ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষত সারলেও ‘পুড়তে’ হবে আজীবন ওদের

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫

ক্ষত সারলেও ‘পুড়তে’ হবে আজীবন ওদের

শর্মী চক্রবর্তী ॥ আগুনে পোড়া শরীরের যন্ত্রণা কিছুটা ভুলতে পারলেও এই আঘাত তাদের তাড়িয়ে বেড়াবে আজীবন। জীবনযুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়াবে পেট্রোলবোমায় পুড়ে যাওয়া শরীরের ক্ষত অংশগুলো। হরতাল-অবরোধে পেট্রোল-বোমায় দগ্ধদের আজীবন পুড়তে হবে এই আগুনে। আহতের মধ্যে যারা এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন অনেকেই ফিরতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। ক্ষত স্থানের আঘাত নিয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে অনেকে কর্মহীন জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার যে শঙ্কা ছিল তা রূপ নিচ্ছে বাস্তবে। আহতদের মধ্যে যারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাদের অনেকেই বাড়ি ফিরে গেছেন। কিন্তু ওই দুর্বিষহ ঘটনা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একদিকে শরীরের যন্ত্রণা আর অন্যদিকে আতঙ্ক। এই দুই মিলে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরতে পারছেন না কেউ। বিশেষ করে যাদের শরীরে এক বা একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি খুব বেশি। এ ধরনের রোগী শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও দীর্ঘ সময় মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তাই তারা স্বাভাবিক ভাবে কোন কাজ করতে পারছেন না। এ রোগ সেরে ওঠার কোন সময়সীমাও নেই। যখন তারা এই ঘটনার ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন তার ওপর নির্ভর করছে জীবনে স্বাভাবিকভাবে চলা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠায় ৫ জনকে ছাড়পত্র দিয়েছে বার্ন ইউনিট কর্তৃপক্ষ। তারা হলেনÑ অমূল্য দেববর্মণ, সাইজউদ্দিন সাজু, শহিদুল ইসলাম, ইশতিয়াক মোহাম্মাদ বাবু, শহিদুল ইসলাম। রিক্সাচালক অমূল্য ২৮ জানুয়ারি দুপুরেই বার্ন ইউনিট ছেড়েছেন। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কাদেরপুর গ্রামের বাসিন্দা অমূল্য ঢাকার রাজপথে রিক্সা চালাতেন। গত ১০ জানুয়ারি ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওস্থ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। তার শরীরের ৮ শতাংশ পুড়ে যায়। অমূল্য দেবের ভাগ্নি-জামাই রবীন্দ্রনাথ রায় জানান, ঢাকায় আমাদের থাকার কোন জায়গা নেই। তাই অবরোধের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পঞ্চগড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। আবার ১৪ দিন পর বার্ন ইউনিটে গিয়ে ডাক্তারকে দেখাতে হবে। অমূল্য দেবের শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শরীরে পোড়া যন্ত্রণা কমলেও ক্ষত স্থান এখনও সেরে ওঠেনি। এছাড়া কোন কাজ-কর্ম এখনও তিনি করতে পারবেন না। এই অবস্থায় তিনি বসে থাকলে তার সংসারের সবাইকে তো না খেয়ে মরতে হবে। আর কখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবেন তাও বলা যায় না। এই আগুন তাকে সারাজীবনের মতো অচল করে দিল। এছাড়া তার মনের ভেতর এখন একটা আতঙ্ক ঢুকে গেছে। বাসা থেকে বের হলেই যদি আর কোন সমস্যা হয়। এখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি কিভাবে বেঁচে থাকবেন তাই হচ্ছে চিন্তার বিষয়। ২০ জানুয়ারি ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি বরিশালের কলাপাড়া যাওয়ার পথে বরিশালে পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হন স্বামী-স্ত্রী। তারা হলেন মাহবুব আলম (৪০) ও রেশমা বেগম (৩০)। মাহবুব আলম পেশায় প্রাইভেট কারচালক। ছুটি না থাকার কারণে অনেকদিন গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেন না। ছেলেমেয়েদের বায়নাতে এই অবরোধের মধ্যে তারা বরিশালের উদ্দেশে বের হলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পেট্রোলবোমায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই হাত ঝলসে যায়। কিছুটা সুস্থ হয়ে যাওয়ায় বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা