ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তপ্ত সংসদ ॥ খালেদাকে গ্রেফতার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তপ্ত সংসদ ॥ খালেদাকে গ্রেফতার দাবি

সংসদ রিপোর্টার ॥ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোলবোমা মেরে ৭ নিরীহ বাসযাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংসদ। সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা দ্রুত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার এবং সহিংসতা-নাশকতা দমনে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে প্রয়োজনে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনে প্রণীত ‘টাডা’ আইনের মতো কঠোর নতুন আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। কেউ কেউ এসএসসি পরীক্ষা প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নামিয়ে যৌথ অভিযান চালানোরও দাবি জানিয়েছেন। ক্ষোভে ফেটে পড়া সংসদ সদস্যরা অভিন্ন কণ্ঠে বলেন, বিএনপি নেত্রী যা করছেন, তাতে তিনি আর একটি মুহূর্ত কারগারের বাইরে থাকতে পারেন না। মঙ্গলবার ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে মাগরিবের নামাজের পর পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত বিতর্কে অংশ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এ দাবি জানান। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত এই বিতর্কে অংশ নেন সরকারী দলের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, ড. হাছান মাহমুদ, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, মনিরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম বাবু, তালুকদার মোঃ ইউনুস, জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল, জাতীয় পার্টির শওকত চৌধুরী, পীর ফজলুর রহমান, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম ও তাহজীব আলম সিদ্দিকী। পয়েন্ট অব অর্ডারে বিতর্কের সূত্রপাত করে সরকারী দলের মনিরুল ইসলাম বলেন, খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রতিদিন পুড়ে অঙ্গার হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মঙ্গলবার ভোরে পেট্রোলবোমা হামলায় আরও ৭ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে দু’জন আমার নিকটাত্মীয়। নিহত নূরজাহান পপলু একজন ধর্মপ্রাণ পরহেজগার মানুষ ছিলেন। তাঁকে হত্যা করে করা হলো কেন? তাঁর ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ে মাইশাও নিহত হয়েছে। এখন খালেদা জিয়া কী জবাব দেবেন? তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সরকারী দলে থাকলে নির্যাতন করেন, বিরোধী দলে থাকলেও করেন। এখন দু’জায়গা হারিয়েও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছেন। আর সহ্য নয়, আন্দোলনের নামে সহিংসতা-নাশকতাকারীদের কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ক্ষমতার লোভ-লালসায় দগ্ধ হচ্ছে আজ নিরীহ মানুষ, জ্বলছে পুরো দেশ। পুড়ছে আামাদের নীতি, আদর্শ ও মানবতাবোধ। বিচ্ছিন্নতাবাদ বা সন্ত্রাসের কাছে গণতন্ত্র কখনও বন্দী হয় না। গণতন্ত্রের বিজয় হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর কোন দেশেই প্রচলিত আইন দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করা যায় না। তাই আমাদের ভাবতে হবে নতুন আইনটি কী হবে? প্রয়োজনে ভারতের ‘টাডা’র মতো কঠিন স্পেশাল আইন করতে হবে। যাতে নাশকতাকারীদের দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক রাখা ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাশকতা-সহিংসতা-ফ্যাসিজম চালু করতে চান। জাতীয় সংসদ এমন অবস্থায় চুপ করে থাকতে পারে না। নাশকতা দমনে সরকার যে কোন ব্যবস্থা নিলে জনগণ তাতে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছে। এখনই সময়, কোন দয়া বা মায়া নয়, কঠোরহস্তে সন্ত্রাসকে পরাজিত ও নাশকতাকারীদের নির্মূল করে গণতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ করতে হবে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর উদ্ধৃতি করে বলেন, পরীক্ষা দিতে দুই নাতনীকে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছেন খালেদা জিয়া। ভেবেছিলাম উনি দেশের ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে অবরোধ-হরতাল উঠিয়ে নেবেন। পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেবেন। কিন্তু তা না করে আবার নতুন করে হরতালের নামে বোমাতাল, আগুন দিয়ে মুত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার কর্মসূচী দিয়েছেন। পাকিস্তানের পেশোয়ারায় একটি স্কুলে জঙ্গীরা হামলা করে সাড়ে তিন শ’কে হত্যা করেছে কেন তাঁরা পড়াশোনা করছে এই অপরাধে। ঠিক একই কারণে খালেদা জিয়ারা ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মায়ের কোল খালি করছেন, আল্লাহ তাঁর কোল খালি করেছেন। বিএনপি-জামায়াতের ভ-ামি, ইসলামবিরোধী কর্মকা- মধ্যপ্রাচ্যের সামনেও পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় সৌদি আরব শ্রম বাজার খুলে দিয়েছে। বিএনপি নেত্রীকে বলব-আল্লাহ ইশারা বোঝেন, হুঁশে আসুন। প্রত্যেক দিন যেভাবে মানুষকে পুড়িয়ে মারছেন, এতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে। সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, অবশ্যই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবে। চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, পাকিস্তানের