ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কামাল লোহানী

গোবিন্দ হালদার মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

গোবিন্দ হালদার মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা

মহান মুক্তিযুদ্ধের এক মরমী সাথী গোবিন্দ হালদার আজ আর নেই। পরশু কলকাতার মানিকতলা জিতেন্দ্র নারায়ণ রায় হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। তাঁর শেষকৃত্য নিমতলা শ্মশানে সম্পন্ন হয়েছে শনিবার রাতেই। গোবিন্দ হালদার দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন এবং বাড়িতে আর হাসপাতালেই কাটাতে হচ্ছিল বছরের পর বছর। শেষ বারে মানিকতলার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কিছুদিন আগে। নিবিড় পরিচর্যা এবং চিকিৎসা হয়েছিল; কিন্তু বন্ধু গোবিন্দর দীর্ঘদিনের অসুবিধা এবং বার্ধক্যের চাপে খুব একটা চলাফেরা করতে পারতেন না। কথা জড়িয়ে গিয়েছিল। বলতে চাইতেন অনেক কথাই, কিন্তু প্রকাশ করতে কষ্ট হতো। এমনি অবস্থায় গত ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে কিডনির জটিল সমস্যা নিয়ে মানিকতলা জে, এন রায় হাসপাতালে ভর্তি হন, চিকিৎসা চলছিল। এ খবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানতেন গোবিন্দ হালদার অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যোগাযোগ করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাথেই কথা বলেন ঢাকা থেকে এবং তাঁর চিকিৎসার সকল ব্যয়ভার বহনের আশ্বাস দেন। দুদিন বাদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ পশ্চিমবঙ্গ সফরে ছিলেন। তাঁকে গোবিন্দ হালদারের অসুস্থতার কথা জানান হলে তাঁকে দেখতে জি এন রায় হাসপাতালে যান এবং তাঁর সুচিকিৎসার ঘাটতি যেন না হয় সে নির্দেশ দেন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারকে। কিন্তু সব শুভ কামনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু গোবিন্দ হালদার শনিবার ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে চলে গেলেন। মৃত্যুকালে তিনি অর্থাৎ গোবিন্দদা তাঁর হৃদয়ের সব ভালবাসাটুকু দিয়ে গেলেন। তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁর পুবপাড়ায়। সেদিন ছিল ১৯২৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মতান্তরে ১৯৩০ সালের ১ আগস্ট। সে যাই হোক, তিনি চলে গেছেন, এখন তাঁর বয়স সীমাহীন। যদি আমরা তাঁকে স্মরণে রাখি। এখানে একটা দুঃখ ও যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করতে চাই, সে হলো গোবিন্দ হালদার ওদেশের সন্তান হয়েও কী অপরিসীম মমত্ববোধ নিয়ে বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য তাঁর মন কেঁদেছিল বলেই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের গীতিকার গোবিন্দ হালদার লিখেছিলেন আবেগপূর্ণ অথচ সংগ্রামী জনগণের ব্যাকুল মনের ও অকুতোভয় সাহসের বিজয়গাথা। তাঁর অসুস্থতা, আর্থিক দুরবস্থার কথা শোনা এবং স্বচক্ষে দেখার পর আমি একটি লেখা লিখেছিলাম ঢাকার পত্রিকায়। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিকেরা কিছু টাকা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু নিউইয়র্ক থেকে প্রগতিমনা বন্ধুরা একত্রিত হয়ে আমাকে জানালেন তারাও গোবিন্দ হালদারের পাশে দাঁড়াতে চান। তুলেছিলেন কয়েক হাজার ডলার এবং সরাসরি দাদার ভারতীয় ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছিলেন। দু’একজন ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু টাকা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন। এ সময়টা সত্যিই দুর্বিষহ ছিল তাঁর দিনকাল। তাঁর কাছে গেছি বহুবার। তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশের মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কী সে আন্তরিকতা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু গত বছর বিজয় সরকারের মেলায় গেলাম এবং ওখান থেকেই শান্তিনিকেতন হয়ে কলকাতা ফিরলাম বটে গোবিন্দদার সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। বৌদির সঙ্গে কথা বললাম, কারণ গোবিন্দদা কথা বলতে চেষ্টা করেও পারেননি। তবু তাঁদের বলেছিলাম এরপর এলে দেখা হবে। অবশ্যই হবে। এই সময়টায় কাকুরগাছিতে নিজ ফ্ল্যাটে ছিলেন তাঁরা। ফ্লাটটি কিনেছিলেন গোবিন্দ হালদার। সে অর্থের যোগান হয়েছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মমত্ব আর শ্রদ্ধাবোধে। তিনি তাঁর জন্য ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। তাঁরই ফল এই ফ্ল্যাট। এখানেই কেটেছে তাঁর শেষ দিনগুলো; কিন্তু স্বস্তি পেতে পারলেন না। চলে যেতে হলো তাঁকে। গোবিন্দ হালদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রগতিশীল সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব শিল্পী কামাল আহমদ। কামাল ভাই কলকাতার বাসিন্দা হলেও পূর্ব পাকিস্তানেই তাঁর সময় কাটত এবং এই বঙ্গের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগ্রামে একজন প্রত্যক্ষ অংশীদার ছিলেন। দীর্ঘদিন কানাডা প্রবাসী, তবে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সপরিবারে