দু’জনকে ছাড়পত্র দিয়ে দেন। তিনদিন পর পর এসে তারা দু’জনে ডাক্তার দেখান। বাসায় চলে গেলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি তারা কেউই। এছাড়া কোন কাজকর্মও করতে পারছেন না দু‘জনে। মাহবুব আলম জানান, এতদিন হয়ে গেল এখনও আমি গাড়ি চালাতে পারিনি। মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে কখন কি হয়। এছাড়া হাতের অবস্থাও এখনও তেমন ভাল না, তাই কোন কাজ করতে পারি না। আমি ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই উপার্জন করার মতো। এভাবে থাকলে আমার ছেলেমেয়েকে কে খাওয়াবে, তাদের পড়ালেখার খরচ কোথা থেকে আসবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। তিনি আরও জানান, স্ত্রী রেশমা বেগমও বলতে গেলে অচল, ঝলসানো হাত নিয়ে তিনি কিছুই করতে পারেন না। এমনকি ছেলেমেয়েদের কোন কাজ করতে পারেন না। এজন্য প্রায় সময় কান্নাকাটি করে। তিনি বলেন, আমরা এখন কিভাবে চলব? কে আমাদের দেখবে? আমাদের তো আর কেউ নেই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গত শুক্রবার রাতে বাসে ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ ২৮ জনের একজন শহিদুল। তার শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে যায়। তবে ইতোমধ্যে অনেকটাই সেরে উঠেছেন তিনি। চিকিৎসকের ছাড়পত্রও পেয়েছেন হাসপাতাল ত্যাগের। কিন্তু ফিরলেও কোন কাজ করতে পারছেন না তিনি। এ নিয়ে উদ্বেগে আছেন তিনি। রবিন ট্রেড গ্রুপের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শহিদুল দুই ছেলে ও স্ত্রী সাবিহা মাহমুদকে নিয়ে দোহারের নারিশায় থাকেন। ঘটনার দিন অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। শহিদুল ইসলামের স্ত্রী সাবিহা মাহমুদ বলেন, তিনি (শহিদুল) সুস্থ হয়ে ওঠায় ভাল লাগছে। তবে উনার শরীরের যে অবস্থা এই নিয়ে তেমন কোন কাজ করতে পারবেন না। আরও অনেক দিন বিশ্রামে থাকতে হবে। তিনি এভাবে থাকলে আমাদের সংসার কিভাবে চলবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের ওপর এত দুর্যোগ এলে তা মোকাবেলা করা কঠিন। আমরা তো রাজনীতি করি না। আমরা চাই ২ বেলা দুমুঠো খেয়ে পরে সাধারণভাবে বেঁচে থাকতে, তাহলে কেন আমাদের সঙ্গে এমন করেন রাজনীতিকরা? তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, এভাবে আগুন দিয়ে সাধারণ মানুষ না মেরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করুন। তাহলে আমরা বেঁচে যাব। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দগ্ধদের মধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তাদের অনেক সময় লাগবে। অনেকে স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে নাও ফিরতে পারেন। এজন্য সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করা বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণে দগ্ধদের মানসিক চিকিৎসা দেয়ার উদ্যোগের কথাও জানিয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ও পাস্টিক সার্জারি ইউনিট কর্তৃপক্ষ। ঢামেক বার্ন ইউনিটের অবৈতনিক উপদেষ্টা ডাঃ সামন্ত লাল সেন বলেন, পেট্রোলবোমায় দগ্ধরা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন বলে তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, এদের মধ্যে অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। যিনি ট্রাক চালানোর সময় দগ্ধ হয়েছেন, সুস্থ হয়ে ফের স্টিয়ারিং ধরলে সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা তার মনে পড়ে যাবে। এছাড়া ক্ষত স্থান শুকিয়ে গেলেও অনেকের চলাফেরা করতে অনেক সমস্যা হবে। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান, শিশুদের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশের ওপর দগ্ধ হলেই চিকিৎসা শেষে তাদের স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তবে যাদের অস্ত্রোপচার করতে হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকির মাত্রা কম। বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মাদ হেদায়েত আলী খান জানান, পেট্রোলবোমায় দগ্ধদের শারীরিক সুস্থতার পর তাদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে তাদের রেফার করা হবে।
×