ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহ্য ও পৌরাণিক কাহিনী থেকে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব আঙ্গিক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫

ঐতিহ্য ও পৌরাণিক কাহিনী থেকে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব আঙ্গিক

মোরসালিন মিজান যারপরনাই নিরীক্ষাপ্রিয় ছিলেন সেলিম আল দীন। গতানুগতিক চর্চার মধ্য দিয়ে যাননি। নিয়মিত ভেঙ্গেছেন। গড়েছেন। সবই মূল আঁকড়ে ধরে। শেকড় সন্ধানী নাট্যকার নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন। নাটকের কোন একটি ফর্ম বা কনটেন্টে বেশি দিন স্থির থাকতে দেখা যায়নি তাঁকে। সাহস দেখাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। আর তারপর বিদায়। প্রিয় পৃথিবী থেকে, নাটকের ভুবন থেকে আকস্মিকভাবেই চির বিদায় নেন তিনি। ক্ষণজন্মা নাট্যকারের বুধবার ছিল সপ্তম প্রয়াণ দিবস। তারও আগে থেকে নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে নাট্যজন ভক্ত অনুরাগীরা সেলিম আল দীনকে শ্রদ্ধায় প্রেমে স্মরণ করছেন। নতুন করে আবিষ্কার করছেন। চলছে বহু মাত্রিক বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে চমৎকার ফিরে দেখা। খ্যাতিমান নাট্যকারের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে গত সোমবার থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয় ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব-২০১৫’। স্বপ্নদল আয়োজিত উৎসবের স্লোগান- ‘বাঙলা নাট্যরীতির বিজয় কেতন, অমানিশাকালে স্বর্ণাভ চেতন, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন’। উদ্বোধনী দিন সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চায়িত হয় স্বপ্নদল প্রযোজনা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় স্বপ্নদলের আরেক নাটক ‘স্পার্টাকাস’। হাওয়ার্ড ফাস্ট-এর উপন্যাস থেকে বাদল সরকারের রচনা অবলম্বনে প্রযোজনাটির পুনর্বিন্যাস করেছেন জাহিদ রিপন। নির্দেশনাও তাঁর। উভয় নাটকের নির্মাণে সচেতনভাবে সেলিমের দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগানো হয়। ঐতিহ্যের ধারায় আধুনিক বর্ণনাত্মক বাঙলা নাট্যরীতিতে নির্মিত ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ ও ‘স্পার্টাকাস’ যেন সেলিমের জয়গান করে। তাঁর ছাত্র জাহিদ রিপন নাটকের ভাষায় নিজের সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তেমনি চলে গুরু বন্দনা। এর একদিন আগে মঙ্গলবার আয়োজিত সেমিনারেরও সেলিম আল দীনকে আবিষ্কারের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। নাট্যজন আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারের বিষয় ছিল ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন : নবীন সংবাদকর্মীর দৃষ্টিতে’। বিষয়বস্তু, বলতে হবে নতুন ছিল। আলোচনা খুব সমৃদ্ধ না হলেও কিছু বিষয় প্রথমবারের মতো ওঠে আসে আলোচনায়। সেলিম আল দীনকে সব সময় সামনে রেখে কাজ করছে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন। সপ্তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংগঠনটি। উদ্বোধনী দিন সন্ধ্যা ৭টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় সেলিম আল দীনের বিভিন্ন নাটকের নাট্যকোলাজ ‘পুতুল তোমার জনম কি রূপ’ চরিত্রাঙ্কন করেন অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার। বিষয়- বাংলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু- মুসলিম প্রসঙ্গ এবং দেশভাগ। বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রাহমান চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ আয়োজন থেকেও সন্ধান করা হচ্ছে সেলিম আল দীনের। গভীর আরও গভীরভাবে চলছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। ‘কীত্তনখোলা’র বিভিন্ন সমালোচনার কথা উল্লেখ করে সেলিম আল দীন নিজেই বলেছিলেনÑ ‘শকুন্তলা’ দেখার পর রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকেই বেশ আপ্লুত হলো, কিন্তু ‘কীত্তনখোলা’ দেখার পরই বলল সেলিম ভাই এটা কী করলেন আপনি! কোন নায়ক নাই, মেইন কোন ক্যারেক্টার নাই, কিছুই বোঝা যায় না। কেউ কেউ বললেন, এটা নাটক না উপন্যাস? আমার বয়োজ্যষ্ঠ এক নাট্যকার বললেন, সেলিম তুমি এটা আবার লেখ, একটু পরিবর্তন করো। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি যা-ই লিখে থাকি না কেন, আমি আলাদা কিছু লিখেছি। নাট্যকারের এই আলাদা হওয়ার সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে প্রতিটি আয়োজন থেকে! সেলিম আল দীনকে এই যে খুঁজে ফেরা, কেন? ব্যাখ্যা করেন নাট্যকারের দীনের নাট্য বন্ধু নাসির উদ্দীন ইউসুফ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সেলিম তো শেকড় সন্ধানী। একান্তই আমাদের। অন্যের কাছ থেকে তিনি কিছু ধার করেননি। বরং নিজের শেকড় খুঁজে নিয়েছেন। এজন্য তিনি একান্তই আমাদের। তাঁকে আমরা আর শারীরিকভাবে পাব না। তাই তাঁর সৃষ্টির মাঝে তঁাঁকে খোঁজা। নিজের ফিরে দেখার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেলিম আল দীন নাটকের আঙ্গিক নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। নিরীক্ষা চালিয়েছেন। বহু বিষয় নতুন মাত্রা পেয়েছে তাঁর নাটকে। সেলিমের নাটকের বিষয় হয়ে এসেছে শ্রেণী সংঘাত। সেলিম বলার চেষ্টা করেছেন, নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তা সঙ্কট আরও বাড়ায়। একইভাবে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও পুরাণ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন তিনি। সবই নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণের লক্ষ্যে। সেলিম আল দীনের আরেক নাট্যবন্ধু অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ বলেন, সেলিম আল দীন জানতেন চূড়ান্ত অর্জনের লক্ষ্যে বাংলা নাটককে নিজস্ব পথটি ধরে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ পৃথিবীর বহু দেশেই একইরকম ঘটনা ঘটতে পারে কিন্তু এর প্রকাশ স্থান-কাল-পাত্রভেদে আলাদা হয়। ছাত্রদের মধ্যে সেলিম আল দীনের চর্চা করছেন জাহিদ রিপন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলা নাট্যকে অদ্ভুত সমৃদ্ধি দিয়েছেন সেলিম আল দীন। পথ দেখিয়েছেন। এখন ধ্রুবতারা তিনি। সেই ধ্রুবতারাকে সামনে রেখে এগুচ্ছি আমরা।
×