ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিছক মিছেই নাচে রাজনৈতিক মানুষ

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

নিছক মিছেই নাচে রাজনৈতিক মানুষ

দ্রুত বদলে যাচ্ছে রাজনীতি। যেমন বদলায় মানুষ। কাফকার ‘মেটামরফিসিয়াস’-এ পাওয়া যায়, একজন মানুষ তেলাপোকায় পরিণত হয়ে সিংকে উঠছে-নামছে। তলিয়ে যাচ্ছে কমোডের মধ্যে। এর মধ্য দিয়ে কাফকা যে কথা বলতে চেয়েছেন তার পটভূমি ছিল ভিন্ন। বিশ্লেষণও ভিন্নতর। বাংলাদেশে এ ধরনের রূপান্তর দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে। বিশেষত রাজনীতির অঙ্গনে। যে কারণে যাঁরা দেশ শাসন করতেন, জনগণের জন্য রাজনীতি করছেন বলে উচ্চনিনাদ করতেন, তারা রূপান্তরিত হয়ে সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদী হয়ে পড়েছেন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সত্তর দশকে লিখেছিলেন, ‘মিছে এবং নিছক মিছেই/রাজনৈতিক মানুষ নাচে মনুমেন্টের নীচে।’ কিন্তু এ দেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিক জনকল্যাণ ছেড়ে জনগণের প্রাণ সংহারে নেমেছে। বোমা আর আগুন নিয়ে খেলছে অবিরাম। জাতির প্রতি দায়দায়িত্ব পালনে অক্ষমতায় এরা লজ্জিত হয় না। বিরোধের কণ্ঠকে সময়ে-অসময়ে উচ্চগ্রামে তুলে পৌরুষ ঘোষণায় যারা ধৈর্যহীন, তাদের ভূমিকা প্রমাণ করে সন্ত্রাসই এদের শৌর্য। স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর স্বার্থ নয়, ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তারা জনজীবনকে করে তুলেছে বিপন্ন। দেশজুড়ে যে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে, নাশকতার আগুন ও বোমায় মানুষ মারছে, তা আর যাই হোক রাজনীতি নয়। পুরোপুরি সন্ত্রাস। অবরোধ নামক সহিংসতাকে ক্রমশ প্রলম্বিত করার নামে সন্ত্রাসের ও সহিংসতার এবং ভয়ের সংস্কৃতির যে চর্চা একদা রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য বিএনপি-জামায়াত জোট করে চলেছে, তা ক্রমশ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এবং এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। দেশ ও জাতির প্রতি দায়দায়িত্ব পালন যাদের কর্তব্য, তারা দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। অবরোধকারীদের আচার-আচরণ ঠিক সভ্যজনোচিত নয়। বরং বর্বরতার জ্বলন্ত উদাহরণ। মানবদেহকে অঙ্গারে পরিণত করে যে সীমাহীন নৃশংসতা, বর্বরতা অব্যাহত রেখেছে, তা আরও প্রলম্বিত হলে এবং প্রশ্রয় পেলে বাংলাদেশের ইতিহাস আবার বর্বরতার দিকে মোড় নেবে। জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত বাড়বে। দাপট দেখানোর জন্য দেশময় অশান্তি, হানাহানি, সহিংসতা তৈরি করে ভীতিকর যে পরিস্থিতির অবতারণা করা হচ্ছে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জনগণের সেবা ও কল্যাণ নয়। বরং জনগণকে জিম্মি করে, তাদের প্রাণ সংহারের মাধ্যমে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করে যে কোনভাবে ক্ষমতার রশি হাতে তুলে নেওয়া। আড়ালে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার এক অনৈতিক তৎপরতাও কাজ করছে। অবরোধ ডাকা রাজনীতিকদের উদ্দাম-উদ্ধত ব্যবহারের দরুনই নাশকতা, সন্ত্রাস ক্ষণে ক্ষণে বিস্ফোরিত হয়ে, সাধারণ মানুষের ওপর মৃত্যুর বিভীষিকা হয়ে আছড়ে