ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফোরকান মল্লিকের নির্দেশে রাজাকাররা ডাক্তার দেবেন্দ্রকে হত্যা করে;###;সাক্ষী চান মিয়ার জবানবন্দী

যুদ্ধাপরাধী বিচার

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

যুদ্ধাপরাধী বিচার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী মোঃ চাঁন মিয়া জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে আংশিক জেরা করেছেন। ১ ফেব্রুয়ারি অসমাপ্ত জেরার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, ফোরকান মল্লিকের নির্দেশে রাজাকাররা ডাক্তার দেবেন্দ্র নাথকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া রাজাকাররা ঐ এলাকায় রমনী কু-ু, শ্যাম সুন্দর কু-ু ও সুনীল কু-ু এই তিন ভাইকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে। রাজাকারদের ধর্ষণের কারণে গোলাপী রানীও মারা যায়। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মাহিদুর রহমান ও মোঃ আফসার হোসেন চুটুর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দীর জন্য ২৭ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। এদিকে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও বর্তমানে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদে সাখাওয়াত হোসেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছেন; যা মামলার জন্য খুবই সহায়ক হবে। উল্লেখ্য, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সেফহোমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ অনুমতি প্রদান করে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী মোঃ চাঁন মিয়া জবানবন্দীতে বলেছেন, আমার নাম মোঃ চাঁন মিয়া, পিতা মৃত হাছন বানু। গ্রাম ছৈলাবুনিয়া, থানা মির্জাপুর, জেলা পটুয়াখালী। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ২৬ বছর। আমি লেখাপড়া জানি না। তবে নাম দস্তখত করতে পারি। ১৯৭১ সালে লবণ বিক্রি করতাম এবং ডাক্তার দেবেন্দ্র নাথের ঘরে নিয়মিত দুধ বিক্রি করে জীবন যাপন করতাম। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান। সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ শ্রাবণ বেলা দেড়টা থেকে পৌনে দুইটার দিকে সুবিদখালী বাজারের ধানহাট খোলায় পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোট নিয়ে আসে। এ সময় রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান সিকদারসহ পাকিস্তানী সেনাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বাজারে নিয়ে আসেন রাজাকার ফোরকান মল্লিক ও বেলায়েত চৌকিদার। প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী মোঃ চাঁন মিয়া বলেন, বেলা দুইটার দিকে কাদের জমাদ্দারকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ডাক্তার দেবেন্দ্র নাথের ঘরের সামনে নিয়ে আসে রাজাকাররা। এ সময় রাজাকার ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান সিকদার ও পাকিস্তানী সেনারা দেবেন্দ্র ডাক্তারের ঘরের ভেতরে ঢোকেন। পাকিস্তানী সেনাদের একজন পকেট থেকে কাগজ বের করে ফোরকানের দিকে তাকান। তখন ফোরকান মল্লিক বলেন, ইনিই দেবেন্দ্র ডাক্তার। পাকিস্তানী সেনা তখন ডাক্তার বাবুকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। এ সময় ডাক্তারের স্ত্রী কাকুতি-মিনতি করে বলেন, ‘দয়া করে মারবেন না। আমাদের সম্বল যা আছে নিয়ে যান’। এ সময় এক পাকিস্তানী সেনা দেবেন্দ্র নাথ বাবুকে গুলি করে হত্যা করে। সাক্ষী আরও বলেন, এ ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কারণ, আমার দোকান ছিল বাবুর ঘরের পাশেই। আমি সেখানে লবণ বিক্রি করতাম। সাক্ষী চাঁন মিয়া বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ শ্রাবণ আমি দোকান খুলে বসলে বেলা ১২টার দিকে দেখতে পাই রাজাকার ফোরকান মল্লিক, কমান্ডার শাহজাহান ও বেলায়েত চৌকিদারসহ অনেক রাজাকার রমণী কু-ু, শ্যাম কু-ু ও সুন্দর কু-ু এ তিন ভাইকে সুবিদখালী বাজারে অবস্থিত তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে পুরনো হাসপাতালে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ সময় তারা ধুতি পরা ছিলেন। কিন্তু বিকেল ৪টার সময় যখন তারা ফিরে আসেন তখন তাদের পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি দেখতে পাই। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা দুঃখ করে বলেন, এদেশে আর থাকা যাবে না। সাক্ষী বলেন, বাংলা ৩১ শ্রাবণ রাত ৮টার দিকে দেখি, ফোরকান মল্লিক, রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান ও বেলায়েত রামচন্দ্র সাহার মেয়ে গোলাপী রানীকে যুগীবাড়ির সুপারি বাগানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি গোলাপী রানীকে চিনতাম। সে তখন অবিবাহিত ছিল এবং স্কুলে যাতায়াত করত। পরদিন সকালবেলা দোকান খুলতে এসে আমি শান্তি কবিরাজ ও গঙ্গাচারণ আলাইকে জিজ্ঞেস করি, গতরাতে গোলাপী রানীকে নিয়ে গেল, তার খবর কি? এ সময় তিনি বলেন, দাদা আর বলিস না, যা হবার হয়ে গেছে। ওরা ভোর রাতে গোলাপীকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে মৃত্যুবরণ করে। আমরা তার লাশ শ্মশানে নিয়ে মাটিচাপা দিয়েছি। সবশেষে ললিত কর্মকারের কন্যা শোভারানী ও তার পুত্রবধূর ওপর রাজাকার ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান ও বেলায়েতের নির্যাতনের বর্ণনা দেন সাক্ষী মোঃ চাঁন মিয়া।
×