ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষী হাবিবুরের জবানবন্দী

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ ফোরকান মল্লিক গুলি করে হাতেম আলীকে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২০ জানুয়ারি ২০১৫

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ ফোরকান মল্লিক গুলি করে হাতেম আলীকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী ও কিশোরগঞ্জের রাজাকার হাসান আলীর বিরুদ্ধে দশম সাক্ষী জবানবন্দী প্রদান করেছেন। ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে জবানবন্দীতে সাক্ষী মোঃ হাবিবুর রহমান বাদশা বলেছেন, ফোরকান মল্লিক ও অন্যান্য রাজাকার হাতেম আলীর মেয়েকে নিয়ে যখন টানাটানি করছিল সে সময় হাতেম আলী বাধা দেন। তখন ফোরকান মল্লিক রাইফেল দিয়ে গুলি করে হাতেম আলীকে হত্যা করে। এরপর রাজাকাররা তার মেয়ে আলেয়াকে ধর্ষণ করে। অন্যদিকে হাসান আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষী সঞ্জীব কুমার সরকার জবানবন্দীতে বলেছেন, আমার দাদা কামিনী ঠাকুরকে হাসান আলী নিজে গুলি করে হত্যা করেছে। এরপর তারা জীবন ঠাকুরকেও হত্যা করে। জবানবন্দী শেষে দুটি মামলার পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে বুধবার। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ আদেশগুলো প্রদান করেছে। পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিকের জবানবন্দী শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান সাক্ষীকে জেরা করেন। অসমাপ্ত জেরার জন্য বুধবার দিন নির্ধারণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছেন। অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। সাক্ষীকে সাক্ষ্য প্রদানে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম হাবিবুর রহমান বাদশা, পিতা মৃত মজিবর রহমান, গ্রাম-কাঁকড়াবুনিয়া উপজেলা মির্জাগঞ্জ, জেলা-পটুয়াখালী। আমার বর্তমান বয়স ৫৯ বছর। আমি বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আবারও মানবিক বিভাগে পড়াশোনা করে বিএ পাস করেছি। আমি ১৯৭০ সালে সুবিদখালীতে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতাম। সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনারা পটুয়াখালীতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে শহর দখল করে নেয়। এরপর স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা হামিদ খান, আজাহার খান ও মজিবর শিকদারের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি এবং ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদার ও আলী আকবর গাজীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকাররা সুবিদখালী বাজারের পুরাতন হাসপাতাল ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের ২২ আগস্ট দুপুর দেড়টার দিকে পাকিস্তানী বাহিনী কাঁকড়াবুনিয়া বাজারে এসে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। গুলিতে সনদ কুমার সাহাসহ আরও একজন শহীদ হন। ফোরকান মল্লিক পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তায় বাজারে ব্যাপক লুটতরাজ চালান। মাছ ব্যবসায়ী সুন্দর আলীসহ অন্যদের দিয়ে লুটের মালামাল নদীতে রাখা গানবোটে নিয়ে রাখেন তিনি। হাবিবুর রহমান বলেন, এরপর ফোরকান মল্লিকের নেতৃত্বে রাজাকার আকবর আলী এবং পাকিস্তানী সেনারা আমাদের গ্রামে এসে আওয়ামী লীগের সমর্থক হাতেম আলীর বাড়িতে ঢোকে। পরে হাতেম আলীর ভাতিজা সেলিম ও অন্যদের কাছে শুনতে পাই, ফোরকান মল্লিক এবং আলী আকবর হাতেম আলীর মেয়ে আলেয়াকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে গানবোটে নিয়ে যান। আলেয়াকে বাড়ি থেকে বের করার সময় তার বাবা হাতেম আলী বাধা দিলে ফোরকান মল্লিক হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ওইদিন ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গে আসা রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত উত্তর কাঁকড়াবুনিয়াতে গিয়ে লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি, হাতেম আলীর মেয়ে আলেয়াকে পটুয়াখালী সার্কিট হাউসে নিয়ে গিয়ে ফোরকান মল্লিকসহ অন্য রাজাকাররা ধর্ষণ করেন। ধরে নিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যান। তখন আলেয়ার বয়স ছিল ১৮-২০ বছর। তিনি এখনও বেঁচে আছেন বলেও সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী মোঃ হাবিবুর রহমান বাদশা। আসামির কাঠগড়ায় থাকা ফোরকান মল্লিককে শনাক্ত করার মাধ্যমে সাক্ষ্য শেষ করেন তিনি। হাসান আলী ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কিশোরগঞ্জের রাজাকার হাসান আলীর বিরুদ্ধে দশম সাক্ষী সঞ্জীব কুমার সরকার জবানবন্দীতে বলেছেন, হাসান আলী নিজ হাতে আমার দাদা কামিনী ঠাকুরকে গুলি করে হত্যা করে। একই সময়ে জীবন ঠাকুরকেও রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। জবানবন্দী শেষে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বুধবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সাক্ষীকে জবানবন্দীতে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম। সাক্ষী সঞ্জীব কুমার সরকার জবাবন্দীতে বলেন, আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৫৬-৫৭ বছর। আমার ঠিকানা গ্রাম-আড়াইউড়া, থানা-তাড়াইল, জেলা কিশোরগঞ্জ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ১৩-১৪ বছর। তখন আমি তালডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। একাত্তরের ৮ অক্টোবর বাংলা ২১ আশ্বিন দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে ১৫-২০ জন রাজাকার আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। রাজকারদের মধ্যে একজন বলে সকলে সাবধান, আমি হাসান আলী দারোগা, তাড়াইল রাজাকার কমান্ডার, কেউ পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করা হবে। ওই লোকটির পরনে খাকি পোশাক, মাথায় সাদা টুপি ও মুখে হালকা দাড়ি ছিল। সাক্ষী আরো বলেন, রাজাকার হাসান আলীর নির্দেশে রাজাকাররা আমাদের বাড়ি লুটপাট করে। এরপর রাজাকাররা আমার দাদা কামিনী ঠাকুরকে ঘর থেকে ধরে এনে পিঠমোড়া করে বেঁধে উঠানে নিয়ে এসে তার ওপর নির্যাতন করে। হাসান দারোগার নির্দেশে রাজাকাররা আমাদের ঘরের বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবি খুলে এনে উঠানে ফেলে তা পা দিয়ে পাড়াতে থাকে এবং আমার দাদা কামিনী ঠাকুরকে ওই ছবিগুলির উপর প্রস্রাব করতে বলে। একপর্যায়ে হাসান আলী নিজ হাতে গুলি করে আমার দাদা কামিনী ঠাকুরকে হত্যা করে। এরপর জীবন ঠাকুরকেও তারা হত্যা করে।
×