ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে শিশু শ্রমের চিত্র ॥ বিশ্বে অবস্থান দ্বিতীয়, সংখ্যা ৭৯ লাখ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাংলাদেশে শিশু শ্রমের চিত্র ॥ বিশ্বে অবস্থান দ্বিতীয়, সংখ্যা ৭৯ লাখ

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ১১ বছরের শিশু কাওসার। রাজধানীর ফার্মগেটে ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে শীতের কাপড় ও মুজো বিক্রি করে। বাবা-মাকে হারিয়ে নানার সঙ্গে তেজকুনীপাড়ায় তার বসবাস। প্রচ- শীতের রাতে নিজের শীত নিবারণ করতে না পারলেও শীতের বস্ত্র বিক্রি করে অন্যদের শীত নিবারণে সহায়তা করছে। কনকনে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে সকাল থেকে শুরু করে রাত ১০ অবধি চলে তার এই পরিশ্রম। দু’মুঠো ভাতের জন্য তার এই সংগ্রাম। সারাদিন পরিশ্রম শেষে তার আয় ১৫০ টাকার কাছাকাছি। সহপাঠীদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় আর বিদ্যালয়ে বই নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করার কথা থাকলেও তাকে এখন চিন্তা করতে হয় জীবিকার! হিউম্যান হলারে ঢাকা শহরের সর্বত্রই শিশু শ্রমিকদের দেখা মেলে। চান মিয়া (১০) তাদের একজন। বাবা মোমেন রিক্সাচালক। মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তিন সন্তানের জনক মোমেন দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বাধ্য হয়ে চান মিয়াকে সারাদিন হিউম্যান হলারে কাজ করতে হচ্ছে। প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে মহাখালী থেকে মিরপুর-১ এই রাস্তায় ভাড়া সংগ্রহে তার দিন কাটে। যাত্রী সাধারণের অসৎ আচরণ ছাড়াও গাড়ি চালকের শাসানিত আছেই। সারাদিন খাটুনি শেষে তার আয় মাত্র ১০০ টাকা। নির্মম কষ্টে কাটছে তার জীবন। সে জানায়, দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্যই তার এই পথ বেছে নেয়া। ২০১১ সালের সরকারী এক জরিপে দেখা যায়, দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। তার মধ্যে শহরাঞ্চলে ১৫ লাখ ও গ্রামাঞ্চলে ৬৪ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। ওই জরিপে দেখা যায় ৪৫টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এসব শিশুরা জড়িত। একাধিক তথ্যমতে, বিশ্বে শিশু শ্রমের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালিত ২০১৩ সালের এক অপ্রকাশিত জরিপ সূত্রে জানা যায়, নতুন এই পরিসংখ্যানে পূর্বের চেয়েও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। পূর্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৭৯ লাখ হলেও, বর্তমান জরিপে এই সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গৃহীত নানা পদক্ষেপের কারণে পূর্বের তুলনায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। পোশাক শিল্পে পুরোপুরি শিশু শ্রম বন্ধ হওয়ায় এর অন্যতম একটি কারণ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অপ্রকাশিত ওই জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে ফোর্স লেভার তেমন নেই। পোশাক শিল্পে শিশু শ্রম পুরো বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের জন্য ইতিবাচক। তবে ছোট ছোট পোশাক কারখানায় এখনও গুটিকয়েক শিশু শ্রমিকের উপস্থিতির কথা শুনা যায়। ২০১৩ সালে পরিচালিত সর্বশেষ ওই জরিপের আনুষ্ঠানিক ফলাফল আগামী মার্চ মাসে প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে। জরিপের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি তাই শিশু শ্রমিকের বর্তমান প্রকৃত সংখ্যা জানাতে নারাজ হন এবং জরিপ সম্পর্কে তথ্য জানাতে অপারগতা জানান। তবে তাদের সকলের অভিমত প্রকাশিতব্য ওই জরিপে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে আসবে। তবে, বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন। শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি বলছেন, শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যান বা জরিপ থেকে এরা বাদ পড়ে যায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটই এর মূল কারণ। অধিকাংশ সময় সচেতন মহলও মানবিক কারণে এই শিশুদের কাজ দিতে বাধ্য হন। কাজ না পেলে ওই শিশুদের জীবনে শঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়। অপরাধমূলক নানা কাজে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে প্রবল। শিশু শ্রমিক কমে যাওয়ার প্রসঙ্গকে ‘একটি অযৌক্তিক দাবি’ আখ্যা দিয়ে এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, শিশু শ্রম কমেছে বলে আমি মনে করি না। এটি একটি নিছক ভুল ধারণা। শিশুরা কাজের এক ক্ষেত্র থেকে আরেক ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হচ্ছে, ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় শিশু শ্রমিক হ্রাস পাচ্ছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শিশু শ্রম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন (২০০৬) অনুসারে শ্রমিকের বয়স কোনক্রমেই ১৪ এর নিচে হওয়া যাবে না। আইনটি অনেক ক্ষেত্রেই কাগুজে মাত্র, বাস্তবে ১৪ বছরের নিচের বহু শিশুই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, যখন কোন শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে তখন তা শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য হবে। ২০০৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন। এর মধ্যে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকার রক্ষা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম অর্থাৎ স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা শিশুর ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদ আশঙ্কা করে, এমন কাজ যেন না হয় তার ব্যবস্থা নেবে’। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শিশু সনদের এই ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশার তালিকা চূড়ান্ত করে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বহু পূর্বেই সরকারীভাবে সারাদেশে ৯৯ শতাংশের বেশি শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে এই ঝরে পড়া শিশুদের বড় অংশটি নানাভাবে শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এদের কেউ কেউ বাস, টোম্পো, হিউম্যান হলারে সহকারী হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। বেশিরভাগ সময় এদের ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। কেউ কেউ চায়ের দোকান, হোটেল, রেস্তরাঁসহ মোটর গাড়ি ও রিক্সার গ্যারেজ, সাইকেল নির্মাণ কারখানা, ইটভাঁটিসহ নানা ধরনের ছোট ছোট কারখানায় কাজ করছে। পোশাক শিল্পে পূর্বতন সময়ে শিশু শ্রমিক লক্ষ্য করা গেলে বর্তমানে পোশাক শিল্প খাত তাদের এই কলঙ্ক মোচন করেছে। বাসা বাড়িতে এখনও শিশু শ্রমিক লক্ষ্য করা যায়। মেয়ে শিশু শ্রমিকের পাশাপাশি ছেলে শিশুদেরও রান্না-বান্নার কাজে পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। মিজবাহ (৯) রাজধানী মগবাজার সংলগ্ন একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করে। শিশুটিকে সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা কাজ করে যেতে হয়। এই সময়ে কোন কাজে বিন্দুমাত্র ভুল হলে তাকে লোহার যন্ত্রপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়। মিজবার বাবা সুমন পেশায় একজন কসাই, মা আছমা বেগম গৃহিণী। মাদারীপুরের গ্রামের বাড়িতে সে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সমাপনী পরীক্ষায় ফেল করায় পরিবার থেকে তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া হয়। মিজবাহর মমতাময়ী মা তার স্বামীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ছেলেকে দূরের স্কুলে পড়তে পাঠায়; তবে সে পথেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বয়ং বাবা। কিন্তু অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কথা ছেলেকে বুঝতে দেয়নি তার পরিবার। ‘লেখাপড়ায় অমনোযোগী’ এই বাহানায় তাকে কাজে পাঠানো হলো। আর ছেলে এখন কোন টাকা ছাড়াই বিনে পয়সায় হাঢ়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে একটি অটো মোবাইলে। শুধু মিজবাহ নয় সিয়াম (১০)সহ বহু শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় লেখাপড়ায় ভাল নয় কিংবা পড়তে ভাল লাগে না এমন মর্মেও তাদের শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ফার্মগেট, কাওরান বাজার, বাংলামটর, বেইলি রোড, মগবাজার ও মহাখালীর বেশ কয়েকটি গ্যারেজে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় ওইসব গ্যারেজে কাজ করা অধিকাংশের বয়স ১৪ এর নিচে। শিশু শ্রম বন্ধে প্রতিরোধমূলক নানা ব্যবস্থা থাকলেও তা সহজেই বন্ধ হচ্ছে না। এই শিশুরা বাধ্য হয়ে শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার তা জানা সত্ত্বেও নানাভাবে এদের নির্যাতন করা হয়। সমাজের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশু শ্রমিকদের নির্যাতনের পেছনে মূল কারণ মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিকভাবে অসচেতনতাই নির্যাতনের পেছনে মূল অনুঘটক। শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের নির্যাতন বন্ধে একমাত্র আইনই প্রধান হাতিয়ার সে ভাবনাটি নিছক ভুল, মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নির্যাতন বন্ধের প্রধান হাতিয়ার বলে মনে করেন অনেকেই। প্রচলিত আইনে শিশু শ্রম বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যকেই দায়ী করা হচ্ছে। শিশু শ্রম বন্ধে আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য উপাত্তে ইতিবাচক অনেক তথ্য উঠে আসলেও, সমাজের সর্বত্রই চোখ মেলে তাকালে দেখা যাবে অবর্ণনীয় কষ্টে রয়েছে সাধারণ সমাজ থেকে ছিটকে পড়া একটি শিশু শ্রেণী। শ্রমের বিনিময়েই জীবিকা নির্বাহ করছে তারা! তাদের দেখার কেউ নেই! আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। বেঁচে থাকার জন্য তাদের বেচে নিতে হয় এই পথ, সেখানে আর আইন করে কতটা বন্ধ করা যাবে শিশু শ্রম? মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান আরও বলেন, অর্থনৈতিক মুক্তিই একমাত্র শিশু শ্রম বন্ধ সহায়ক হতে পারে। দেশের অর্থনীতি পুরো স্বচ্ছল হলে শিশু শ্রম কমে আসবে। কোন বাবা-মা তার ছেলেমেয়েকে বাধ্য হয়ে কাজে দেয় না। শিশু শ্রম বন্ধে আইন বা সচেতনতা মানবিক কারণে তেমনভাবে কার্যকর নয়। তাদের তো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল সূচকে অগ্রগতি হলে দেশের প্রেক্ষাপট বদলে যাবে, আর তখনই শিশু শ্রম বন্ধ হতে পারে। তবে শিশু শ্রমিকদের নির্যাতন বন্ধে সচেতনতাই মুখ্য।
×