমা মেরে নাশকতা চালানোর সময় দুই ছাত্রদল নেতা গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছে। এ দু’জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। আর র‌্যাবের গাড়িতে পেট্রোলবোমা মেরে র‌্যাব সদস্যদের পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকালে বন্দুকযুদ্ধে দুই বোমাবাজের মৃত্যু হয়েছে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে সারাদেশে চলমান সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে দেড় শতাধিক। উদ্ধার হয়েছে পিস্তল, রিভলভার, পেট্রোলবোমা, ককটেলসহ নাশকতা চালানোর অস্ত্রশস্ত্র। গত ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী বিএনপির ডাকা অবরোধ-হরতালে সারাদেশে ধারাবাহিকভাবে নাশকতা চালাচ্ছে কর্মসূচী আহ্বানকারীরা। নাশকতার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কেউই। না মন্ত্রী, না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্য বা তাদের যানবাহন। পেট্রোলবোমা হামলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত অর্ধশত জনের। আহত হয়েছেন অন্তত হাজারখানেক। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর শত শত মানুষ। আহতদের অনেকেই চোখ বা হাত-পা বা শরীরের অন্য কোন অঙ্গ খুঁইয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। অবরোধকারীরা শত শত যানবাহন যাত্রীসহ পুড়িয়ে দিয়েছে। বুধবার ভোরে জয়পুরহাট সদরে পাকারমাথা-বটতলী বাইপাস সড়কে একটি বেইলি সেতুর পাঁচটি পাটাতন খুলে ফেলে অবরোধ-হরতাল সমর্থকরা। এতে প্রায় আট ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। দুপুর একটার দিকে পাটাতন নতুন করে বসানো হলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ নিয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা নাশকতাকারীদের ধরতে নানা জায়গায় খোঁজখবর নিচ্ছেন। এদিকে মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে নাশকতাকারীদের ধরতে অভিযানে যাচ্ছিল র‌্যাবের একটি টহল দল। দলটি যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল কাঠেরপুলে পৌঁছলে রাস্তার পাশের গলি থেকে র‌্যাবের গাড়ি লক্ষ্য করে একটি পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে বোমাবাজরা। গাড়ির চালক র‌্যাব সদস্য আগুনের কু-লী আসতে দেখে দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষে। কাঁচের বোতলে তৈরি পেট্রোলবোমাটি গাড়ির সামনে পড়েই আগুন ধরে যায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য পেট্রোলবোমাটি র‌্যাবের গাড়িতে পড়েনি। গাড়িটি সময়মতো ব্রেক কষতে না পারলে র‌্যাবের গাড়িটি পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মৃতু্যু হতে পারত অন্তত ১০ র‌্যাব সদস্যের। অল্পের জন্য গাড়ি ও জানমাল রক্ষা হয়। এমন ঘটনায় হতবাক র‌্যাব সদস্যরা। সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাব সদস্যরা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বোমাবাজদের ধরতে একযোগে আশপাশের অলিগলিতে অভিযান শুরু করে। এ সময় একটি গলিতে থাকা বোমাবাজরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। র‌্যাব তাদের পিছু নেয়। বোমাবাজরা র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে হাতবোমা ছুড়ে মারে। সেইসঙ্গে গুলি চালাতে থাকে। র‌্যাবও বোমাবাজদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি চালায়। কয়েক মিনিট ধরে বোমাবাজ ও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে স্থানীয় জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আলো জ্বেলে সেখানে তল্লাশি অভিযান চালায় র‌্যাব। রাত সাড়ে তিনটার দিকে তল্লাশি অভিযানে একটি গলি থেকে একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, কয়েকটি হাতবোমা ও কয়েকটি পেট্রোলবোমাসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুইজন উদ্ধার হয়। আহতদের ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ভোরে তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে বুধবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজধানীর ভাষানটেক থানাধীন শিল্পীরটেক বালুমাঠ থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। চেকশার্ট ও জিন্সপ্যান্ট পরিহিত নিহত যুবকের বুকে ও কানের কাছে গুলির চিহ্ন রয়েছে। লাশ তিনটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের পরিচয় মেলেনি। বোমাবাজি করতে রাজি না হওয়ায় বা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে বা আর্থিক লেনদেনের সূত্র ধরে ওই যুবককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে। বুধবার দুপুর দুইটা দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় অবরোধ-হরতালকারীরা। তবে কোন মন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল তা জানা যায়নি। এ সময় দুই বোমাবাজকে ধরে গণধোলাই দেয় জনতা। পরে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আটক দুই যুবক নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে দাবি করেছে। বোমাবাজরাই পরিকল্পিতভাবে দুইজনকে বোমাবাজ বলে প্রচার চালিয়ে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে কি না তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াত-শিবির অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জোটবদ্ধ হয়ে ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম। চলমান অবরোধ-হরতালে নাশকতাকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশুরা। সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে বোমা হামলায় আহত হয় তিন বছরের ছোট্ট শিশু জুঁই মনি। বিজয়নগরের হরেশপুরের বাড়ির সামনে খেলার সময় সেখান দিয়ে অবরোধ-হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছিল। মিছিল থেকে একের পর এক বোমা হামলা হতে থাকে। সেই বোমায় আহত হয় জুঁই। জুঁইকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। জুঁই যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার কষ্ট দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। চোখে জল আসছে চিকিৎসক ও সেবিকাদেরও। দেশব্যাপী চলমান অবরোধ-হরতালে বেপরোয়াভাবে নাশকতা চালানো হচ্ছে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে সারাদেশে যৌথবাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। চলমান অভিযানে বুধবার দেড়টার দিকে মতিঝিল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ অফিসের সামনে থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ এলাকার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন ও একই জেলার রামগতি এলাকার বিএনপির আরেক সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিজান পুলিশের হাতে আটক হয়। গ্রেফতারকৃতরা মতিঝিল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ কার্যালয়ে অনশনরত দলটির সভাপতি কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন বলে দাবি করেছেন। দুপুর আড়াইটার দিকে হাজারীবাগ থানাধানী বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তিনটি ককটেলসহ জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ফিরোজ ও হাজারীবাগের টালী ইউনিট যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নূর মোহাম্মদ উজ্জ্বল হাজারীবাগ থানা পুলিশ ও জনতার হাতে আটক হয়। পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে ঝালকাঠিতে একটি, ধানম-িতে তিনটি ও হাজারীবাগ থানায় দুটি মামলা রয়েছে। আর উজ্জ্বলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় পুলিশ ওপর হামলার ঘটনায় একটি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা উদ্ধারকৃত বোমাগুলো নিয়ে রাস্তার পাশে বসে ছিল। তারা যাত্রীবাহী বাসে বোমা হামলার চালানোর চেষ্টা করছিল। তারা বোমা বের করে হামলা করার চেষ্টা করলে পুলিশ ও জনতা তাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে ফেলে। তারা বোমাগুলো বিস্ফোরণের ভয়ে মাটিতে রেখেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় জনতা তাদের ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। বুধবার দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল-অবরোধের সমর্থনে বিক্ষোভ-মিছিল বের করে ছাত্রদলের নেতারা। বুয়েটের সামনে ছাত্রদল নেতা শাহাদাৎ হোসেন ও গোলাম কিবরিয়া গণধোলাইয়ের শিকার হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় পেট্রোলবোমা। গণধোলাইয়ের শিকার দুই ছাত্রদল নেতাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে বুয়েট ছাত্রলীগ তিতুমীর হল শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ কনক বলেন, ছাত্রদল মিছিল নিয়ে নাশকতার চেষ্টা করলে গণধোলাইয়ের কবলে পড়ে দুই ছাত্রদল নেতা। এছাড়া রাজধানীতে চলমান অভিযানে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জন আটক হয়েছে। অন্যদিকে সারাদেশে চলমান অভিযানে যৌথ বাহিনীর হাতে দেড় শতাধিক গ্রেফতার হয়েছে।
×