ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০৩:০৫, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫

ইবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

(গতকালের পর) এদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন মনরোভিয়া ‘চিরন্তন ভালবাসা বিজয়ী আফ্রিকা হাসপাতাল’-এর পরিচালক ও সাধারণ সার্জন ড. জেরি ব্রাউন (কৃষ্ণাঙ্গ), একই শহরের বস্তি এলাকায় অবস্থিত ‘আমার চেয়ে মূল্যবান’ শীর্ষক স্কুলের পরিচালক কেটি মেলার (শ্বেতাঙ্গ) একই এলাকায় পরিচালিত ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক সংস্থা’ বা ‘মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ারস’ এর স্বাস্থ্য সম্প্রসারণ কর্মী এলা ওয়াটসন-স্ট্রাইকার (শ্বেতাঙ্গ), মনরোভিয়াতে অবস্থিত ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক সংস্থা’র ইবোলা হাসপাতালের সেবিকা-সহকারী সালম কারওয়া (কৃষ্ণাঙ্গ), একই শহরে কর্মরত এ্যাম্বুলেন্স তত্ত্বাবধায়ক ফোডে গালা (কৃষ্ণাঙ্গ), ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক সংস্থা’র প্রেসিডেন্ট ড. জোয়ান লিউ (শ্বেতাঙ্গ), যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) পরিচালক ড. টম ফ্রিডেন (শ্বেতাঙ্গ) এবং আরও ১১ শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ চিকিৎসক, গবেষক ও স্বাস্থ্যকর্মী। এঁরা নিজেদের নিরাপত্তা কিংবা প্রথাগত কর্মপরিধির বাইরে গিয়ে ইবোলাকে পশ্চিম আফ্রিকায়, বিশেষত, লাইবেরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় প্রযুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত টাইম পত্রিকার সযতœ বিবেচনায় ২০১৪ সালে এঁরাই হলেন সেই বর্ষের সেরা মানুষ। ড. জেরি ব্রাউন তাঁর স্ত্রীকে না জানিয়ে হাসপাতালের ইবোলা ইউনিটে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী এ জানার পরও তিনি সেবা থেকে সরে আসেননি। তাঁর স্ত্রী তাঁকে তাঁর সেবার এই অদম্য মনোভাব থেকে সরিয়ে আনার কোন চেষ্টা করেননি। বলেছিলেন শুধু, তুমি সাবধানে কাজ কর। ড. ব্রাউন তাঁর দুই মার্কিন সহকারী ড. ডেবি আইসেন হার্ট ও ড. জন ফাঙ্কহাউসারকে নিয়ে তাঁর হাসপাতালে স্থান না থাকায় স্থানীয় এক গির্জাকে ইবোলা রোগীদের হাসপাতাল হিসেবে প্রযুক্ত করেন। শ্বেতাঙ্গ কেটি মেলার ইবোলা থেকে নিরাময় পাওয়া ইসতার নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরীর পাশে ইবোলায় হারিয়ে যাওয়া তার সকল পরিজনের অনুপস্থিতিতে মাতৃ¯েœহ নিয়ে দাঁড়ান। ভিনদেশী শ্বেতাঙ্গ এলা ওয়াটসন-স্ট্রাইকার ইবোলাতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এক গ্রামের ধ্বংসাবশেষের পটে দাঁড়িয়ে প্রায় সকল স্বজন ও প্রতিবেশী হারানো জ্ঞানহারা এক কালো মেয়ের মাঝে পৃথিবীতে বাঁচার ও সেই লক্ষ্যে কাজ করার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলেন, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন স্থানীয় জনগণের ইবোলা আক্রান্ত রোগীর সেবার বিরোধিতা সত্ত্বেও মানুষের সেবা থেকে নিজকে দূরে সরিয়ে নেননি। এক সেবিকা সহকারী সালম কারওয়া (কৃষ্ণাঙ্গ) ইবোলা থেকে নিরাময় হয়ে নিজের শিশু মেয়ের জন্য তার মাতৃ¯েœহ ইবোলায় আক্রান্ত অন্য সকল শিশুর জন্য ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফোডে গালা (কৃষ্ণাঙ্গ) ছিলেন মনরোভিয়া শহরের এ্যাম্বুলেন্স বহরের তত্ত্বাবধায়ক এবং ইবোলা থেকে নিরাময় পাওয়া ব্যক্তি যে নিরাময় তাঁকে ইবোলার পুনর্বার সংক্রমণ থেকে মুক্তি দিয়েছিল এবং এই মুক্তিকে তিনি সৃষ্টিকর্তার করুণার দান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি মনরোভিয়ার আনাচে-কানাচে ঘুরে ইবোলা রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসার দায়িত্ব হাসিমুখে অক্লান্তভাবে সর্বাত্মক দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে পালন করেন। ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক সংস্থা’র আন্তর্জাতিক প্রেসিডেন্ট ড. জোয়ান লিউ এ বছরকার ইবোলা নিয়ন্ত্রণে তাঁর সংস্থাকে পশ্চিম আফ্রিকার চারটি দেশে যেভাবে প্রযুক্ত করেছিলেন তা মননশীলতা, প্রশাসনিক যোগ্যতা ও লোকবল ব্যবস্থাপনার সমসাময়িক সকল উদাহরণের ভেতর প্রজ্বলতম হয়ে ফুটে উঠেছে। রোগাক্রান্ত হওয়ার তীব্র ভয়ভীতির মধ্যে রোগাক্রান্তকে সেবা করা, তার বিষ্ঠা পরিষ্কার করা এবং নিশ্চুপ এবং বিপজ্জনক দেহাবশেষকে সম্মানজনক এবং নিরাপদভাবে দাফন করার মধ্য দিয়ে ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক সংস্থা’ কর্তৃক সেবার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করার পেছনে সর্বাত্মক মেধা ও শক্তি দিয়ে কাজ করেছেন ডঃ জোয়ান লিউ ও তাঁর সহকর্মীরা। ড. টম ফ্রিডেন (শ্বেতাঙ্গ) পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাথমিক অনীহামূলক আচরণ সত্ত্বেও সিডিসি থেকে এক বিশেষ দল সর্বাত্মক তৎপরতার সঙ্গে আক্রান্ত এলাকায় পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমেরিকা তথা পৃথিবীর অন্যান্য এলাকায় ইবোলার সংক্রমণ তিরোহিত করতে হলে পশ্চিম আফ্রিকায় এর সংক্রমণ পূর্ণাঙ্গভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টাইম পত্রিকার প্রতিবেদনে এসব মহৎ নারী-পুরুষের ত্যাগ সকল ভীতির উর্ধে সমাজের সৎ ও সেরা মানুষের রোগাক্রান্তের সেবার প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে; হিংসা, দ্বেষ, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের বিষবাষ্প ছাড়িয়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা ও মমত্ববোধকে পৃথিবীতে সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ চিরন্তন মূল্যবোধে উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশিত করেছে। পশ্চিম আফ্রিকায় ২০১৪-১৫ সালে ইবোলা সংক্রমণ ও তার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের এসব তথ্য ও তাৎপর্য সময়ান্তরিক দুঃখ, বেদনা ও হতাশার মাঝে মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে কতিপয় ক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে : এক, রোগের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকায় যাঁরা আছেন তাঁরা মানুষের অদম্য সঙ্কল্প ও সাহস মানুষের প্রতি সর্বাত্মক সহানুভূতি ও অসীম মমত্ববোধ নিয়ে প্রকাশ করেছেন। এ ধরনের সঙ্কল্প, সাহস, সহানুভূতি ও মমত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সকল দেশের তরফ থেকে ইবোলা মহামারীকে জয় করার উদ্দেশ্যে গবেষণা, পরিশ্রম ও উদ্ভাবন প্রযুক্ত করার আহ্বান প্রকারান্তরে তাঁরা আমাদের সকলকে জানিয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান, রোগ প্রতিরোধ ও রোগীর সেবায় বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষা, অধ্যবসায়, মমত্ববোধ ও মানবপ্রেমের উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। মহামারী হিসেবে পৃথিবী থেকে কলেরা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, পোলিও, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ কালাজ্বর, ডেঙ্গু প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে কিংবা তাদের নির্মূল করার জন্য প্রতিষেধক ও স্বাস্থ্যসেবার প্রক্রিয়া, প্রশাসন উদ্ভাবিত ও প্রযুক্ত হয়েছে। সার্স (ঝঅজঝÑ সিভিয়ার এ্যাকুয়েট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) এবং মার্স (মিডেল- ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এইচআইভিÑ এইডস ইতোমধ্যে নিরাময় না হলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসে গেছে। আমরা আশা করি অচিরেই ইবোলা সংশ্লিষ্ট সকল দেশ-দরিদ্র ও বিত্তশালীর গবেষণা, প্রযুক্তি ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসে যাবে। দুই, এই লক্ষ্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের প্রচেষ্টার সমাবেশ ঘটাতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অধিকতর অর্থ ও লোকবল দিয়ে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে। এ বছরে ইবোলা সংক্রমণ রোধকল্পে বিশ্ব স¦াস্থ্য সংস্থা মূলত অর্থাভাবে দ্রুত যথা ইপ্সিত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। এর সঙ্গে অক্ষমতার উপকরণ হিসেবে যোগ হয়েছে সংশ্লিষ্ট আফ্রিকান দেশের সরকারসমূহের দুর্বলতা, দায়িত্বহীনতা ও অসংবেদনশীলতা। এসব অপূর্ণাঙ্গতা ও দুর্বলতা দূর করার জন্য সকল সংস্থা ও দেশকে দৃঢ় এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিন, ‘সীমান্তবিহীন চিকিৎসক সংস্থা’র সেবাধর্মী কর্ম ২০১৪-১৫ সালে এ প্রমাণ করেছে যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও এলাকা নির্বিশেষে মানবতার সেবায় এগিয়ে গেলে সেবা ক্ষেত্রে যেমন সফলতা অর্জন করা যায় তেমনি সরকার বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার আমলাতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ঈপ্সিত মানবিক লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। চিকিৎসকদের এই সংস্থা কর্তৃক এই ক্ষেত্রে ও এই সময়ে সৃষ্ট উদাহরণ পর্যালোচনা করে চিকিৎসা ও গবেষণার কর্মে কর্মরত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ যাতে অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে তার পথ ও পদ্ধতি শনাক্ত করে আমাদের সকলকে রোগ ও ব্যাধিমুক্ত এবং পুষ্টি সমুজ্জ্বল পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যেতে হবে, সরকারী প্রচেষ্টার সঙ্গে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজের অধিকতর ফলপ্রসূ সমন্বয় অর্জন করতে হবে। (সমাপ্ত)
×