ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফফার চৌধুরী

বেগম জিয়া নিজেই সম্মানজনক বেরুবার রাস্তাটি বন্ধ করেছেন

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

বেগম জিয়া নিজেই সম্মানজনক বেরুবার রাস্তাটি বন্ধ করেছেন

ঢাকায় বিএনপির এক প্রবীণ নেতার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হচ্ছিল। তিনি বললেন, আপনার লেখা আমি পড়ি। আপনি ঠিকই ধরেছেন, বিএনপির এবারের হরতাল-অবরোধ ছিল দলটির মরণ ছোবল। আমরা নেত্রীর দু’একজন শুভাকাক্সক্ষী তাকে সাহস করে আবার সন্ত্রাসের পথে পা দিতে নিষেধ করেছিলাম। তিনি আমাদের কথা শোনেননি। লন্ডন থেকে তার পুত্র তারেক রহমান হরতাল-অবরোধের নামে আবার জামায়াত-শিবিরের সহযোগিতায় দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টির যে ব্লু-প্রিন্ট পাঠিয়েছিলেন, সেটাই তিনি অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছেন। ফলে দলটির আজ এই অবস্থা। এগুলো নিরীহ মানুষকে আবার জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নৃশংসতা। এই হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনার নায়ক তারেক রহমান। তাকেদেশ ফিরিয়ে এনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের তুল্য অপরাধের জন্য বিচার ও শাস্তি দেয়া উচিত। আমি তাকে জিজ্ঞাস করেছি, আপনারা দু’একজন নেতাওকি নেত্রীর সামনে সাহস করে তাকে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত পাল্টানোর অনুরোধ জানাতে পারেননি? তারেকের উন্মাদ জিঘাংসার নীতিযে দলটাকে ধ্বংস করবে, দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও সর্বনাশ ঘটাবে এই সত্যটা কি দলের নেত্রীকে সবিনয়ে হলেও বোঝাতে পারেননি? প্রবীণ নেতা অকপটে বললেন, ‘বোঝাতে পারিনি বলেই তো দলের কার্যক্রম থেকে দূরে সরে নিষ্ক্রিয় হয়ে আমরা অনেকেই বসে আছি। বলেছি, দেশের এবং দলের স্বার্থে আপনাদের নিষ্ক্রিয় না থেকে সক্রিয় প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিল। তিনি বললেন, তাহলে আমাদের বিপদ ছিল। আমরা গুপ্ত হত্যারও শিকার হতে পারতাম। তারেকের জীঘাংসা কতো নির্মম তা আপনারা জানেন না। শেখ হাসিনার সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে তার কিছু ভূমিকা ছিল তাতো আপনারা জানেন। লন্ডনে বসে এখনও সে ষড়যন্ত্রের নাটাইয়ের সূতো ছেড়ে দিচ্ছে।তার মনে বিবেক ও মনুষত্ববোধ বলে কিছু নেই। বলেই তিনি তারকথায় বিরতি টানলেন। শুধু বিএনপির এই প্রবীণ নেতা নন, অধিকাংশ প্রবীণ ও পুরনো নেতা তারেক রহমান সম্পর্কে তাদের মনে একই ধরণের ঘৃণা পোষণ করেন এবং তা আমি জানি। কেবল মুখে তা প্রকাশ করারসাহস তারা পান না। বেগম খালেদা জিয়ার এই অর্ধশিক্ষিত (?) এবং অমার্জিত পুত্র যে তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গেও কি ধরণের অমার্জনীয় বেয়াদপি করতে পারেন, তার উদাহরণ তার ইঙ্গিতে দালের মনোনীত রাষ্ট্রপতি এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ডা. বদরুদ্দৌজা চৌধুরীকে যখন এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বের করে দেয়া হয় পরে মহাখালীতে তারেক বাহিনীর সশস্ত্র হামলাঃয সাবেক রাষ্ট্রপতিকে রেলপথ ধরে ছুটে জানাতে দেখা যায়। লজ্জা থাকলে এই সাবেক রাষ্ট্রপতি এখন বেগম জিয়ার ঘরে সরকারই তালা লাগিয়েছে বলে বিএনপি নেত্রীর পক্ষে সাফাই গাইতে মুখ খুলতে পারতেন না। বিএনপির যে প্রবীণ নেতার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করছিলাম, তার কথায় ফিরে যাই। তারেক রহমান সম্পর্কে তার এবং তার মতো আরও কয়েকজন প্রবীণ নেতার মনে যে ভীতি ও ঘৃণার ভাব আছে সে কথা বলে একটু