ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে রাজপথ

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে রাজপথ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাস্তায় কফিন। সারিবদ্ধ লাশের মিছিল। পেট্রোলবোমায় দগ্ধ মানুষ। পোড়া গাড়ি। সহিংসতার শিকার মানুষের আর্তনাদ। স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোল। কেউ কী শুনবে তাদের আর্তচিৎকার? তবুও শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সকালটা শুরু হয়েছিল এমন হৃদয়বিদারক পরিবেশের মধ্য দিয়ে। সহিংসতা ও রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে হত্যা-সন্ত্রাসের প্রতিবাদে রাজপথে এভাবেই সোচ্চার ছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। চলমান নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিলেন সবাই। পদযাত্রা, শান্তি সমাবেশ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে প্রত্যেকে সমস্বরে উচ্চারণ করেছেন, ‘আর সহিংসতা নয়। সন্ত্রাসকে ‘না’ বলুন। সহিংসতা রুখে দাঁড়াও। বন্ধ হোক নৈরাজ্য আর অরাজকতা’। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে- ‘চাই শান্তি, চাই নিরাপদ জীবন/ সহিংসতা নয়, শান্তি চাই/ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখুন।’ শনিবার রাজধানী জুড়েই ছিল বিক্ষুব্ধ মানুষের এ রকম নানা আয়োজন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথকভাবে এ ধরনের প্রতিবাদের আয়োজন হয়। পরিবহন খাতকে হরতাল অবরোধের আওতামুক্ত রাখার দাবি ॥ দুই কফিনে লাশ ও দগ্ধ রোগী ছিল প্রতীকী। তবে হরতাল-অবরোধ সমর্থকদের দেয়া আগুনে জ্বলে যাওয়া তিনটি বাস ছিল সত্যিকার অর্থে পোড়া। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আয়োজনে এভাবেই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে শ্রমিক নেতা ছাড়াও শত শত পরিবহন শ্রমিক অংশ নেন। বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতালে গাড়ি জ্বালাও-পোড়াও এবং পরিবহন শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে এই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পল্টন থেকে সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত সড়কের একপাশ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ‘সন্ত্রাস নয় শান্তি চাই’ ॥ ‘সন্ত্রাস-সহিংসতা নয়, চাই শান্তি-নিরাপদ জীবন’ সেøাাগান নিয়ে রাজধানীতে র‌্যালি করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, যাতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরাও। সকালে শাহবাগ থেকে এই পদযাত্রা শুরু হয়। শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হন মানবাধিকার কর্মীরা। ওই সমাবেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, “রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে এখন যা চলছে তা উন্মত্ততা, উন্মাদনা, পাশবিকতা। আমরা চাই শান্তি ফিরে আসুক। হরতাল-অবরোধকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নাশকতার পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে, পেট্রোলবোমা মেরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। অশুভ কিছু দিয়ে শুভ কিছু অর্জন করা যায় না। শুভ কিছু অর্জন করতে হলে শুভ কৌশলেই করতে হবে। বক্তারা বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে প্রতিদিনই যাত্রবাহী বাস, ট্রাকে অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় পুড়ছে মানুষ। চলমান অবরোধে সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। ধারাবাহিকভাবে চলা সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে সমাজের অন্যান্য মহল থেকেও। মানবাধিকারকর্মীদের পদযাত্রাটি বেলা ১১টায় শাহবাগ মোড় থেকে শুরু হয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ, ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনসহ কয়েকটি সংগঠনের শ’খানেক কর্মী পদযাত্রায় যোগ দেন। শান্তি পরিষদের শোভাযাত্রা ॥ লাগাতার অবরোধ-হরতালের নামে সারাদেশে পেট্রোলবোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা, সন্ত্রাস করে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ হত্যা, যানবাহন ধ্বংস ও দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের প্রতিবাদে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে শান্তি মিছিল বের করে জাতীয় প্রেসক্লাবে শেষ করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি ও বিশ্ব শান্তি পরিষদের সহ-সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু। বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও পরিচালক ডাঃ সারওয়ার আলী, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড. ইঞ্জিঃ এমএ কাসেম। এ ছাড়া কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোর্শেদ আলী, নাজমুল হক প্রধান এমপি, আনিসুর রহমান মল্লিক, হাজেরা সুলতানা এমপি, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শাহাদাত হোসেন প্রমুখ। সমাবেশে বক্তরা বলেন, পৃথিবীর দেশে দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে-চলছে কিন্তু পেট্রোলবোমা মেরে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ হত্যার নজির কোথাও