পেতাত্মারা আজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি নেত্রী একাত্তরের কায়দায় ৬০ জন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। এটা সরকার পতনের আন্দোলন নয়, নিজেকে, নিজের পুত্রকে মামলা থেকে বাঁচাতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় আন্দোলনের নামে সহিংসতা-নাশকতা চালাচ্ছেন। খালেদা জিয়াকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর নয়। আমরা দুর্বল নয়। অবশ্যই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সুন্দর-সুষ্ঠুভাবে এসএসসি পরীক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা সবাই মাঠে থাকব। জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল বলেন, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনার টেবিল সাজানো হয় না। যেটা চলছে অনেকে পাগলামি মনে করছে, কিন্তু তা মোটেও পাগলামি নয়। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে, আর এসব করছেন একজন ‘মাস্টারমাইন্ড’। গ্যাংগ্রিন হলে তা কেটে ফেলতে হয়। খালেদা জিয়া এখন দেশের জন্য গ্যাংগ্রিনে পরিণত হয়েছেন। তাই এই গ্যাংগ্রিনকেও ছেটে ফেলতে হবে। বিএনপি নেত্রী আইনের উর্ধ্বে নন। খালেদা জিয়া যে অন্যায়, অবিচার ও কদর্য আচরণ করেছেন, সে জন্য তিনি এক মিনিটও বাইরে থাকতে পারেন না। কাশেমপুরে নিতে হবে। টেলিফোনেই তিনি নাশকতার নির্দেশ দিচ্ছেন। খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করব-এত আক্রোশ থাকলে আমাদের ওপর (সংসদ সদস্য) আক্রমণ করুন, মারা গেলেও দুঃখ পাব না। দয়া করে আর নিরীহ মানুষকে হত্যা করবেন না। জাতীয় পার্টির শওকত চৌধুরী বলেন, সরকারী দলের নেতারা গরম গরম কথা বললেও বাস্তবে কঠোর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এক মাস ধরে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও ও পুড়িয়ে মানুষ খুন চলছেই। বিএনপি-জামায়াত পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, বিশ্ব ইজতেমা এমনকি এসএসসি পরীক্ষাকেও তোয়াক্কা করছে না। এমনকি নিজের পুত্র কোকো মারা গেলেও বিএনপি নেত্রী অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করেননি। এর পেছনে কোন শক্তি আছে? কোন অন্ধকারের অপশক্তির শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বিএনপি নেত্রী এসব করে যাচ্ছেন, তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। দেশকে কেউ রসাতলে ঠেলে দেবে তা মেনে নেয়া যায় না। বিকল্প রাস্তা বের করে এই সন্ত্রাস-অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করে দেশকে রক্ষা করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দাবি জানান। ড. হাছান মাহমুদ বলেন, পৃথিবীর যেখানে জাতিগত সংঘাত হচ্ছে, সেখানেও এমনভাবে পেট্রোলবোমা মেরে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেনি। যুদ্ধের সময়ও বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা হয় না। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেই যাচ্ছেন। তাঁর নির্দেশেই কুমিল্লায় বাসে পেট্রোলবোমা মেরে ঘুমন্ত ৭ জন মানুষকে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াত জঙ্গীজোট বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চাইছেন। ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে নাতনিকে মালয়েশিয়ায় পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির পাশাপাশি নতুন আইন করে সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে নাশকতাকারীদের মৃত্যুদ- দেয়ার দাবি জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বিএনপি নেত্রীর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি নেত্রী দরজা বন্ধ করে প্রধানমন্ত্রীকে সমবেদনা জানাতে না দিয়ে আলোচনার দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। সহিংসতা-জঙ্গী নেত্রী হয়ে খালেদা জিয়া ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতার পথ থেকে সরে না আসলে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বলেন, খালেদা জিয়া জঙ্গী-সন্ত্রাসী ও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশকে জ্বালিয়ে মারছেন। বিক্ষুব্ধ দেশবাসী আজ রাজপথে নেমে আসছে। খালেদা জিয়া যে দেশদ্রোহী কাজ করছেন তাঁর ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হবে। তিনি বলেন, পরীক্ষার মধ্যে খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করেন, তবে পরীক্ষার কয়েকদিন সারাদেশে সেনাবাহিনী নামাতে হবে। সেনাবাহিনীসহ যৌথবাহিনী নামিয়ে দেশকে শান্ত করতে হবে। সন্ত্রাসীদের যেখানেই দেখা যাবে সেখানেই গুলি করার আদেশ দিতে হবে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, পাকিস্তান দূতাবাসের এক কর্মকর্তা মাযহার খান নাশকতা-সহিংসতার ইন্ধনদাতা, আইএসআইএয়ের এজেন্ট হয়ে কাজ করেছে। পাকিস্তান সরকার তাকে ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকার কেন এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে প্রতিবাদ করছে না কেন? এ রকম মাযহার খান আরও কিছু দূতাবাসে লুকিয়ে আছে কি না তা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে।
×