ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিপ্লবী জননেত্রী সেলিনা বানু

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

বিপ্লবী জননেত্রী সেলিনা বানু

বিপ্লবী জননেত্রী সেলিনা বানু আজ আর নেই। কিন্তু ভুলবার মতো বিপ্লবী নেত্রী তো তিনি নন, যেমন নন আরও অনেক নেত্রীই-বিশেষত যাঁরা আমাদের বা তারও আগের যুগের। সেলিনা বানুর কর্মক্ষেত্র যেমন ছিল পাবনা, তেমনই ছিল ঢাকা আবার কখনও কুমিল্লা। সবচেয়ে বড় কথা হলো সেলিনাদি ছিলেন গণমানুষের নেতা। দরিদ্র জনগণের নেতা। সেলিনাদি বয়সে ছিলেন আমার চাইতে ১০-১২ বছরের বড়। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি পাবনাতে। আমার জন্মস্থান পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি ভুলবাড়িয়ার তিন মাইল দূরে আতাইকুলা উচ্চবিদ্যালয়ে এবং পাবনা শহরে এসে ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণীতে। শহরে এলেও তখন পর্যন্ত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হওয়ার ফলে পরিচয়টা ঘটেনি। আমি পাবনা শহরে আসি ১৯৪৭ সালের শেষে। তখনও শহরের স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকম-লী, রাধানগর পাড়ার প্রতিবেশীগণ এবং আর দু’চারজনের বেশি কাউকেই চিনতাম না। রাজনীতি করতাম না বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনের কাউকেই চিনতাম না। সেসব কারণে সেলিনাদি ছিলেন আমার কাছে নিতান্তই অপরিচিত। কিন্তু পরিচয়টা হয়েই গেল একদিন। তখনও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ইসলামী জোশ এবং মুসলিম লীগের বেশ প্রভাব সমাজে রয়ে গেছে। ঐ সমাজে আবার মেয়েদের চলাফেরা ছিল অত্যন্ত সীমিত। যে কোন মুসলিম মহিলার জন্য বোরকা পরা ছিল বাধ্যতামূলক। নারী শিক্ষার অগ্রগতিও তেমন একটা হয়নি। সমাজটি ছিল অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এই সামাজিক পটভূমিতে সেলিনাদির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে অকস্মাৎ একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, ১৯৫১ সালের দিকে। দিন তারিখ আজ আর মনে নেই। পাবনার নিয়ন্ত্রিত বেসরকারী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বনমালী ইনস্টিটিউটে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমরা জনাকয়েক সহপাঠী গিয়েছি। রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে হঠাৎ ঘোষণা করা হলো সভাপতি হিসেবে বনমালী ইনস্টিটিউটের সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাহতাব উদ্দিন সরকারের নাম। হলটিতে লোক সমাগম ভালই হয়েছিল। অবশ্য মহিলা দর্শকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। সেলিনাদি সামনের সারিতেই বসেছিলেন। সভাপতি তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্য বলার জন্য দাঁড়ানো মাত্রই একজন মহিলা সামনের সারি থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং তাঁর কণ্ঠের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ উদযাপনের নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি উপযুক্ত সম্মান না দেখিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে উচ্চাসনে বসিয়ে বিশাল একটি মালা দিয়ে মাল্যভূষিত করা হয়েছেÑ আর মঞ্চের মেঝেতে রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট একটি ছবিতে কটি ফুল দিয়ে গাঁথা মালা পরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এভাবেই রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করা হয়েছে। তাই এ জাতীয় অনুষ্ঠানে আমি থাকতে পারি না- এই কথা কটি বলেই হনহন করে মহিলাটি বেরিয়ে গেলেন। অপরদিকে সমগ্র হলটিতে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্য অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটিকে বসতে বললেন আর নিজের গলার মালাটি খুলে পরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের ছবিটিতে। অতঃপর কিছু দর্শক হাততালি দিয়ে নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়লেন। আমরা কয়েকজন ছাত্র এবং আরও কয়েকজন অল্পক্ষণের মধ্যেই হলত্যাগ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম-‘ভদ্র মহিলাটি কে?’ অনেকেই বলে উঠলেন, ‘সেলিনা বানু-পাবনার প্রখ্যাত জননেতা খান বাহাদুর ওয়াছিমউদ্দিনের দুঃসাহসী কন্যা।’ সেলিনা বানুর জন্ম হয়েছিল ১৯২৬ সালের ১৩ অক্টোবর এবং তিনিই হলেন পাবনার প্রথম মুসলিম মহিলা যিনি পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। কলেজ জীবনে তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র ফেডারেশনের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ও নেত্রী এবং পরে তিনি তাঁর কর্মনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, যোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও সাহসিকতার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গৌরবের সঙ্গে অর্জন করেছিলেন। ইতোমধ্যে পার্টির নির্দেশক্রমেই সেলিনাদি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পার্টির নির্দেশে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এবং মনোনয়ন পান। কিন্তু অকস্মাৎ দেখা গেল যুক্তফ্রন্টের মনোনীত নন এমন একজন অরাজনৈতিক মহিলাকে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন দেয়া হলো সেলিনাদির মনোনয়ন বাতিল করে। কারণ হলো, বৃহত্তম শরিক দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যকার রাজনৈতিক মতপার্থক্য। মওলানা ভাসানী সমর্থন করতেন সেলিনা বানুকেই এবং সে কারণেই তিনি মনোনয়ন পেয়েও গিয়েছিলেন, কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো দক্ষিণপন্থী নেতা আমলাদের ধরপাকড়ের ফলে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের অত্যাধুনিক স্ত্রীকে মনোনয়ন দেন। মহিলা প্রার্থীদের সংরক্ষিত নির্বাচনী এলাকা গঠিত হয়েছিল পৌর এলাকাগুলো নিয়ে। শেষতক দেখা গেল বিশাল এক ব্যবধানে সেলিনাদি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতীক ছাড়াই। আমরাও তাঁর সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাই। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে প্রচুর বাক-বিত-া হয়। কারণ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও সাম্র্রাজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির দাবিতে অবিচল ছিল। দুই নেতার তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা না হওয়ায় কাউন্সিলরদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের পর মওলানা ভাসানী অনুসারীরাই ভোটে জয়ী হন। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে। এই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সোহরাওয়ার্দী অনুসারীরা মানলেন না, শেখ মুজিব ঢাকায় পাল্টা কাউন্সিল ডাকলেন এবং ভুয়া কাউন্সিলর বহুল পরিমাণে ঢুকিয়ে বিশেষ আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে কাগমারী কাউন্সিলে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাব দুটি গঠনতন্ত্র অমান্য করে পাস করিয়ে নিলেন। ফলে দলে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন। দেশব্যাপী ঐ দুটি নীতির অনুসারী হাজার হাজার নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন। সেলিনাদি, অলি আহাদ, ভাষা মতিন প্রমুখও ঐ একই সময় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন। পরিণতিতে শেষতক ১৯৫৭ মালের ২৭, ২৮ ও ২৯ আগস্ট ঢাকায় এক নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করলেন মওলানা ভাসানী। সেই কনভেনশনে সেলিনাদিসহ পাবনা থেকে আমরা অনেকে, ঢাকা শহরসহ সমগ্র প্রদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশ থেকেই ট্রেন ও বিমানযোগে বহু সাম্র্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা ও কর্মী যোগ দেন। এই কনভেনশনেই সারা পাকিস্তান ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলো পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে ন্যাপের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সেলিনাদি নবগঠিত ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ন্যাপ গঠনের বছর দেড়েক যেতে না যেতেই এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক আইন জারি হয়। সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান বাতিল করা হয়, রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর ১৯৫৯ সালের মে মাসে আশীর্বাদ নিতে গেলাম নব-পরিণীতা স্ত্রী পূরবী মৈত্রসহ সেলিনাদিদের বাসায়। তখন আমি পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করতাম। যা হোক, সেলিনাদি ও তাঁর স্বামী খন্দকার মোহাম্মদ শাহজাহান উভয়েই আশীর্বাদ করলেন, আদর-আপ্যায়নও করলেন প্রাণ খুলে। বছর কয়েকের মধ্যেই রুশ-চীন আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলে ন্যাপে বিভক্তি আসে। চীনপন্থী গ্রুপটি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পিকিংপস্থী ন্যাপ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর বৃহত্তর অংশটি সীমান্ত গান্ধী খান আবুল গাফফার খানের পুত্র খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয়ে পরিচিত হয় মস্কোপন্থী ন্যাপ বলে। সেলিনাদি পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি এবং জননেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা সম্পাদক। আমাকে সদর মহকুমা কমিটির সভাপতি এবং জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। অতঃপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে সেলিনাদি জাতীয় পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু সেবার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার জোয়ারে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই শুধু নির্বাচিত হন। যা হোক, ১৯৭৩ সালে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সেলিনাদি, বাদশা ভাই, নুরুজ্জামান বাবলু পৃথক পৃথক আসন থেকে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর আগে, ১৯৭১ সালে তাঁর মেয়ে শিরীন বানু মিতিল পুরুষের বেশে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। মিতিলের যোদ্ধাবেশের ছবি কলকাতায় দৈনিক স্টেটসম্যান এবং আরও অনেক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। স্টেটসম্যানের পূর্বাঞ্চলীয় বিশেষ প্রতিনিধি তখন পাবনা এসেছিলেন এবং মিতিলের ছবি ও দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, যা তাঁর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। মিতিল তখন পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী। অতঃপর সেলিনাদি, তাঁর স্বামী শাহজাহান ভাই (কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য), কন্যা মিতিলসহ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। আমরাও চলে যাই মুজিবনগরে। আমাকে তখন ইলা মিত্রের বাসায় সিপিবির নেতা মণি সিংহের পরামর্শে চলে যেতে হয় পাবনা জেলার নিকটবর্তী নদীয়া জেলার পূর্ব সীমান্তে পদ্মা-তীরবর্তী করিমপুরে। একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের একটি যৌথ ক্যাম্প খুলতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসব্যাপী ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট এবং রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। একই সঙ্গে ন্যাপের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বও। বর্ষীয়ান নেতা অমূল্য লাহিড়ী ছিলেন পার্টির দায়িত্বে, জসিম ম-ল ছিলেন শ্রমিক ফ্রন্টের দায়িত্বে আর বাদশা ভাই ছিলেন সিপিআই ও কংগ্রেসের সহযোগিতায় ত্রাণ সংগ্রহের দায়িত্বে কলকাতাতেই। যা হোক, নয় মাস পর যখন দেশে ফিরে আসি তখন দেখি পাকবাহিনী ও তার অনুচরেরা মিলে আমাদের বাড়িঘর ভেঙ্গেচুরে লুটপাট করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম যার যা পরনে ছিল তাই নিয়ে। এ অবস্থার মধ্যেই দায়িত্ব পড়ল দ্রুত কমিউনিস্ট পার্টির ও ন্যাপের জেলা কমিটি গঠন করে পার্টিকে নতুন করে গুছিয়ে নেয়ার। তখন পাবনা-চাটমোহর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। জেলা রোডের কাঁচা-ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। বাস চলে না বিকেলের পর। কিন্তু তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সহকর্মীরা বহু কষ্টে একটি টমটম ভাড়া করে আনল। টমটমে উঠে পাবনা রওনা দিতেই যেইমাত্র বাঁশঝাড়ের দিকে পৌঁছেছি (দু’ধারে বাঁশঝাড়, মাঝখান দিয়ে রাস্তাটি চলে গেছে পাবনা পর্যন্ত), হঠাৎ করে সমাজী সাহেবের ৫/৬ জন পোষা সন্ত্রাসী নিজ নিজ রাইফেল হাতে উঁচু করে ধরে আমাদের ঘিরে লাফাতে লাগল। মুখে ‘জয়বাংলা’ সেøাগান। টমটমের চালক ভয় পেয়ে থেমে গেলে আমরা সন্ত্রাসীদের ধমকের সুরে বললাম ‘এর নাম জয়বাংলা, এই হলো মুক্তিযুদ্ধ?’ চালককে বললাম টমটম ছাড়তে। টমটম ছাড়লে আমরা পাবনা নিরাপদেই পৌঁছলাম, তবে রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, চাটমোহরের ঐ আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধে কোন অবদান রাখেননি, মুজিবনগরেও যাননি এবং ১৬ ডিসেম্বরে যদি পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ না করত তাহলে সমাজী সাহেব নাকি প্রকাশ্যে পাকআর্মির সঙ্গে হাত মেলাতেন। এ কথা জানালেন চাটমোহরের বহু লোক। সেলিনাদি সর্বতোভাবেই ছিলেন গভীরভাবে মানবতাবাদী, তাঁর দেশপ্রেম ছিল অতুলনীয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাবনাবাসীসহ দেশের সবাই যেন তাঁকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু সেলিনাদির এবং তাঁর মতো মানুষের প্রয়োজনীয়তা দিন দিনই বাড়ছে। তাই সেলিনাদি অমরÑ সেলিনা বানু মৃত্যুঞ্জয়ী।
×