নেই। দেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা চলছে। বিবেকবান কোন মানুষ এই অবস্থা মেনে নিতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেবার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘বাংলাদেশ শান্তির দল’ চলমান সংঘাতময় ও সহিংস রাজনীতি অবসানক্রমে জাতীয় ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এক মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধনে প্রধান অতিথি ছিলেন শান্তির দলের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সৈয়দ আবদুলাহ সহিদ এবং সভাপতিত্ব করেন শান্তির দলের কেন্দ্রীয় মহাসচিব এ্যাডভোকেট আফতাব হোসেন মোল্লা। বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে চলমান সহিংস ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা এক বিবৃতিতে সহিংসতার শিকার চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। পাশাপাশি যাত্রীদের আর্থিক সহযোগিতা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সংগঠনের পক্ষ থেকে জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের উদ্যোগে চলমান সহিংসতা ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যা বন্ধ কর, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দাও ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি কাফি রতন। বক্তব্য রাখেন, সাধারণ সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উদীচী নেতা জামশেদ আনোয়ার তপন, মোকলেসুর রহমান সাগর, খান আসাদুজ্জামান মাসুম, যুবনেতা আতিকুল হক খান, হাফিজ আদনান রিয়াদ, ত্রিদিব সাহা, শিমুল খান, শেখ মেহেদী হাসান মানিক প্রমুখ। কাদের সিদ্দিকীর অবস্থান অব্যাহত ॥ লাগাতার অবরোধ প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে সকল দলের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে কাদের সিদ্দিকীর অবস্থান কর্মসূচীর ৪র্থ দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও সাধারণ মানুষ একত্মতা ঘোষণা করেছে। হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান রওশনের ॥ এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচী প্রত্যাহার করতে ২০ দলীয় জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। শনিবার সংসদ ভবন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়। রওশন এরশাদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের সম্পদ। তারা আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। তাদের কথা চিন্তা করে এ ধরনের কর্মসূচী না দিয়ে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের কারণে এমনিতেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন অবস্থায় আছে। পরীক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ সময় আরও সহনশীল হতে হবে।’ রাজপথে শিক্ষকরা ॥ ‘আমাদের এ সময় শ্রেণীকক্ষে থাকার কথা ছিল, কিন্তু আজ কেন রাস্তায় নামতে হলো? আমরা চাই, আমার সন্তানরা যেন সঠিক সময়ে পরীক্ষা দিতে পারে।’ এই ব্যানার হাতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে শনিবার দুপুরে বাংলাদেশ সরকারী মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির (বাসমাশিস) সাধারণ সম্পাদক ইনছান আলী এসব কথা বলেন। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান রেখে তার মতো এমন দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অন্তত দেড় হাজারেরও বেশি শিক্ষক মানববন্ধন করেন। প্রতিবাদে মাঠে নামছে সাংবাদিক সমাজ ॥ ‘সন্ত্রাস ঠেকাও, মানুষ ও দেশ বাঁচাও’ শীর্ষক কর্মসূচীতে অংশ নিতে সংবাদমাধ্যম কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। শনিবার বিএফইউজে একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল ও মহাসচিব আব্দুল জলিল ভূঁইয়া এবং ডিইউজে একাংশের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। আজ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা, নাগরিকদের ওপর পেট্রোলবোমা ও ককটেল নিক্ষেপ, অবরোধ-হরতালের নামে জ্বালাও, পোড়াওয়ের মতো চলমান পরিস্থিতিতে সাংবাদিক সমাজ উদ্বিগ্ন ও হতাশ। দেশবাসীর নিরাপত্তা ও অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহারের দাবিতে সাংবাদিক সমাজ এ মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে সারা দেশে সহিংসতার প্রতিবাদ ও জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দাবিতে মানববন্ধন করেছে ডেভেলপমেন্ট এ্যাক্টিভিস্ট প্লাটফর্ম (ড্যাপ)। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মনববন্ধনে বক্তারা বলেন, প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী, নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক কর্মসূচীর রোষানলে পড়ে দেশের শিক্ষা, যোগাযোগ, আমদানি-রফতানিসহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আজ সঙ্কটে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, প্রবীণ আইজীবী ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, গুলি করে পেট্রোলবোমা বন্ধ হবে না। দেখামাত্র গুলি আরও ভয়াবহ হবে। তাই আলাপ-আলোচনা করে সঠিক পথে এগোতে হবে। প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘লাখো শ্রমিকের বুকফাটা কান্না শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন।
×