চলে এসেছিলেন এবং এখান থেকেই কানাডা চলে গেছেন। গপ্পুরে মানুষ, প্রচ- সৃজনশীল মন তাঁর এবং সদাব্যস্ত থাকতেন। ৭১-এ কলকাতায়ই ছিলেন। কামাল আহমদই একদিন এসে বললেন, লোহানী আমার বন্ধু গোবিন্দ হালদার কতগুলো গান লিখেছে আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর। আপনারা নেবেন? স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজে লাগাতে পারবেন। তাঁকে বলেছিলাম, অবশ্যই নেব। আমাদের তো প্রচুর নতুন গান চাই। তো টেলিফোনে কথা বলে ঠিক হলো সেদিনই বিকেল বেলা কলকাতার চৌরঙ্গী মোড়ে আমাদের দেখা হবে। গোবিন্দ তাঁর গান নিয়ে আসবেন। হলো তাই। আমি সময়মতন বালীগঞ্জ সার্কুলার রোড (অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) থেকে চলে এলাম। গ্রান্ড হোটেলের পাশেই একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় বসলাম। গোবিন্দ এবং কামাল ভাই দুজনাই কয়েকটি গান পড়ে শোনালেন। দারুণ লাগছিল গীতি কবিতার ছন্দ, মনে হচ্ছিল যথার্থ সুর দিতে পারলে দারুণ হবে। দুটো এক্সারসাইজ বুকে লেখা ৩০/৪০টা গান। দুটোই বগলদাবা করে নিয়ে এলাম। গোবিন্দদা কিন্তু মূল হাতে লেখাটাই দিয়ে দিলেন। বিশ্বাস তাঁর সংগ্রামে ছিল তাই মানুষে অবিশ্বাস হলো না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস। তাঁকে খাতা দুটোই দিলাম। সময় বয়ে যায়। এমনি একদিন আপেলকে বললাম, তোমরা গান চাও, এনে দিলাম এতগুলো, ব্যবহার তো করছ না। একটু ক্ষোভ তো ছিলই। নতুন গানের চাহিদা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারে। ব্যবহার হচ্ছে না দেখে ক্ষোভই প্রকাশ করলাম। তখন আপেল আমায় বলল, আমাকে দেন না। তখনও তো আপেল অপরিচিত, নবীন গাইয়ে। ভাবলাম ও কি সুর করবে! তবু দিয়ে দেখি। সমরদার কাছ থেকে একটা খাতা নিয়ে আপেলকে দিলাম। আপেল পরদিনই সুর করে রেকর্ড করল এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সান্ধ্য অধিবেশনে বেজে উঠল সেই গানটি ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি মোরা একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি।’ প্রত্যেকে শিহরিত হলাম গানটি শুনে। এমন আবেগময় গীত রচনা এবং তাতে অপূর্ব সুর সংযোজনা গানটিকে প্রবল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। এটাই গোবিন্দ হালদারের প্রথম গান, যা স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত হয়ে রণাঙ্গনে, অবরুদ্ধ বাংলায় এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী সকলকেই অনুপ্রাণিত করেছিল নিপীড়িত পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি সহমর্মিতায়। সম্ভবত: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে এটি প্রচারিত হয়েছিল। সেদিন সন্ধেবেলায় প্রতিদিনের মতন বেতারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমএনএ আব্দুল মান্নান (সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক আহমদ রফিক), (সংসদ সদস্য ও দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ এবং জিল্লুর রহমান (যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন।) বেতার কেন্দ্রেই ছিলেন এবং গানটি শোনার পর প্রচ-ভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন আমাদের সবার মতন। এরপরই সমরদাও সুর করলেন ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’ গানটি। কোরাসে গাইলেন অজিত রায়, তিমির নন্দী, রথীন রায়, রূপা খান, মালা খান, বুলবুল মহলনবীশ, মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্ত, শীলা ভদ্র, মমিতা ঘোষ, কল্যাণী ঘোষ, আরও অনেকে। সমর দা নিজেও কণ্ঠ দিলেন। গোবিন্দর এ গানটিও অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। গোবিন্দ হালদারের লেখা আরও কটি গান সুর করা হলেও তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। মোট ৭টি গান সুর করা হয়েছিল। সবচেয়ে গীত ছিল উল্লিখিত দুটি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলো ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পরাজিত হলো, আত্মসর্ম্পণ করল। এরপরেই গোবিন্দ হালদার লিখেছিলেন, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না।” কত যে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এই গীত রচনা। আজও জাতি সগর্বে গাইতে গাইতে সেই উপলব্ধি প্রকাশ করেন। গানটি বিজয় ঘোষিত হবার পরে আপেল গোবিন্দ দার বাড়ি গিয়ে বসে থেকে লিখিয়ে এনেছিল। বাঙালীর জাতিসত্তার গর্ব মুক্তিযুদ্ধ এবং এই মহান চূড়ান্ত লড়াইয়ের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যে ভূমিকা পালন করেছে এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে যে অনতিক্রম্য অবদান রেখেছে, সেই ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালনেই এই গান ছিল সুতীক্ষè হাতিয়ার। মানুষের মনোবল চাঙ্গা রেখেছে। ঘায়েল করেছে শত্রুর ব্যূহ। অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিসেনাদের। এমনি সহযোদ্ধা বন্ধুর মৃত্যু আমাকে নয় কেবল, এদেশের মুক্তিপাগল সকলকেও শোকাহত করেছে। বাংলার মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
×