ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব, ২৪ পয়েন্টে নাশকতা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫

জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব, ২৪ পয়েন্টে নাশকতা

রাজন ভট্টাচার্য/ওছমান হারুন মাহমুদ ॥ সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত ফেনীর মানুষ শান্তিতে নেই। ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচীকে ঘিরে ফের অশান্ত এই অঞ্চল। হরতাল অবরোধের নামে চলছে জামায়াত-শিবিরের তা-ব। সহিংস আক্রমণের থাবা থেকে বাদ যাচ্ছে না পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, স্কুল পড়ুয়া শিশু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বিচারপতির বাড়িও। শিবিরের গোপন আস্তানায় তৈরি হচ্ছে ককটেল ও পেট্রোল বোমা! জেলার ২৪টি পয়েন্টে চলছে নাশকতা। ২৬ দিনে ভাঙচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় অর্ধশত যানবাহন। বিভিন্ন মহলের তদ্বিরে ছাড়া পাচ্ছে অপরাধীরা। এ পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন আটজন। পেট্রোল বোমার আঘাতে একচোখ হারিয়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম অনিক। গুরুতর আহত অনিকসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ফেনী শহরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেবীপুর, লালপুল, রামপুর রাস্তার মাথা, মহিপাল, হাজারী রোডের মাথা, লাতু মিয়া ব্রিক ফিল্ড পয়েন্টসহ মোট ১০/১২ পয়েন্টে নাশকতা চালাচ্ছে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা। এছাড়াও জেলা শহরের পাঠানবাড়ী রোডের মাথা, পাছগাছিয়া রোড, ফালাহিয়া মাদ্রাসার সামনে, পলিটেকনিক এলাকাসহ ১২ পয়েন্টে অবরোধের সমর্থনে চলছে একের পর এক নাশকতা। সুযোগ বুঝে বিভিন্ন পরিবহনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, যানবাহন ভাংচুরের ঘটনা ঘটাচ্ছে। নাশকতা রোধে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হলেও ফেনীতে হয়নি। নানা কারণে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা অনেকটাই কোণঠাসা অবস্থায় আছেন। সক্রিয় নেই শীর্ষ নেতারাও। সেইসঙ্গে দলীয় বিরোধ তো আছেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৫ জানুয়ারি বিকেলে ফেনী শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগের সভাস্থলের অদূরে খেজুর চত্বর সংলগ্ন পাছগাছিয়ার রোডে বোমা হামলার ঘটনা। এ সময় প্রাইভেট পড়ে রিকশায় করে বাসায় ফেরার পথে ফেনী পাইলট হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী শাহরিয়ার হৃদয় ও মিনহাজুল ইসলাম অনিক বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হয়। অনিককে ঢাকা ও হৃদয়কে চট্টগ্রামে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অনিককে ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও গত নয় জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে শহরের পাছগাছিয়া রোডের জহিরিয়ার মসজিদের অদূরে পিকেটাররা ভ্রাম্যমাণ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাইক্রোবোসে বোমা হামলা চালায়। এতে গাড়িতে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদের, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদ রহমান ও তার স্ত্রী বোমার স্পিøন্টারে আহত হন। গুরুতর আহত হন আবদুল কাদের। অন্য ২ জনের মধ্যে রাশেদ তেমন আহত না হলেও তাঁর স্ত্রী আহত হন। আবদুল কাদেরকে ঢাকায় স্থানান্তরের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের ৩৫ নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করেছে মাইক্রোবাসের চালক রিয়াদ উদ্দিন। ৬ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে মহাসড়কের লালপুলে চট্টগ্রামগামী কাভার্ডভ্যানে আগুন দেয়া ছাড়াও একই সময়ে মহাসড়কের দেবীপুরে ৩টি ট্রাক ভাংচুর করে পিকেটাররা। আট জানুয়ারি ভোর রাতে সদর থানার ধলিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের গ্রামের বাড়িতে আগুন দেয় বিএনপির সমর্থকরা। এ ঘটনায় ৩১ বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের ভাইয়ের ছেলে রোমেল জানান, হাইকোর্টের একটি মামলায় তারেক রহমানের বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদেশ দিয়েছেন বিচারপতি কাজী রেজাউল হক। তাই বিএনপির সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি মহিপালে ২টি কাভার্ড ভ্যানে আগুন ও ১৫টি কাভার্ড ভ্যান ভাংচুর করে পিকেটাররা। ১৩ জানুয়ারি পাছগাছিয়া রোডে মোটরসাইকেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে পিকেটাররা। ১৫ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে মহাসড়কের হাজারী রোডের মাথায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী একটি কাভার্ড ভ্যানে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে অবরোধ সমর্থকরা। এতে ট্রাক চালক মিরাজুল অগ্নিদগ্ধ হয়। ১৮ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে ফেনী-পরশুরাম সড়কের কালির হাটে পিকেটাররা ১টি বাসে আগুন ও ৬/৭টি সিএনজি আটোরিকশা ভাংচুর করে। ১৯ জানুয়ারি