পড়ছে। অবরোধ আহ্বানকারীদের আগ্রাসী মনোভাব জনজীবনকে শান্তি ও সোয়াস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না আর। বিষম উত্তেজিত, বলতে গেলে উন্মত্ত এই গণধিকৃত কর্মসূচী পালনকারীরা আজ। এরই ফলে দেশজুড়ে মানুষের জীবনের শান্তি বিঘিœত, দেশকাল বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্ম হবে বাক্যে, চিন্তায়, কর্মে যুক্তির অনুশাসন মেনে চলা, সেখানে একদা ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব পঁচাত্তর পূর্ববর্তী শ্রেণীশত্রু খতমের নামে গলাকাটার পথ বেছে নেয়া চীনাপন্থীদের অনুসরণে সশস্ত্র পন্থাকে মূলধন করেছে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ রাজনীতির অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা সেই খতমের রাজনীতিকে পুনর্বাসন করেছেন। যেমন করেছেন অতীতে যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে পুনর্বাসিত। মানুষ হত্যা করতে করতে তাঁরা এখন নিজেদের নেতাকর্মীদের প্রতিও হামলা চালাতে কসুর করছেন না। শক্তির প্রকাশ যথেচ্ছ ব্যবহারে নয়। যথার্থ শক্তির পরিচয় সম্বরণে। আস্ফালন শক্তিমানকে মানায় না। শক্তির অপব্যবহারের নামই দস্যুবৃত্তি। শক্তি মদে মত্ত হয়ে মানুষ হত্যায় যাঁরা নেমেছেন, তাঁদের সবক’টি রিপু দিনে দিনে অতিমাত্রায় উগ্র হয়ে উঠছে। রাজনীতিকরা ভুলে যাচ্ছেন রাজনীতিজনোচিত ব্যবহার। দেখে-শুনে মনে হয়, একদা তিন দফায় ক্ষমতাসীন দলটি এখন ঠিক প্রকৃতিস্থ অবস্থায় নেই। একটা লোক দেখানো আতিশয্য দেখা যায় তাদের কর্মকা-ে। যাকে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘রাজনীতি একটা কৌশল। আর আমরা সেই কৌশলের রাজনীতি করছি।’ কিন্তু ওনার এই কৌশলের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস চরমে উঠেছে। তারা এই অপরাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে সহ্যাতীত হয়ে উঠছে। যে কোন সময় তাই গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়বোধশূন্য, দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন নিরঙ্কুশ মানুষ নির্দ্বিধায় যে কোন কাজ করতে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই তাই তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত, রক্তচক্ষু, প্রহরণধারিণী, নৃমু-মালিনী, ভয়ঙ্করী মূর্তিধারী দেবী কালীর রূপ ধারণ করে আছেন যে নেত্রী, জনগণের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে সদম্ভে গর্জন করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের শান্ত-প্রশান্ত অবস্থা দেখে লজ্জায় জিভ কেটে সে নেত্রীকে বলতেই হবে উন্মত্ততা শেষে যে, ‘আমার একি ছিষ্টিছাড়া লক্ষ্মীছাড়া সব্বনাশী কীর্তি!’ বিএনপির আচরণ দেখে উপলব্ধি হচ্ছে, মন ছোট হয়ে গেলে দেশ ছোট হয়ে যায়। দেশ যে কত বিরাট তা তাঁদের ক্ষুদ্র গ-িতে অনুধাবন করতে পারেননি। পারবেন বলে মনেও হয় না। তাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন মুক্তিযুদ্ধকে, অসম্মান করেন মহান পুরুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদেরও। তাঁদের কাছে দেশপ্রেম নয়, রজকিনী প্রেমের মতো ‘নিকশিত হেম, স্বার্থগন্ধ নাহিক তায়।’ দেশের মর্ম তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলেই দেশকেও পণ্য মনে করেন। (বাকি অংশ আগামীকাল)
×