বিরতি নিয়েই বললেন, তবু আমরা দলের দু’তিনজন পুরনো নেতা বেগম জিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনো যোগ না দিয়ে নির্বাচনের আগে এই তারেকের পরামর্শে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে আমরা যে বিরাট পরাজয় ও ব্যর্থতা ভোগ করছি, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার সন্ত্রাসের পথে পা না বাড়ানোই আমাদের উচিত। প্রবীণ নেতা বললেন, আমাদের পরামর্শ ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের যতোই অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাক, মানুষের মধ্যে যে কোন কারণে হোক বিএনপির পক্ষে একটা সাইকো (মানসিকতা) তৈরি হয়ে আছে। এই কারণে গত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থক ভালো প্রার্থীরাও বিএনপি সমর্থক প্রার্থীর কাছে হেরেছে। জনমনের এই সাইকিটি আমাদের ধরে রাখতে হবে। নতুন করে সন্ত্রাসে না গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা, দুর্নীতি, অ”প্রশাসন সম্পর্কে প্রচার ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য দলকে প্রস্তুত করা দরকার। আমাদের ধারণা, পরবর্তী নির্বাচন যখনই হোক বিএনপি ক্ষমতায় যেতোই। আমি তার সঙ্গে এই ব্যাপারে সহমত পোষন করি জকানালাম। তিনি বললেন, ম্যাডাম আমাদের কথা শুনলেন না। তার কাছে তারেক রহমানের কথ্ইা বেদবাক্য, তারেক লন্ডনে বসে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মদদ, ও পরামর্শ নিচ্ছে। ভারতের মাফিয়া গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে জামায়াতসহ মৌলবাদী জঙ্গী গ্রুপগুলোর সঙ্গে জোট পাকিয়ে দেশটা ধ্বংস করায় চক্রান্ত চালাচ্ছে। এসব জেনেও ম্যাডাম পুত্রস্নেহে অন্ধ। তার নির্দেশে দেশে গত ৬ জানুয়ারি থেকে আবার সন্ত্রাস, মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযান। তারপর নেত্রী এবং দলের কপালে আবার ব্যর্থতা ও পরাজয়ের কালিমার প্রলেপ। আমি তাকে বলেছি, বারতে ইন্দিরা গান্ধী যখন পুত্র সঞ্চয়কে নিয়ে এককভাবে দল চালাতে চেয়েছিলেন, তখন কংগ্রেসের পুরনো ও প্রবীণ নেতারা বিদ্রোহী হয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে ছেড়ে আদি কংগ্রেস নামে আলাদা কংগ্রেস গঠন করেছিলেন। আপনারা বাংলাদেশে বিএনপির পুরনো নেতারা একাট্টা হয়ে কেন গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী দল গঠন করতে পারছেন না? প্রবীণ নেতা বললেন, “এই পরিকল্পনা যে আমাদের অনেকের নেই তা নয়। কিন্তু অতীতে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত বিকল্পধারা, কর্নেল অলির নেতৃত্বে গঠিত লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের পরিণতি দেখে আমরা আর নড়াচাড়া করতে সাহসী হইনি।” আমি বলেছি, আপনারা তো নতুন দল গঠন করবেন না। বিএনপি কে পুনর্গঠন করবেন। তারেকের কবল থেকে দলটাকে বাঁচাবেন। নইলে এই বিএনপি যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যায়, তাহলে বেগম জিয়া তার পুত্র তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসাতে চাইবেন। তা যদি হয় দেশে শুরু হবে দস্যু বাচ্চা-ই মাক্কোর রাজত্ব। আপনি নিজেই বলছেন, তারেক অর্ধশিক্ষিত এবং অমার্জিত স্বভাবের। তার মতো ব্যক্তিকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোর জন্য আপনারাÑ দেশের একদল প্রবীণ নেতা কি করে এই অপরাজনীতিতে এখনও জড়িত আছেন? প্রবীণ নেতা বললেন, “মনে হয় এটা আমাদের ভিরুতারই ফল। নইলে দেশে সুস্থ রাজনীতি ফিরে আসবেনা কেন? নইলে তারেক রহমানের মতো দুর্জন কি করে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার স্পর্ধা প্রকাশ করতেপ ারে? দেশে কি যোগ্য মানুষের দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে?” মনের এই ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রবীণ নেতা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, “তবে একটা কথা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। নইলে যে তারেকের নিষ্ঠুরতা ও ষড়যন্ত্রের জাল আমরা ছিড়তে পারিনি, তা এখন নিজ থেকেই ছিড়তে শুরু করেছে। বেগম জিয়ার হরতাল-অবরোধের ডাক এবারও ব্যর্থ। আবার পুড়িয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করে দলের দুর্নাম বাড়ানো ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারেননি। এখন তিনি এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য একটা সম্মানজনক “এগজিট” খুঁজছেন। বলেছি, তিনি ‘এগজিট’ খুঁজছেন না। তার দলকে ‘ডেথ উইশে’ পেয়েছে। নইলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সম্মানজনকভাবে বের হয়ে আসার একটা পথ তার সামনে নিজ থেকেই উন্মুক্ত হয়েছিল। কোকোর আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীকে সমবেদনা ও সান্তনা জানাতে তার কাছে যান। এই সময়টা দুই নেত্রীর জন্যই ছিল চরম দুর্বলতার মুহূর্ত। যে রাজনৈতিক সংলাপে বসার দাবিতে বেগম জিয়া আন্দোলনের নামে এতো হুড়হাঙ্গামা করছেন, সেই সংলাপের সুত্রপাত হতে পারতো এই সান্ত¡না বিনিময়ের দেখা সাক্ষাতেই। বেগম জিয়া কার পরামর্শে এই সুযোগটি হেলায় হারালেন, তা আমি জানিনা। তবে লোকে বলে তারেকের পরামর্শে এই রাজনৈতিক ব্লান্ডারটি তিনি করেছেন। হরতাল নেই, অবরোধ নেই। বরং ঢাকা শহরে যানজট আরও বেড়েছে। তবে ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত অগ্নিকা- এবং এখানে সেখানে লোক পুড়িয়ে মারা এখনো চলছে। এই কারুষোচিত সন্ত্রাস দ্বারা সরকারের পতন ঘটানো যাবে না; দাবি আদায় করাও যাবেনা। সরকার সন্ত্রাস দমনে যৌথ বাহিনীর কঠোর অভিযান শুরু করেছেন। জনসাধারণও সন্ত্রাসীদের যেখানেই পাচ্ছে বেধড়ক পেটাচ্ছে। সুতরাং বেগম জিয়া যদি তার এই হরতাল ও অবেরাধ প্রত্যাহারের কথা নাও বলেন, তাহলেও তার এই “আন্দোলন” বক কাটা ঘুড়ির মতো অচিরেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বেগম জিয়ার জন্য একটি সম্মানজনক এগজিট রুট আর কোথায় রয়েছে? আসলে তা কোথাও নেই। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করে নিজেই এই সম্মানজনক বহির্গমনের পথটি রুদ্ধ করেছেন। এখন এই খিল দেওয়া দরোজাটি খুলতে পারেন দলের প্রবীন এবং বর্তমানের নিষ্ক্রিয় নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বেগম জিয়ার অসৌজন্য প্রদর্শনের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক থেকে শুরু করে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা এবং দলটির সমর্থক বুদ্ধিজীবিও। তারা এবার শুধু সরব হওয়া নয়, সক্রিয় হোন। সাহসীহয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন। তারা বেগম খালেদাকে তার বিপথগামী অদূরদর্শী পুত্র তারেক রহমানের কবল থেকে মুক্ত করুন। জামায়াতের সংশ্রব থেকে সরিয়ে আনুন। বিএনপির নীতি ও নেতৃত্বকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে সিরিয়ে এনে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। দেশে শক্তিশালী নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতা গড়ে তুলুন। নইরে দলটির জন্য তো অমঙ্গলই, দেশের জন্যও অমঙ্গল। বিএনপির মরণ ছোবল ব্যর্থ হয়েছে। তাকে ডেথ উইশে পেয়েছে। আমি তার মৃত্যু কামনা করি না; গণতান্ত্রিক পুনর্জীবন কামনা করি। লন্ডন, ২৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৫
×