মহাসড়কের লাতুমিয়া ব্রিক ফিল্ডের কাছে যাত্রীবাহী বাসে আগুন, দেবীপুরে ট্রাকে আগুন, পাঠানবাড়ী রাস্তার মাথায় ইজিবাইকে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। ২০ জানুয়ারি দাগনভুঞা থানার দুধমুখাতে রাত ৯টার দিকে চলমান একটি সিএনজি অটোরিকশার ওপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। এতে যাত্রী শাহরিয়ার শিপন, সাদ্দাম হোসেন ও চালক শাহজাহান পিন্টু অগ্নিদগ্ধ হয়। ২৫ জানুয়ারি শহরের আড্ডাবাড়ী সড়ক থেকে যুবদল কর্মী অজিমকে ৬টি পেট্রাল বোমা ও ১টি ককটেলসহ আটক করে পুলিশ। ২৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় ফেনীর অদূরে কালিপাল নামক স্থানে সিএনজি আটো রিকশাতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে পিকেটারার। এতে অটোরিকশা যাত্রী দিনমজুর নওশাদ অগ্নিদগ্ধ হয়। আহত নওশাদকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ফেনী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল হক জানান, গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি জামায়াতের ডাকা অবরোধ হরতালের নামে পিকেটাররা ৪টি ট্রাক ২টি কাভার্ড ভ্যান, ১টি সিএনজি অটোরিকশায়, ২টি ইজিবাইকে আগুন দিয়েছে। এছাড়াও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, ১টি মাইক্রোবাস ভাংচুর করেছে। তবে অন্য কোন যানবাহন ভাংচুরের সঠিক হিসেব প্রশাসনের কাছে নেই। পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২৫ দিনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও আগুন দেয়ার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৮ জন আহত হয়েছেন। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন পয়েন্টে কমপক্ষে ৩০/৩৫টি যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে পিকেটাররা। নাশকতার অভিযোগে পুলিশ এ পর্যন্ত কতজনকে আটক করেছে এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলা পুলিশের কর্মকর্তা সাইফুল হক জানান, নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ফেনী জেলা পুলিশ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশ যে কোন মূল্যে জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। তিনি জানান, ককটেল ও পেট্রোল বোমা স্থানীয়ভাবে গোপনে তৈরি হচ্ছে। এদের ধরার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে পেট্রোল বোমাসহ একজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন যতজনকে আটক দেখানো হয়, তাদের সবাইকে আদালতে পাঠানো হচ্ছে না। আটক করা অধিকাংশ ব্যক্তিকে থানা থেকে বিশেষ কায়দায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে আটক করা এবং গ্রেফতার দেখানোর সঠিক তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে। তবে দলীয় সূত্র দাবি করছে, পাঁচ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের ৪৫৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটক করা দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন নাশকতার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত সকলকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ফেনী শহরসহ মহাসড়কের ফেনী অংশের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা পাহারা দিচ্ছে। ফলে শহরসহ মহাসড়কে গত বছরের জানুয়ারি মাসে কাদের মোল্লার ফাঁসির সময়ের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবতারণা ফেনীতে হয়নি বলে জানান জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এর পরও বিক্ষিপ্তভাবে ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে আগুন, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৩ জানুয়ারি বিকালে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ সুপার মোঃ রেজাউল হক বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যেও এক পর্যায়ে নাশকতার আগে সাংবাদিকদের জানিয়ে নাশকতা চালানো, নাশকতাকারীদের ছেড়ে দেয়ার জন্য সাংবাদিকরা তদ্বির অনুরোধ করেন বলে ইঙ্গিত করেন। সাম্প্রতিক গভীর রাতে নাশকতার সময় পুলিশ দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে আসার আগে এক সাংবাদিককে ছবি তুলতে দেখেছে। তাকে আটকের পর ছেড়ে দেয়া হয় বলে উল্লেখ করেন। এ বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে একজন সিনিয়র সাংবাদিক দাঁড়িয়ে জানান, কোন সাংবাদিক নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ঢালাওভাবে নাশকতার সঙ্গে সাংবাদিক জড়িত এমন বক্তব্য না দেয়ার জন্য পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করেন। পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের এড়িয়ে চলা, নাশকতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের এ পথ থেকে সরে আসার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি নাশকতাকারীদের ছেড়ে দেয়ার তদ্বির না করার জন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন। সবশেষে তিনি সাংবাদিকদের পরিবেশিত সংবাদ যেন সহিংসতাকে সমর্থন না করে সেদিকে খেয়াল রেখে সংবাদ পরিবেশন করার অনুরোধ জানান।
×