ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘোষণা করা সত্ত্বেও জেলকোড সংশোধন হয়নি ॥ ব্যাহত হচ্ছে কারা উন্নয়ন ও বন্দীদের মানবাধিকার

কারাগার চলছে দেড় শ’ বছরের পুরনো আইনে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

কারাগার চলছে দেড় শ’ বছরের পুরনো আইনে

মশিউর রহমান খান ॥ সময়ের প্রয়োজনে অনেক আইন যুগোপযোগী করা হলেও গত ১৫০ বছরেও পরিবর্তন হয়নি ব্রিটিশদের তৈরি কারা আইন বা জেল কোড। ১৮৬৪ সালের কারাবিধি এবং ১৯০০ সালের কারাবন্দী আইন দিয়েই চলছে বাংলাদেশের সকল কারাগার। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার কারা আইনের কয়েকটি ধারার সামান্য সংশোধন করলেও বাকি সকল নিয়মকানুনই রয়ে গেছে ব্রিটিশের তৈরি এ আইনের। স্বাধীনতার আগে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন সরকার নির্বাহী আদেশে কারা আইন সংশোধনে প্রায় শতাধিক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর কারা আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা কারা আইন পরিবর্তন ও সংশোধন করা হবে বলে বিভিন্ন সময়ে ঘোষণা দিলেও কার্যত তা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জেলকোড পরিবর্তন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা গেলেও স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৩ বছরেও এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সংস্কার করা হয়নি। যেটুকু হয়েছে তা সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটি কর্তৃক প্রণীত সুপারিশমালা আলোর মুখ দেখেনি এবং সেগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৬ সালে জেলকোড সংশোধনের চিন্তা করা হলেও পরে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। জেলকোড বা কারাবিধি সংস্কার সম্পর্কে গত ওয়ান ইলেভেনের সময় প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের প্রবীণ থেকে শুরু করে ছোট-বড় নেতকর্মীরা কারাগারে গেলে জেলকোড বা কারাবিধি সংশোধনের জোর দাবি ওঠে। পরবর্তীতে বর্তমান সরকার কারাগার পরিচালনা ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে বিদ্যমান জেলকোড সংশোধন করার চিন্তা করে। সূত্র জানায়, জেলকোড সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান সময়ে অনুপযোগী জেলকোডের বেশ ক’টি অন্যতম ধারা পরিবর্তন করে বিভিন্ন স্তরে যাচাই-বাচাই শেষে যুগোপযোগী করে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ করে। সংশোধিত জেলকোডে সরকারী প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের কারাগারে প্রথম শ্রেণীর ডিভিশন দেয়ার বিধান চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে গত মে মাসে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও তা করা সম্পন্ন হয়নি। অজ্ঞাত কারণে প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে গিয়েও আটকে আছে। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। সূত্র মতে, চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলকোড সংশোধনের লক্ষ্যে প্রস্তাব অনুমোদন করেন। সংশোধিত বিধান অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা (চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত) যে কোন মামলায় কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর কয়েদি বা বন্দী হিসেবে মর্যাদা পাবেন। বিদ্যমান জেলকোডের রুল ৯১০ অনুযায়ী সকল শ্রেণীর কারাবন্দীর ক্ষেত্রে তাদের জীবনযাপন ও পদ্ধতি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করে আদালত প্রথম শ্রেণী বা দ্বিতীয় শ্রেণীর কারাবন্দীর মর্যাদা নির্ধারণ করতেন। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনী কার্যকর হলে সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ডিভিশন দেয়ার জন্য আদালতের কাছে কোন প্রকার অনুমতির প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়াও ১৮৬৪ সালের কারাবিধি বাতিল করে নতুন কারাবিধি প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করা হয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে। পূর্বের কারাবিধিতে মোট ১৩৮৮টি ধারা ছিল। পরে বর্তমান সরকার বর্তমান সময়োপযোগী করে নতুন জেলকোড প্রণয়নের জন্য গড়ে তুলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। দুদকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে দুদক কিছু সরকারী চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব মামলা কিছু কর্মকর্তাকে প্রথম অবস্থায় গ্রেফতার করা হতে পারে। এসব কারণ বিবেচনায় নিয়ে সরকার জেলকোড সংশোধন করে এ ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সভাপতিত্বে কারাসংস্কারের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে উক্ত কমিটির সুপারিশসমূহ ২০০৬ সালে মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। জেলকোডের মোট ১৩৮৮টি বিধানের মধ্যে ঐ সময় ৪২১টি বিধান সংশোধন ও বিয়োজন এবং ২১৯টি বিধান বিলুপ্তি করা হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার সরকার জেলকোডের সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বয়স্ক পুরুষ বন্দী ছাড়াও শিশু অপরাধী, তরুণ অপরাধী, মহিলা অপরাধী ও শারীরিক বা মানসিকভাবে বাধাগ্রস্ত অপরাধীদের পৃথক কারাগার বা সেলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ডা-াবেড়ি মেয়াদ তিন মাসের স্থলে ৭ দিন করার প্রস্তাব এবং সাত দিনের অতিরিক্ত সময় এ ধরনের শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে উপ-কারা মহাপরিদর্শকের অনুমোদন গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে দ-প্রাপ্ত বন্দীদের বন্দীদশা প্রশমিত করা এবং সমাজে পুনর্বাসন ত্বরান্বিত করার জন্য দ-ের এক-তৃতীয়াংশ মওকুফ করার বিধান করা হয়। গুরুতর অপরাধে দ-িত নয় এমন বন্দীদের সংশোধন করে সমাজে পুনর্বাসন ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে শর্ত সাপেক্ষে মূল সাজার অর্ধাংশ খাটার পর প্যারোলে মুক্তির সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়। তবে মৃত্যুদ-ে দ-িত কয়েদি, যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দ-িত কয়েদি, অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দ-িত কয়েদির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না বলেও তাতে উল্লেখ করা হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৬ সালের সুপারিশ অনুযায়ী নতুন জেলকোড প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে, যা আজও আলোর মুখ দেখেনি। জেলকোড সংশোধনের বিষয়টি আজও আইন মন্ত্রণালয়েই পড়ে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কারাবন্দী, কারা পরিচালনা আইন নতুন করে তৈরি করা বা জেলকোড প্রণয়ন না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। পাশাপাশি কারাগারের উন্নয়নসহ নানা সমস্যা সমাধান শুধু পুরনো আইন ও বিধির কারণে করা সম্ভব হচ্ছে না। বন্দী ও সংশ্লিষ্টদের স্বার্থে অতি দ্রুত তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারাবিধি বা জেলকোড প্রণয়ন করা অতি জরুরী। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার প্রয়োজনে কিছু সংশোধনী এনেছে। যা নির্বাহী ক্ষমতাবলে আদেশের মাধ্যমে করা হয়েছে। বর্তমান সরকার কারা উন্নয়নে জেলকোড প্রণয়নের চিন্তা করেছে। এরই অংশ হিসেবে কারা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে নতুন জেলকোড কিভাবে তৈরি করা যায় তা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। বর্তমানে জেলকোডটির প্রণয়নের উদ্দেশ্যে কারা অধিদফতর থেকে নানা যাচাই-বাছাই, বিয়োজন ও সংযোজন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে তা জমা আছে। আইন মন্ত্রণালয় সংশোধিত জেলকোডটির বিষয়ে যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত মতামত প্রদান করার পরই তা প্রণয়ন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
×